ছেলেবেলা

কিছুদিন ধরে বৃষ্টি পড়বে পড়বে ভাব। আমি খুব আকুল হয়ে অপেক্ষায় আছি কখন সেই বৃষ্টি পড়বে। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। আজকে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। খুব ভিজতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু হলো না। মায়ের খুব কড়া নিষেধ আছে। যেন কোনোভাবেই ঠান্ডা না লাগে। এই লকডাউনের সময় যেন বাইরেও বের না হই খুব জরুরি কাজ ছাড়া। তবে কয়েকবার অফিসের কাজে বাইরে বের হয়েছিলাম। বারবার কল দিচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করছিলেন, কী খেয়েছি, ফিরেছি কী না, এখনো কেন ফিরিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।

 মাকে চিন্তায় রাখতে কেন জানি আমার খুব ভালোই লাগে। বিশেষ করে আমাকে নিয়ে বা আমার ব্যাপারে যদি চিন্তিত থাকেন, তখন খুব উপভোগ করি। মাঝেধ্যেই আমি অনেক সময় ইচ্ছে করেই এটা–সেটা বলে মাকে চিন্তিত রাখি। মোবাইলের ওপারে মায়ের চিন্তিত কণ্ঠ শুনতে ভালোই লাগে। অনেক সময় ভাবি আর এমন করব না। কিন্তু কেন জানি মাকে চিন্তিত রাখতে ভালোই লাগে আমার।

বাইরে থেকে ফিরে আসার পর ইচ্ছে করেই আধা ঘণ্টা পরে জানাই। ফিরে এসেছি বললে, ভালোভাবে হাত–মুখ ধুয়ে অথবা স্নান করে বিশ্রাম নিতে বলেন। এই লকডাউনের সময় মায়ের সঙ্গে যতবার কথা হয়, ততবারই মা স্মরণ করিয়ে দেন, দেখো বাবা, আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে আছ। তাই খুব সাবধানে থাকবে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবে। অসুস্থ হলে তো কেউ দেখার নেই। তাই নিজেই নিজের যত্ন ভালোভাবে নিয়ো। তাই বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে।

১.

তবে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি দেখে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারিনি। ছাতা নিয়ে হাঁটতে বের হয়ে গেলাম। অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। এই আর কি। বৃষ্টিতে হাঁটছি। ছেলেবেলার সেই দস্যি সময়গুলো খুব মনে পড়ছিল। ঝড়ের সময় দলবল নিয়ে আম কুড়ানো, দীঘিতে সাঁতরানো। সাঁতরিয়ে এপাড় থেকে ওপাড় যাওয়ার প্রতিযোগিতা। নানার বারণ সত্ত্বেও তার গাছের জাম্বুরা পেরে ফুটবল বানিয়ে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে সবুজ ঘাসের ওপর খেলাধুলা, চিৎকার চেঁচামেচি। আম অথবা জামগাছে উঠে বৃষ্টিতেই আম বা জাম খাওয়া। বাড়ি ফিরলে বাবার বকুনি খাওয়া। পিটুনি থেকে বাঁচতে মায়ের পেছনে শাড়ির আঁচলে লুকাতাম। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়ে গেলে দৌড়ে দীঘির ওপারে নানা বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিতাম। বাবা রুদ্রমূর্তি ধারণ করলে মা আমাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হতো। বাবার বকুনি আর পিটুনি খাওয়ার হাত থেকে তখন একমাত্র নানাই বাঁচাতে পারত। সেই পরিস্থিতিতে নানা ছাড়া ওই সময় আর কেউ রক্ষা করতে পারতেন না। বাবার আদেশ ছিল, যেখানেই থাকি বা যাই না কেন, সন্ধ্যায় আজানের আগেই যেন বাড়ি ফিরি। কখনো আজানের পরে ফিরলে বাবা যদি টের পেত, তাহলে সেদিন কপালে শাস্তি জুটত।

২.

যেদিন খুব বৃষ্টি হত, সেদিন খুব করে চাইতাম হেড স্যার যেন স্কুলে না আসেন। কারণ বৃষ্টির দিন হেড স্যার বেশি আসতেন না। হেড স্যার আমাদের অঙ্ক পড়াতেন। অঙ্ক না পারলে খুব করে মারতেন অথবা ক্লাসের বাইরে কানধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। শুনেছি, স্যারের মার খাওয়ার পর ভয়ে অনেকেই দ্বিতীয়বার আর স্কুলের বারান্দা মাড়াইনি। স্যার আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। একদিন বৃষ্টির দিন তিনি আমাকে নিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়েছিলেন। তার সেই বিখ্যাত সাইকেলে করে। প্রথমে বুঝতে পারিনি কেন তিনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন। পরে বুঝতে পারি বই আনতে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন। কর্মকর্তাকে বলছিলেন, আপনারা খ্রিষ্টধর্মের বই দিচ্ছেন না কেন। আমার স্কুলেও তো খ্রিষ্টান ছাত্রছাত্রী আছে। তাদেরও তো তাদের ধর্মের বই পড়ার অধিকার আছে। যে ছাত্রটি আমার সঙ্গে এসেছে, সে খ্রিষ্টান, জিজ্ঞেস করে দেখুন। পরের সপ্তাহে স্যার খ্রিষ্টধর্মের তিনটা বই নিয়ে এসেছিলেন আমাদের জন্য। যেহেতু আমরা তিনজনই ছিলাম। খ্রিষ্টধর্মের কোনো শিক্ষক না থাকায় হেড স্যার আমাদের খ্রিষ্টধর্মের ক্লাস নিতেন। খুব যত্ন নিয়েই পড়াতেন। আমি গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে পাস করার বছরই স্যারও অবসরে চলে গিয়েছিলেন। পরে কয়েক বছর যোগাযোগ ছিল স্যারের সঙ্গে, অনেক সময় রাস্তায় দেখা হতো হোস্টেলে যাওয়া–আসার পথে। অনেক দিন হেড স্যারের কোনো খবর পাইনি। স্যার কোথায় কেমন আছেন জানি না। আমি যে গ্রামের স্কুলে পড়েছি, সেই স্কুলে এখন খ্রিষ্টধর্ম পড়ানো হয় না, শিক্ষক নেই বলে। ইসলাম ধর্মের বই পড়ানো হয়। এই নিয়ে আমি ৫-৬ বছর আগে একবার কথা বলতে গিয়েছিলাম প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে। তাঁর উত্তর ছিল, যেহেতু শিক্ষক নেই, তাই পড়ানো হয় না। আর পরীক্ষায় নম্বরেও একটা ব্যাপার আছে। তাই তাদের ইসলাম ধর্ম পড়ানো হয়। কিছু মনে করো না। শুনেছি, স্যার চলে যাওয়ার পর খ্রিষ্টান যারা ওই স্কুলে পড়েছে, খ্রিষ্টান ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও তারা ইসলাম ধর্মের বই পড়েই পরীক্ষা দিয়েছে। স্যারের সঙ্গে যেদিন উপজেলায় বই আনতে গিয়েছিলাম, সেদিন সেই কথাগুলো খুব বেশি বুঝতে পারিনি। কিন্তু অনেক পরে বুঝতে পারি, স্যার কেন সেই কথাগুলো বলেছিলেন। কেন কর্মকর্তার সঙ্গে বইয়ের ব্যাপারে দেনদরবার করেছিলেন।

 ৩.

ছাতা না থাকায়, বর্ষাকালে বৃষ্টির দিনে বই নিয়ে আসার জন্য একটি পলিথিন সঙ্গে রাখতাম সব সময়। স্কুল ছুটির পর বৃষ্টি পড়লে বই আর শার্ট পলিথিনে ভরে বুকে চেপে ধরে দৌড়ে বাড়ি ফিরতাম। অনেক সময় কলাপাতা অথবা বড় কচুপাতা ছাতা হিসেবে ব্যবহার করতাম। বন্ধুদের দেখতাম অনেকেই বড় পলিথিনগুলো ছাতা হিসেবে ব্যবহার করত। স্কুলে থাকতে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন থেকে ছাতা পেয়েছিলাম। পরে সেই ছাতায় ব্যবহার করতাম স্কুলে আসা–যাওয়ার জন্য।

একবার তো বৃষ্টিতে ভিজে সেই জ্বর হলো। জ্বর কোনোভাবেই ভালো হচ্ছে না। মা–বাবা অনেক চিন্তিত। পরে বাবা আমাকে কোলে নিয়ে তার কাকার বাড়ি গেল। বাবার কাকা আমার দাদু কবিরাজ ছিলেন। শুনেছি অনেককেই ওষুধ দিয়ে সুস্থ করেছেন। আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর দাদু ওষুধ দিয়েছিলেন। সেই ওষুধ খেয়েই সুস্থ হয়েছিলাম। তবে একবারই নয়, যত দূর মনে পড়ে, ছোটবেলায় যতবারই অসুস্থ হয়েছি, ততবারই দাদুর ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়েছি। তবে সেবার স্কুলে যে বৃত্তি দিত, অনুপস্থিত থাকার জন্য বৃত্তির অর্ধেক টাকা কেটে রেখেছিল। মন খারাপ করাতে হেড স্যার বলেছিলেন, আর অসুস্থ হয়ো না। পরেরবার যখন বৃত্তির টাকা দেব পুরোটায় দেব নিয়মিত স্কুলে এসো।

স্কুল ছুটির পর, আমরা বন্ধুরা মিলে চোর-পুলিশ খেলতাম। দেশলাইয়ের প্যাকেট কেটে চোর পুলিশ খেলার জন্য কার্ড তৈরি করতাম। অনেক সময় বড় ভাইদের সঙ্গে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। তারা মাছ ধরত, আমরা দাঁড়িয়ে দেখতাম। বৃষ্টিতে পানি বাড়লে ধানখেতের আইলগুলো পানির নিচে চলে যেত। তখন কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানাতাম। সেটা নিয়েই বন্ধুবান্ধবরা মাছ ধরতে যেতাম জাল নিয়ে। মাছ পেতাম না কিন্তু তাতেই অনেক আনন্দ হতো। বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকা হাঁটুসমান পানিতে ধানখেতে হাডুডু খেলতাম বন্ধুরা মিলে। খেলা শেষে নানার দীঘিতে এসে পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করতাম, সাঁতরাতাম আর হইচই চেঁচামেচি তো ছিলই। নানা দেখে ফেললে লাঠি নিয়ে তাড়া করত আমাদের। পানি থেকে উঠে দৌড়ে পালাতাম।

৪.

বৃষ্টিতে ভিজে আম/জাম কুড়ানো, জাম্বুরা বা কাগজ দিয়ে বল বা নৌকা বানানো, হাডুডু, বৌচি, চাঁদনী রাতে দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাঙ্গুলি, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ইচিং-বিচিং, কানামাছি খেলাগুলো খুব মিস করি। ডাঙ্গুলি খেলতে গিয়ে চারটি দাঁত হারিয়েছিলাম। সেকি বিশ্রী এক অবস্থা ছিল।

বন্ধুরা খুব খেপাত। তাদের সঙ্গে খেলতে লজ্জা পেতাম। অনেকেই বলত আর দাঁত গজাবে না। এতে আরও অনেক ভয় পেতাম। কিন্তু ঠিকই দাঁত গজিয়েছিল।

জানি, সেই দিনগুলো আর ফিরে পাব না। রবিঠাকুরের মতো বলতে ইচ্ছে করে ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি...।’ দূরে থেকেও হুমায়ুন আজাদের মতো বলতে চাই...

‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।

ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।

ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।

ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।

ভালো থেকো।

..ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।

ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।

ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।

ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।

ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।

ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাঁশি।..

ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।

ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।’