খেলা নিয়ে আমরা কী করছি

যে জাতি ট্রাফিক রুলস অমান্য করে, দুর্নীতি, ধর্ষণ, পরনিন্দা, মিথ্যা বলে, যেখানে-সেখানে থুতু বা নোংরা আবর্জনা ফেলে, কথা ও কাজে নোংরামি করে, সর্বোপরি তোষামোদি করে, সে জাতি বিশ্বের কাছে সম্মান পেতে পারে না।

যে জাতি খেলাধুলায় মগ্ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় সতর্ক, জানা ও শেখার আগ্রহে অগ্রগামী, সে জাতি বিশ্বের কাছে তার সম্মান হারাতে পারে না।

সব শিক্ষায় নকল জড়িত, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। কোনো বিষয়ে ভালো করতে হলে যেমন আছি, তেমন থাকলে চলবে না। যেমন ‘গুড টু বেটার’ বা ‘গুড টু গ্রেট’-এর মানে, যেখানে আছি, এর থেকে আরেকটু ভালো থাকার বা হওয়ার ইচ্ছা বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা। জীবনে অনুপ্রেরণা, সাধনা, কঠোর পরিশ্রম বা বিসর্জন—এসব যদি না থাকে, তবে বেটার বা গ্রেটার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

আমরা বাংলাদেশিরা একটি বিষয়ে খুবই সচেতন, তা হলো, যত কষ্টই হোক না কেন, লেখাপড়ায় সবাই উঠেপড়ে লেগেছি। ভালো, খুব ভালো। কিন্তু ভেবেছি কি, দুনিয়াটা মস্ত বড় এবং এখানে প্রয়োজন রয়েছে অনেক কিছুর? এখন সবাই যদি বই হাতে করে জ্ঞানচর্চায় লেগে যাই, কী হবে বাকি দিকগুলোর?

শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, জ্ঞানের মাত্রাকে প্রসার করে তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। জাতির নৈতিক মানদণ্ডের উন্নতিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলারও প্রয়োজন আছে। খেলাধুলা মানুষের মনকে উদার করে, অলসতা ও কুৎসিত চিন্তাকে দূর করে। খেলাধুলায় যাঁরা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের ইমেজকে কাজে লাগাতে পারেন সহজে। ক্রীড়াবিদেরা সহজেই বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেন। তাঁদের ব্র্যান্ড নেমের মূল্য অপরিসীম। তাঁদের ভোগের চেয়ে ত্যাগের ওপর নজর বেশি। তাঁরা আনন্দঘন সময়ের জন্য কাজ করেন অনেক, তবে সেই আনন্দের মুহূর্তটুকু কিছুক্ষণমাত্র। তবু এই কিছুক্ষণের বিনিময়ে কষ্ট করতে তাঁরা অভ্যস্ত।

১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ, অথচ হাতে গোনা মুষ্টিমেয় লোক খেলাধুলায় আসক্ত। কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে? দৈনিক পত্রিকা খুললে যেসব খবর চোখে পড়ে, তা হলো দুর্নীতি, ধর্ষণ; মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে ক্রিকেট। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভালো খেললে সবার মুখে টাইগারদের গুণগান, খারাপ খেললে গালিগালাজ। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখায় বাঙালিরা পাগল। খেলা দেখা, সমালোচনা করায় পণ্ডিত, অথচ কেউ নিজের দেশের হয়ে খেলতে বা খেলাতে রাজি নয়, কারণ কী? কারণ কিছু একটা তো অবশ্যই আছে! আমার ধারণা, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫০ বছর পার হলেও জাতি গঠনে আমরা তেমন একটা মনোযোগী হতে পারিনি। সেই না পারার ব্যর্থতা অনেকের।

একদিকে যেমন অর্থনীতিবিদদের, অন্যদিকে রাজনীতিবিদ আর বুদ্ধিজীবীদেরও! শুধু তাঁদেরই নয়, আছে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর। আর তাঁদের সবার সামগ্রিক ব্যর্থতা যাঁরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, তাঁদেরও দায়টা কম না। আমার মনে হয়, তাঁরাই মূলত বেশি দায়ী, আর তাঁরা হলেন সাংবাদিকেরা। যদি ঠিকমতো তাঁরা তাঁদের দায়টা পালন করতেন, তাহলেও আমরা কিছুটা আলোর দিশা খুঁজে পেতাম।

যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক দুঃসময়ে তাঁরা তাঁদের লেখনী দিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ টাইগারদের একটি সবল, হৃষ্টপুষ্ট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দল গঠনে তাঁদেরও অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। একটি দেশ বা জাতির যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে দেশের উন্নতি হবে কী করে?

বিশ্বের কোথায়, কীভাবে খেলাধুলার প্রতি কী পরিমাণ বিনিয়োগ করা হচ্ছে, এসব বিষয় যদি প্রতিনিয়ত লেখালেখি না হয়, কীভাবে নতুন প্রজন্ম জানবে? স্পেনে চলছে ডেভিস কাপ খেলা। কেউ কি জানে, বর্তমানে কীভাবে এ খেলা চলছে? টেনিসে বেশ নিয়মকানুন পরিবর্তন হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে যদি অনুপ্রেরণা না দেওয়া হয়, হবে কি কোনো পরিবর্তন? বাংলাদেশের ক্রীড়া শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের পরিবর্তনে সাংবাদিকদের ভূমিকা আরও সক্রিয় হওয়া দরকার। খেলাধুলার জগৎকে প্রতিদিন তুলে ধরা দরকার, জানা-অজানা খেলাধুলার জগতের খবরাখবর দৈনিক সংবাদের একটি বিশেষ অংশ হওয়া দরকার, যা একটি জাতিকে চেতনা দেবে, অনুপ্রাণিত করবে।

বাংলাদেশ সরকার এখনো বিষয়টির তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করছে বলে আমার মনে হয় না। পৃথিবীতে অনেক দরিদ্র দেশ রয়েছে, যারা খেলাধুলার কারণে বিশ্বে সম্মান অর্জন করছে। এই প্রতিযোগিতার যুগে খেলাধুলা নিয়ে যেসব সাংবাদিক লেখালেখি করেন, তাঁরা বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সুফল পাওয়া যাবে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। নতুন প্রজন্মের মধ্যে সৃজনশীল মনোভাবের সৃষ্টি না করতে পারলে তারা দেশপ্রেমিক হবে না।

হাজারো ভালো শিক্ষা অর্জন করলেও দুর্নীতিমুক্ত হবে না দেশ। সুশিক্ষা পেতে খেলাধুলার বিকল্প নেই। আমি শিল্পব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত থেকেও খেলাধুলার ওপর বহু বছর সময় দিয়েছি এবং আমার ছেলেমেয়েকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছি, তাই জানি এর মূল্য কী। আমাদের ফুটবল হ্যাল্ট একাডেমি চালু হয়েছে, যেখানে উদ্দেশ্য মাত্র একটিই। আর তা হলো, লাল-সবুজের পতাকাকে বিশ্বে তুলে ধরা। আর এ জন্য দরকার সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ। কীভাবে পেতে পারি, তা জাতির কাছে আমার এখন প্রশ্ন। আমি বিশ্বাস করি, ১৭ কোটি মানুষের ৩৪ কোটি পা এবং হাত রয়েছে।

তাদের আরও সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে হবে। আর সে অসম্ভবকে বাস্তবে রূপ দিতে সবার সাহায্য কামনা করছি। সরকারকে সৃজনশীল হতে হবে, বেশি বেশি উদারতা দেখাতে হবে, ‘অ্যাগ্রি টু ডিজঅ্যাগ্রি কনসেপ্টে’ বিশ্বাস বাড়াতে হবে, এরই সঙ্গে বাংলাদেশের সব সাংবাদিককে সুযোগ দিতে হবে, তাঁরা যেন দেশের স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন কোনো রকম ভয়ভীতি ছাড়া।
লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন