জাতীয় কবির অনুপ্রেরণায় জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

পরিবর্তনের জন্য সবাই কাজ করলেও মঞ্চে সবাই ফুটে ওঠে না। ফুটে না ওঠার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে ফুটে উঠেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের সময়। কারণ, তিনি তাঁর কবিত্বের মাধ্যমে যে বার্তা তৎকালীন ব্রিটিশ শাসককে দিয়েছিলেন, তা অন্য কেউ দিতে পারেননি।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—

নজরুলের অনুপ্রেরণায় সারা ভারতবর্ষ অনুপ্রাণিত হয়েছে। আজও আমরা বিপদে সাহস খুঁজে পাই তাঁর কবিত্বে। বাঙালির জাতিত্ব অর্জন ও পরিবর্তনে কবি নজরুলের ভূমিকা অপরিসীম।

কাজী নজরুল ইসলাম (১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

আমরা বিশ্বের শুরু থেকে আজ অবধি ইতিহাস ঘেঁটে দেখি, তাহলে কী লক্ষণীয় হবে? সব পরিবর্তনে দরকার একজন নেতার। তবে ব্যক্তির পরিবর্তনে দরকার ব্যক্তির নৈতিকতার। এ পর্যন্ত যাঁরা নেতা হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে যে জিনিসটার মিল সেটা হলো, তাঁরা সবাইকে মোটিভেট করতে পারদর্শী। যেমন বাংলাদেশ স্বাধীন করতে কে না চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নেতা হতে পেরেছেন খুব সামান্য কজন। বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অপরিসীম, ফলে তিনি হয়েছেন জাতির পিতা। জাতির পিতার শতবর্ষ পালনে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। যেমন ‘স্বাধীন করলাম সবাই, অথচ পালন হচ্ছে একজনকে নিয়ে।’ ওই যে বললাম, নেতার নেতৃত্বে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি নেতাকে ঘিরেই সেই পরিবর্তনের বিকাশ ঘটে, তখন সেই নেতা মানেই তাঁর অনুসারী আর অনুসারী মানেই নেতা। জাতির পিতার অনুসারী ছাড়া যেমন তিনি জাতির পিতা হননি, ঠিক তেমনি তাঁর শতবর্ষ পালিত হয়নি কোটি কোটি অনুসারী ছাড়া।

কাজী নজরুল ইসলাম

একটি জনগোষ্ঠীর বা দেশের পরিবর্তনে নেতার ভূমিকা অপরিসীম। ধর্মের ক্ষেত্রে নবী রাসুল থেকে শুরু করে যুগে যুগে বড় বড় মহাপুরুষের নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। বড় বড় বৈজ্ঞানিকের নেতৃত্বে বিজ্ঞানের পরিবর্তন এসেছে। ব্যক্তির ব্যক্তিগত নেতৃত্বে ব্যক্তির পরিবর্তন এসেছে। ইংরেজিতে বলা হয় self-discipline বা আত্মনিয়ন্ত্রণ। সে আবার কী? ওই যে কথায় বলে, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ এর জন্য দরকার নিজের বিবেকের কাছে নিজের হিসাব-নিকাশ দেওয়া। বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে একটার পর একটা যেসব বিক্ষোভ, আন্দোলন, গণ–অভ্যুত্থান ও রক্তাক্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সবই হচ্ছে মানবজাতির মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট ও বিশাল প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ। আজ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি নজরুলের কবিতা ও গান কী ধরনের এবং কতটুকু প্রেরণা জোগাতে সক্ষম হয়েছে?

নজরুলের কবিতা ও গান ছিল সহায়ক শক্তি। সর্বোপরি, কথাটি বলতেই হয় যে সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ে যুগে যুগে নজরুলসাহিত্য হচ্ছে হাতিয়ার। সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে নজরুলসাহিত্যের উপাদানগুলোই হচ্ছে প্রেরণার উৎস।

বিদ্রোহী কবি নজরুলের অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। এ নিপীড়িত জনগোষ্ঠী ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের অভিজ্ঞতার জের হিসেবে ধর্মীয় রাজনীতিবিদদের বিপরীতে জাতীয়তাবাদী ছাত্র ও যুব নেতাদের বক্তব্যকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল। তাঁর হৃদয়ে তখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অভয়বাণী, ‘বাংলার জয় হোক। বাংলা বাঙালির হোক।’ এরই প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চারণ করেছিলেন নতুন স্লোগান ‘জয় বাংলা!’ অচিরেই পূর্ব বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এই স্লোগান। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর পূর্ব বাংলার প্রান্তর।

পল্টনের সমাবেশ থেকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৩ মার্চ ১৯৭১।
ছবি: সংগৃহীত

মনে কি পড়ে! বঙ্গবন্ধু স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা ছাড়াও কবির রচিত ‘চল্ চল্ চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটিকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মার্চিং সংগীত হিসেবে মর্যাদা দান করেছিলেন। এ কর্মকাণ্ড এবং পরিবর্তনগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার লড়াই। সে ক্ষেত্রেই আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি নজরুলের প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু এবং সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে, যদি আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে আত্মবিশ্বাস, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের শিক্ষার মাধ্যমে সৃজনশীল ও সুশিক্ষা অর্জন এবং তার মধ্য দিয়ে উক্ত দুর্নীতিমুক্ত ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লড়াইয়ে শরিক হতে পারি।

লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন