কোরিয়ায় বাংলাদেশিদের ভিসা নিষেধাজ্ঞার দায় কার

বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় আসা যাত্রীদের মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ হিসেবে শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটির সরকার। গত শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) দেশটিতে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। দূতাবাস ফেসবুকেও বিষয়টি জানিয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় আসা যাত্রীদের মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ হিসেবে শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ১৬ এপ্রিল থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে গত বছরের ২৩ জুন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নতুন ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং অনিয়মিত বিমান চলাচল স্থগিত করে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। এর ফলে কোরিয়া গমনেচ্ছু বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং কর্মীর শিক্ষা ও কর্মজীবন হুমকির মুখে পড়ে। পরে পরিস্থিতি বিবেচনায়, প্রাণান্তকর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিউলে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস শুরু থেকেই এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। সিউলের দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের নিরবচ্ছিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে দীর্ঘ ৮ মাস পর বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুনরায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে দক্ষিণ কোরিয়া গমনেচ্ছু বাংলাদেশি নাগরিকেরা ঢাকার দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসের মাধ্যমে ভিসার আবেদন শুরু করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আবারও ৬৯ দিন পর কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমে জানায়, ১৬ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই দায় কার। প্রথমবার গত বছরের ২৩ জুন কোরিয়ার সরকার বাংলাদেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির খবরটি কোরিয়ার গণমাধ্যমে প্রকাশ করে। সে সময় আমি কোরিয়ায় অবস্থান করায় নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদন লিখেছি। বর্তমানে আমি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য জার্মানিতে অবস্থান করছি। উল্লেখ্য, প্রথম নিষেধাজ্ঞার সময় বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে সে দেশের সরকার। একে একে ছয়টি দেশ নিষেধাজ্ঞায় পড়ে।  পাকিস্তানে কোভিড পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় কোরিয়ার সরকার ইসলামাবাদের ভিসা আবেদন আবার চালু করে। এখনো পাকিস্তানের জনগণ কোরিয়ায় প্রবেশ করছে। কথা হচ্ছে, প্রতি মাসে পাকিস্তান থেকে করোনা রোগী কি যাচ্ছে না, উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, তবে কোনো মাসে একজন, কোনো মাসে দুজন। দীর্ঘ আট মাস কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর বাংলাদেশ ভিসা আবেদনের সুযোগ পায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ইমপোর্টেড করোনা নেগেটিভ হচ্ছে ৩৩ জন।

বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটির সরকার
ছবি: সংগৃহীত

সূত্র থেকে জানা যায়, ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে কোনো করোনা নেগেটিভ কোরিয়ায় গমন করে। কিন্তু মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ১৬ জন বাংলাদেশি করোনা নেগেটিভ ইমপোর্ট হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশে আবারও ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে বাংলাদেশ। এমন আশঙ্কা করেছিল অনেকেই।

৫ এপ্রিল ঢাকার দক্ষিণ কোরিয়া দূতাবাসের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ‘কোভিড-১৯ নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালের মার্চের শেষে সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, যা কোরিয়ান কর্তৃপক্ষের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

এ বাস্তবতায় আবারও ভিসা স্থগিতাদেশের মতো পরিস্থিতির আশঙ্কা দেখলেও আন্তরিকভাবে কিন্তু তা এড়াতে চাইছে কোরিয়ান দূতাবাস। যেমনটি বলা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে, ‘দূতাবাস, কোরিয়ায় প্রবেশের আগে ও পরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ এড়াতে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিরক্ষামূলক ও সতর্কতামূলক উদ্যোগ গ্রহণের জন্য কোরিয়া ভ্রমণকারীদের সক্রিয় ও স্বেচ্ছাসেবামূলক সহযোগিতার আশা করে। আপনাদের সহযোগিতায় আমরা ২০২০ সালের জুনে কোরিয়ান ভিসা স্থগিতাদেশের মতো পরিস্থিতি এড়াতে চাই, যার ফলাফল অন্য বাংলাদেশিদের জন্য মারাত্মক হতে পারে।

