কড়া ধাঁচের শিক্ষক ও শিক্ষার কথন

ঢাবিতে সেমিনার শেষে লেখকের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষক
ছবি: সংগৃহীত

১.
ছুটির দিনে ফেসবুকে ঢুঁ মারতেই একটা পোস্টে চোখ আটকে গেল। কৌতূহলী হয়ে সেটা পড়া। টিএসসিতে কিছু ছাত্রছাত্রী নিজেদের আলোচনায় একজন বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সবাই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আসি, কিন্তু সায়েন্স ফ্যাকাল্টির বিশেষ করে ফিজিকস, কেমিস্ট্রির শিক্ষকেরা আমাদের কিছু মনেই করেন না। তাঁদের এমন ভাব যেন তাঁরা একেকজন লর্ড কার্জন! পোস্টে এর বর্ণনাকারী কার্জন হল এলাকায় বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। পাবলিক প্লেসে এ রকম কথা শুনে তিনি বেশ হোঁচট খেয়েছেন, খানিকটা চটেছেন বললে ভুল হবে না। হোঁচট খেতেই পারেন, সেটা তাঁর নিজস্ব চিন্তা। এই চিন্তা পোস্টে কীভাবে বর্ণিত, তা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। তবে বিজ্ঞানের শিক্ষকতায় শিক্ষকেরা একটু কড়া ধাঁচের না হলে শিক্ষার মান যে বেশ সংকটাপন্ন হতো, সেটা লেখ্য।

শিক্ষার মান ঠিক রাখতে এবং প্রতিনিয়ত এর উন্নয়নে আসলেই কি এই কড়া ধাঁচের শিক্ষক হওয়াটাই দরকার? শিক্ষা ও গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনগ্রসরতার কথা তো সংবাদমাধ্যমে হরহামেশাই ভেসে আসছে। প্রথম আলোতে লেখা, কলেবরে বিশাল গুণমানে নিচে (অক্টোবর ২০, ২০২০) তো শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়ার এক প্রামাণ্যচিত্র। এসব থেকে উত্তরণের উপায় কী?

২.
কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলেবরে বিশাল মানেই তো গুণমানে বিশাল নয়। কলেবরের সঙ্গে সংখ্যার সম্পর্ক। আর গুণমানের সঙ্গে শিক্ষকের যোগ্যতা ও শিক্ষার্থীর অর্জনের সম্পর্ক। এই মানোন্নয়নে দরকার আনন্দময় গুণগত শিক্ষা। শিশু বয়সে জ্ঞানের নরম বীজশালায় যখন অক্ষরজ্ঞান শেখা হয়, সেগুলো আনন্দের হওয়া আবশ্যিক। কচি বয়সে শেখার সময় অ–তে অজগর নয়, অ–তে অসাধারণ শেখাটা অধিক বেশি কার্যকরী। অজগর শব্দে ভীতি আছে, কিন্তু অসাধারণে বিশেষ কিছু কৃতিত্বের কথা থাকে। গণনা শিক্ষায় ২ ও ৩ যোগ করলে ৫ হয়, এই শিক্ষাটায় অর্জন খুব সাধারণ, মানে অনেকের মতো গড়পড়তা। দুই ও তিন মিলে কীভাবে ৫ হয়, এর সচিত্র বর্ণনাতে মেলে বিশেষ কৃতিত্ব। সঙ্গে আরও কীভাবে ৫ হতে পারে (যেমন ০+৫, ১+৪, ৩+২, ৬-১, ৭-২), সেটা পারলে অর্জনটা তখন হয় খুবই বড়। মেধাতে তারা অসাধারণ, গিফটেড চাইল্ড।

শিক্ষাটা যদি হয় আনন্দের, অর্জনটা হয় অসাধারণ। উন্নত বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষার প্রক্রিয়া ও পরিবেশ অনেকেই স্বচক্ষে দেখছেন, সেগুলো কতই–না আনন্দের! কিন্ডারগার্টেনে শুধু খেলার ছলে শেখা। এসবে আদব–কায়দা, নিয়ম-নীতি, আর অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার শিক্ষা। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসের ছবি আর সংখ্যার মাধ্যমে অক্ষরজ্ঞান ও গণনার হাতেখড়ি এই কচি শিশুদের।

ভীতিকর কোনো পরিবেশ নেই। শিক্ষার্থীর যেকোনো বিষয়ে অমনোযোগিতায় কিংবা পড়া না পারায় কান ধরে ওঠবস নেই, বেত দিয়ে মার নেই, বকাঝকা নেই। শিক্ষকেরা এ কঠোরতা করতে পারেন না। কেউ-ই না, এমনকি মা-বাবাও না!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বছর দুয়েক আগে কানাডায় এক কিন্ডারগার্টেনে কোনো একদিনের ক্লাসে জনৈক শিক্ষক শিশুদের জন্য একটি গল্প পড়েছিলেন। সে গল্পের বিষয় ছিল মানুষের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং প্রকৃতির নিয়মে একসময় পরপারে চলে যাওয়া। পরপারে হারিয়ে যাওয়ার এই মৃত্যুর বিষয়টি কচি শিশুর মনে বড়ই ধাক্কা দিয়েছিল। সেই থেকে স্কুল ভালো না লাগার শুরু, আর মাঝেমধ্যোই কান্না—কি বাসায় কি স্কুলে। খারাপ লাগার এই অনুভূতি অমনোযোগিতা বাড়াল, শারীরিক অসুস্থতাও দেখা দিল। চিকিৎসক আদ্যোপান্ত সব বিষয়কে আমলে নিয়ে স্কুলের বিষয়ে খোঁজখবর করে জানতে পারলেন, সমস্যাটা শুধুই ভীতির। শিক্ষার্থী শিশুর মা-বাবা স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে ভীতির উৎসটা জানতে পেরেছিলেন। ভীতিকর গল্প বলায় সেই শিক্ষক ক্ষমা চেয়েছিলেন। পরিবার ও স্কুলের যৌথ চেষ্টায় শিশুটি এখন অত্যন্ত মনোযোগী শিক্ষার্থী।

৩.
চেষ্টা করা মানে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে থাকা। যেকোনো বিষয়কে গভীরভাবে বুঝতে আর চেষ্টাকে সফল করতে আনন্দময় পথের তুলনা হয় না। আনন্দময় পথের খোঁজ পেতে পরিশ্রম করতে হয়, শিখতে হয়। শেখার কোনো শেষ নেই—শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সবার। যুক্তি, তর্ক আর বিশ্লেষণ করে কারণ জানার চেষ্টায় মজা আছে। ধরুন কারও বাসায় টেলিভিশন আছে, কিন্তু বাচ্চারা থাকলে অধিকাংশ সময় এতে তাদেরই উপযোগী অনুষ্ঠান চলে। টিভির সামনে বসলেই সেটা বাচ্চাদের দখলে চলে যায়, এটা কেন? প্রাথমিক পর্যায়ের গণিতে গড়, মোডাল ও মধ্যমা দিয়ে ব্যাপারটা তাদেরও বোঝানো যায়। টিভির সামনে ৬, ৬, ৯, ১০, ৪০ বছরের মানুষ বসে থাকলে সংখ্যাগুলোর মধ্যমা (৯) কিংবা মোডাল (৬) প্রাধান্য পায়, তাই সে বয়সের বাচ্চারাই টিভির দখল পায়। সে জন্য তাদের সঙ্গে বসে বড়দেরও বাধ্য হয়েই কার্টুন দেখতে হয়।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের গবেষণায় প্রাথমিক পর্যায়ে এই লেখকের হাতের তালুতে কয়েকটি মলিকিউলার সিভ দানা ধরিয়ে প্রফেসর ওয়াতানাবে বললেন, দেখো কী হয়। এতে তিনি এক ফোঁটা পানি যোগ করলেন, তৎক্ষণাৎ হাতে প্রচণ্ড তাপ অনুভূত হলো, মস্তিষ্কের দ্রুত ক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়ে হাত সেগুলো ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে! ল্যাবরেটরিতে সাধারণত বিভিন্ন দ্রাবকে উপস্থিত স্বল্প পরিমাণ পানিকে শুষে নিতে মলিকিউলার সিভের ব্যবহার হয়। শুকনো খাবার শুষ্ক রাখতে, আর মিশ্রণ থেকে অন্যান্য ছোট যৌগ দূর করতেও এটি কাজে লাগে। পানি শুষে এত বেশি তাপ সৃষ্টির বিষয়টি নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন মজার অভিজ্ঞতাটা দরকার ছিল, শেখায় মজার অভিজ্ঞতা থাকলে শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়ে।

৪.
শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে উজ্জ্বল আনন্দের কিছু ঝিলিক দেখতে সেদিন ঢাবিতে গিয়েছি, তখন ২০১৯ সালের জুলাই মাস। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালামের সুন্দর ব্যবস্থাপনায় সেখানকার লেকচার-গ্যালারিভরা শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিতে সেমিনার দিতে সামনে দাঁড়িয়ে, কড়া ধাঁচের না হয়ে স্বভাবসুলভ নরম ভঙ্গিতে। মূল বিষয় রসায়নে গবেষণার বিবরণী ছাড়াও এতে ছিল শিক্ষার্থীদের উদ্যেশ্যে শিক্ষার গুরুত্ব, উচ্চতর গবেষণা, দেশ-বিদেশে ক্যারিয়ার, আর সফল মানুষের জীবনের গল্প। শিক্ষার্থীরা এসব খুবই মনোযোগ দিয়ে শোনেন। জানার আগ্রহ তাঁদের অনেক, মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে সামনে এগোতে চাই, হতাশাকে দূরে ঠেলে বড় স্বপ্ন দেখতে চাই।
শিক্ষাকে আনন্দময় করে শিক্ষার্থীদের বড় স্বপ্ন দেখিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। দেশে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে উন্নত বিশ্বের শিক্ষায় কী তফাত, শিক্ষক নিয়োগের কী প্রক্রিয়া, শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীর সম্পর্ক কেমন, গবেষণায় আগ্রহ আছে কি, গবেষণার মান কেমন, শিক্ষকতায় মূল্যায়নের কী প্রক্রিয়া, ব্যর্থতায় শিক্ষকের জবাবদিহি আছে কি? বিশেষ কোনো স্বার্থের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুরুদায়িত্বকে অবহেলা করে, বিভিন্ন রঙের রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতা প্রয়োগ করে, নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সাধিত ক্ষতিকর বিষয়গুলো রোধ করা খুবই প্রয়োজন।

৫.
শিক্ষাকে আনন্দময় করে কার্যকর করতে দরকার মুখে হাসিভরা জ্ঞানী শিক্ষকের। গোমড়া মুখের কোনো বদরাগী মানুষের কাছ থেকে শেখার কাজটা অনেক কঠিন। শিক্ষক কড়া ধাঁচের হলে শিক্ষার্থীরা ভয় পায়, অজানা বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সে বিষয়টা তখন শিক্ষার্থীর কঠিন বলে মনে হয়। কিন্তু শেখায় মজার অভিজ্ঞতা থাকলে শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়ে, শিক্ষা হয় আনন্দের, আর অর্জনটা হয় অসাধারণ। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলেবরে বিশাল মানেই গুণমানে বিশাল নয়। কলেবরের সঙ্গে সংখ্যার সম্পর্ক, আর গুণমানের সঙ্গে শিক্ষকের যোগ্যতা ও শিক্ষার্থীর অর্জনের সম্পর্ক।

লেখক: পিএইচডি, রিসার্চ সায়েন্টিস্ট (জৈব রসায়ন), কানাডা