কোভিড-১৯-কে লেখা চিঠি

করোনা পরীক্ষার নমুনা সংরক্ষণ করছেন এক স্বাস্থ্যকর্মী
প্রথম আলো ফাইল ছবি

কোভিড-১৯,
তুমি, ২০২০–এর ত্রাস জাগানো এক ঘাতকের নাম। তোমার পুরো নাম সার্স-কভ-২ বা করোনাভাইরাস হলেও তোমাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আর কিছু নেই। তোমার নাম আজ জগৎজুড়ে সবাই জেনে গেছে। শিশু, আবাল, বৃদ্ধ—সবাই। তুমি আরএনএ ভাইরাস। তোমার অবয়বের উপরিভাগের স্পাইক প্রোটিন দিয়ে তুমি হানা দাও মানুষের শরীরে। তোমার নিজের কোনো জীবন নেই। অথচ বেঁচে থাকো তুমি অন্যের দেহকে ভর করে। একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে।

কোভিড-১৯,
তুমি অদৃশ্য নিষ্ঠুর এক ঘাতক। তাই তো দুনিয়ার বুক থেকে কেড়ে নিলে প্রায় ১৮ লাখ লোকের প্রাণ। সেই যে বছরের শুরু হতে না হতেই চীনের উহান শহর থেকে উড়াল দিয়েছিলে আকাশে-বাতাসে, তারপর আর থামলে না। ছাড়লে না তুমি কোনো দেশকেই। চষে বেড়ালে তুমি পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা এমনকি অ্যান্টার্কটিকাও তোমার আঘাত থেকে রেহাই পেল না।

কোভিড-১৯,

মুসোলিনির ইতালিকেও তুমি ছাড়লে না। হানা দিয়ে কাবু করে ফেললে। এক এক সারি সারি করে কেড়ে নিলে কত শত প্রাণ। হিংস্র হিটলারের জার্মানিকেও তুমি ছাড় দিলে না। সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েও তোমাকে আটকানো গেল না। সম্রাট নেপোলিয়ানের ফ্রান্সও কি তোমার থাবা থেকে বাদ গেল? তা–ও গেল না। এমনকি কাঁদিয়ে ছাড়লে নাকানি–চোবানি খাওয়ালে তুমি চার্চিলের ইংল্যান্ডকেও। ছাড় দিলে না একটুও সেখানে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের জীবন প্রায় কেড়েই নিয়েছিলে! ভাগ্যিস এ যাত্রায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেন।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে নভেল করোনা ভাইরাস
সংগৃহীত

কোভিড-১৯,
মানলাম যে, মুসোলিনি, হিটলার, নেপোলিয়ান বা চার্চিলের মতো জগৎ কাঁপানোরা আজ তোমার দাপটের সময় কেউ বেঁচে নেই। অনেক আগেই তাঁরা গত হয়ে তোমার হিংস্র থাবা থেকে বেঁচে গেছেন। কিন্তু এখনো তো আছে জগৎ কাঁপানো আরও অনেকেই। যাঁদের কারও কারও নামধাম শুনলে আজকের দুনিয়ায় অনেকেরই ভয়ডর করে। থরথর করে হাত–পা কেঁপে ওঠে। যেমন ভ্লাদিমির পুতিন।
অত্যাধুনিক মিসাইল ও শত শতবার জগৎকে ধ্বংসকারী পারমাণবিক বোমা যাঁর দেশে স্তূপে স্তূপে, সারি সারি মজুত করে রাখা আছে, সেই ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ রাশিয়াকেও তুমি ছাড় দিলে না। কোভিড-১৯, তোমার বুকে কি ভয়ডর বলতে কিছুই নেই?

কোভিড-১৯,
মানলাম যে নেই কোনো ভয়ডর তোমার। তাই বলে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাকেও...? এত বড় একটি দেশ। পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসি নিয়ে যার পরিধি।

একদিকে আটলান্টিকের ঢেউ, আরেকদিকে প্যাসিফিক মহাসাগরের ঢেউ যে দেশটির মাটিতে অনবরত আছড়ে আছড়ে পড়ছে শো শো শব্দের কলতলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যাঁরা সারা দুনিয়াকে একচ্ছত্রভাবে দাবড়ে বেড়িয়েছেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকাকেও কুপোকাত করতে তোমার বুক এতটুকু কাঁপল না? তোমার সাহস দেখি কম নয় কোভিড-১৯।