কোরিয়ান দূতাবাসের নির্ধারিত ১৩টি স্বাস্থ্য কোরিয়ার বিমানবন্দরে নামার পর আবারও পিসিআর পরীক্ষা করতে হয়। পরীক্ষায় পজিটিভ হলে নিজ খরচে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আর নেগেটিভ হলে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে যেতে হচ্ছে। কোয়ারেন্টিন শেষে আবারও পিসিআর পরীক্ষা করে ফল নেগেটিভ হলেই কর্মস্থলে যোগ দেওয়া যাবে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে সরকার নির্ধারিত খরচ ৩০ লাখ উওনের (দুই লাখ ২৮ হাজার টাকা) বেশি। পরিস্থিতি সাপেক্ষে এক কোটি উওন পর্যন্তও খরচ হতে পারে। করোনা শনাক্ত বাংলাদেশিদের এখন এই ব্যয়ভার নিতে হচ্ছে।

পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ ফল আসার পেছনে মূলত ব্যক্তিগত আইসোলেশন বা হোম কোয়ারেন্টিন না মানার প্রবণতাকেই প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিটিতে কোরিয়ান দূতাবাসের পরামর্শেও তাই উঠে এসেছে, ‘কোরিয়ায় প্রবেশের দুই সপ্তাহ আগে অন্য যে কারও সঙ্গে যোগাযোগ এড়াতে পরামর্শ দিচ্ছি, ব্যক্তিগত কোয়ারেন্টিন কঠোর ও দৃঢ়ভাবে পালন করুন। আপনার কোভিড-১৯–এর লক্ষণ থাকলে দয়া করে ভ্রমণের পরিকল্পনাটি পরিবর্তন করুন।’

সচেতনতার অভাবের এই বিষয়টিতে অনেকেই একমত। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ওপর জোর দিয়েছিল কোরিয়ার বাংলাদেশিদের সংগঠন ইপিএস বাংলা জন কোরিয়া কোরিয়া। কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা যায়, সিউলের বাংলাদেশ দূতাবাস বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বারবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার বিষয়ে। সাম্প্রতিককালে, বোয়েসেল, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কোরিয়াগামী বাংলাদেশিদের জন্য যাত্রার আগে দেশে কোয়ারেন্টিনের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় মিটিং সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু তা এখনো নোটিশ আকারে আসেনি।

গত বছরের মে-জুনে বিশেষ ফ্লাইটে কোরিয়াফেরত বেশ কিছু বাংলাদেশির করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছিল। ফলে জুনে এসে নিষেধাজ্ঞায় পড়ে বাংলাদেশ। সেই নিষেধাজ্ঞা তুলতে নিরবচ্ছিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও চিঠি, ফোনালাপে সিউলের সম্মতি আদায়ে চেষ্টা করেন। সর্বোচ্চ সতর্ক ব্যবস্থা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতিতে গত ফেব্রুয়ারিতে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর আবারও বাংলাদেশিদের ভিসা আবেদন নেওয়া শুরু করে ঢাকার কোরিয়ান দূতাবাস।

আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে সেই প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি রক্ষা না হওয়ায় শনাক্তদের সচেতনতার অভাবের চেয়ে দেশীয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতাকে দায়ী করছেন কোরিয়া প্রবাসীদের অনেকে। কথা হচ্ছে, সর্বোচ্চ সতর্ক ব্যবস্থা নিশ্চিতে কোরিয়াগামীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হলে কোরিয়া প্রেরণের আগে সরকারি তত্ত্বাবধানে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখলে এই নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যেত। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, কোরিয়াগামীদের অসতর্কতার কারণে এই নিষেধাজ্ঞা কি না, প্রশ্ন সেটাই। সত্যিকার অর্থে এর দায় কার!