কোভিড-১৯: টেস্ট কতটা সংকটে

বিশ্বজুড়ে ভয়াল করোনা রোগীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেল। শুরুর গল্পটা সবার জানা থাকলেও শেষের গল্পটা কেউই জানে না। সামনে কী হবে…? কোভিড-১৯-এর স্বাস্থ্যঝুঁকি বিশ্বকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে, তা এখনো অজানা। গোটা বিশ্বে সব ব্যবস্থাপনাকে পঙ্গু করে রাখা করোনা ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। সুস্থ থাকাটাই মানুষের এখন একমাত্র লক্ষ্য। প্রতিদিন দেশের খবরের পাতায় অপ্রত্যাশিত সংবাদ—বিক্রি হচ্ছে স্কুল! সংকীর্ণ হতে যাচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। চাকরি হারিয়ে চিরচেনা শহর ছেড়ে গ্রামের পথে যাত্রা। চারদিকে অসহায় মানুষদের অভাবের আর্তনাদ। কিটের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র। বিষয়গুলো সত্যেই হৃদয়বিদারক।

যত দিন যাচ্ছে করোনা প্রতিরোধের সংগ্রাম ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড। যার কারণে এখন আরও বেশিসংখ্যক মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। অন্যথায় হুমকির মুখে পড়তে হবে প্রিয় দেশকে।

কিটই হচ্ছে বর্তমান করোনা প্রতিরোধের হাতিয়ার। আর সেই কিটের সরবরাহ নেই বলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের করোনা পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো। কোথাও আবার নির্দিষ্ট সংখ্যার বাইরে চাইলেও টেস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশজুড়ে রোগী বাড়লেও সেই তালে বাড়ছে না টেস্টের সংখ্যা।

বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৬৬টি পরীক্ষাকেন্দ্রে করোনার নমুনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা চলছে বাংলাদেশে। অধিকাংশ পরীক্ষাকেন্দ্রই সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে না শুধু পরীক্ষা কিটের অভাবে। কিটের অভাবে কয়েকটি ল্যাবরেটরিতে করোনা পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছিল। দেশে যখন প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে তখন করোনা পরীক্ষায় কিটের স্বল্পতা এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিটের সংখ্যা বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার পেরিয়েছে এবং মৃত্যু দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ভাইরাসের ব্যাপক সামাজিক সংক্রমণের কারণে এখন ঢাকার বাইরেও প্রত্যন্ত এলাকায় প্রচুর রোগী শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিদিনই হাজারো মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় মারাত্মক চাপে পড়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। দেখা যাচ্ছে প্রায়ই ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ মানুষ মারা যাচ্ছেন।

সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে সন্দেহভাজন ব্যক্তি চিহ্নিত করা, রোগ শনাক্ত করা, শনাক্ত হওয়া রোগীকে আইসোলেশনে নেওয়া, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সেই মৌলিক কাজগুলো হয়নি বলেই সংক্রমণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

কিট নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত, এই ক্রান্তিকালে কিটের সংকট হলে ভীষণ উদ্বেগের। কেননা, এর কারণে শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করাই বিলম্বিত হবে তা নয়, কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠেছেন কি না, তা–ও জানা যাবে না। দেশের জনসংখ্যার বিচারে যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে না, আরও করা দরকার।

এদিকে টেস্টিং কিটের চেয়ে ল্যাবরেটরির অভাবকে বড় সংকট হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। যেখানে প্রতিদিন ন্যূনতম ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু এ পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ৫৫২টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। তা–ও মাত্র এক দিন, ১৭ জুন।

পরীক্ষার হিসাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ায়ও বেশ পিছিয়ে। যে কয়জনের পরীক্ষা হচ্ছে তাঁদের রিপোর্ট পেতে কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে যার ফলে অন্যদেরও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।

এদিকে, যত বেশি পরীক্ষা হবে, তত বেশি মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়বে। আর যত বেশি ধরা পড়বে তাদের অতি দ্রুত আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া হবে। এমন সূত্রকে ফলো করে লাগাম টেনে ধরছে করোনা প্রতিরোধের রোল মডেল দক্ষিণ কোরিয়া। গণহারে বিনা মূল্যে নমুনা পরীক্ষা বিশ্বে কোরিয়া এগিয়ে। শুধু কিট আবিষ্কারে তারা বসে নেই এটার দ্রুত কার্যক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে দেশটি। আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার দ্রুত ফলাফলের প্রত্যাশায় এমন কিটের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে কোরিয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যা কিনা মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত করতে সক্ষম হবে।

কোরিয়ার ইউনহাপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে নতুন কিটগুলো জরুরি চিকিৎসা, প্রসূতি মায়ের প্রসবের আগে কোনো করোনায় আক্রান্ত কি না, তা দ্রুত নির্ধারণ এবং অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতে যেখানে ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য সন্দেহজনক রোগীদের পরীক্ষা করা। করোনারোধে এমন জরুরি ডায়াগনস্টিক কিট প্রবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও বর্তমান কোভিড-১৯ পরীক্ষার কিটগুলো ফলাফল দেখাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় নেয়।

কোরিয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ক্লিনিক্যাল পারফরম্যান্স মূল্যায়ন এবং বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনার মাধ্যমে এটি দ্রুত অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।

করোনা মোকাবিলায় কোরিয়া সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব রোধে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে কিটসহ চিকিৎসাসামগ্রী সহায়তার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বন্ধুত্বের অপূর্ব নিদর্শন স্থাপন করেছে।

তবে এ মুহূর্তে দেশ এবং দেশের মানুষদের বাঁচাতে হলে অনেক বেশি পরীক্ষার প্রয়োজন আর তার জন্য লাগবে কিট। এদিকে কড়া নজর রাখতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠকদের। যদিও স্বাস্থ্য খাতকে সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবারের বাজেটে, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থের সঠিক পরিচালনায় হয়তো করোনা প্রতিরোধে অনেকটা সহায়ক হবে বলে মনে করছি।