করোনা শনাক্তের প্রতীকী ছবি

কোভিড-১৯,

মহাক্ষমতাধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়াকেও ধরে ফেললে তুমি ওয়াশিংটন ডিসির ওই সুরক্ষিত সাদা বাড়িতে। ট্রাম্পকে তুমি হেলিকপ্টারে করে পাঠালে হাসপাতালে। দুনিয়ায় হই হই রই রই রব উঠে গেল। ট্রাম্প বাঁচবে তো?
বেচারা চার বছরে আমেরিকানদের ভুগিয়েছে অনেক। নির্বাচনে হেরে গিয়েও বেচারার দম্ভ কী রে বাবা?
যা–ই হোক, কোভিড-১৯, ট্রাম্পের জন্য তোমার আবার দয়ার শরীর। তাই বুঝি গেল বেঁচে।

এ যাত্রায় তাঁরা বেঁচে গেল প্রাণে-উভয়ে-তোমার থাবা থেকে।

কোভিড-১৯,

কিন্তু মারলে তুমি অসহায় নিরীহ মানুষকে। করে দিলে তুমি তছনছ আমেরিকার ভেতরকে। প্রায় ১৯ মিলিয়ন মানুষের দেহে তোমার সংক্রমণ ঘটল বেশ জোরেশোরেই। তাতে মন্ত্রী, সিনেটর কেউ তোমার সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। অফিস–আদালতের গতি থেমে দিলে। বাস, ট্রাক ও ট্রেনের চাকার স্পিডও গেল শ্লথ হয়ে। প্লেনের পাখাও একসময় থেমে গেল। এ যেন এক দুর্বিষহ জীবন তুমি আমেরিকার ওপর দিয়ে বয়ে নিয়ে গেলে।

কোভিড-১৯,
প্রতাপশালী এ দেশের মাটি থেকে সাড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষের তরতাজা প্রাণও কেড়ে নিলে। শুধু কি তা–ই? পৃথিবীর ২৪/৭ দিবারাত্রির রাজধানী বলে খ্যাত নিউইয়র্ককে বানিয়ে ফেললে তুমি যেন এক ভুতুড়ে মৃত্যুকূপের নগরী। হাসপাতালগুলোতেও এর আগে এক শ বছরের ইতিহাসে এত লাশের মিছিল একসঙ্গে কখনো আর দেখা যায়নি। প্রবল ক্ষমতাধর দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তুলাধোনা করে একেবারে নড়বড়ে করে ফেললে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল অনেকের আশা। কত বাংলাদেশি প্রবাসীর স্বপ্নও নিঃশেষ হয়ে গেল তোমার হানার আঘাতে। চিরতরে।

করোনা পরীক্ষা করতে আসা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

কোভিড-১৯,
ভেবেছিলাম, আমাদের দরিদ্র দেশ বাংলাদেশের দিকে তুমি হয়তো উড়াল দেবে না। তোমার হয়তো থাকবে সেখানে কিছু মায়া, থাকবে কিছু দয়া। যেখানে এমনিতেই মানুষ প্রতিদিন বাসের ধাক্কায়, ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে জীবন দেয়। স্বজন হারানোর বেদনায় প্রতিদিন হয় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, অতিষ্ঠ। শুধু তা–ই নয়। লঞ্চডুবি, বিনা চিকিৎসায়, রোগে-শোকে-পাথর হয়েও যারা হেসে–খেলে জীবন দেয়। এমন নিরীহ, শান্ত, সোনার বাংলাদেশকেও তুমি ছাড় দিলে না। এ কোন অবিচার তোমার? তুমি এত বড় নিষ্ঠুর ও কসাই?

কোভিড-১৯,

২০২০ সালটাকে তুমি করেছ ধূসর ও বিবর্ণ। মানুষকে করেছ তুমি ঘরবন্দী। মানুষের দৃষ্টি ভিশন ২০/২০ কে তুমি করেছ প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু লাশ আর লাশ ছাড়া কী দিতে পারলে তুমি আমাদের এই ২০২০ তে?

কোভিড-১৯,
তাই বলি যাও তুমি দূর হয়ে।
চিরতরে এই পৃথিবীর হাওয়া থেকে।
২০২১–এর বাতাসকে বিশুদ্ধ করে।
বাঁচতে দাও তুমি সৃষ্টির সেরা জীবকে নিশ্বাস ভরে।
আমরা বাঁচতে চাই হিংসা ক্রোধমুক্ত এক পরিবেশে।
যেখানে মানুষ মানুষের পাশে।
প্রাণী থাকবে প্রাণিকুলে বনে জঙ্গলে সাগরে তাদের আপন ভুবনে।
সবাই বাস করবে কার্বনমুক্ত এক বিশুদ্ধ বাতাসে।

লেখক: মো. রওশন আলম, বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত।