জাপানিদের সততা ও আমার অভিজ্ঞতা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

জাপানে উচ্চশিক্ষার জন্য আসার আগে জাপান সম্পর্কে বিশেষ করে এখানকার মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণা বিন্দুমাত্র ছিল না। জাপানিদের অনেকগুলি গুণাবলির মাঝে সবচেয়ে বেশি আমাকে আকৃষ্ট করেছে তাঁদের সততা ও ভদ্রতা।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মতন জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউনিভার্সিটি কোপ (UNIV. CO-OP) নামের জায়গা আছে। আমাদের দেশের টিএসসির সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এই কোপে খাবার থেকে শুরু করে বাস-ট্রেনের টিকিট, বই ও নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছু পাওয়া যাই। আছে গান, নাচ ও আড্ডা দেওয়ার আলাদা আলাদা কক্ষ।
কাগাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের প্রায় ১৫-১৭ জন অধ্যয়নরত। গবেষণার মাঝে একটু সময় পেলে সবাই মিলে কোপ অথবা কফি কক্ষে আড্ডা দেওয়া হয়। কিছুদিন আগে আমি আমার একটা পেনড্রাইভটা হারিয়ে ফেলি। পেনড্রাইভটা আমার কাছে মহামূল্যবান ছিল। কেননা আমার পিএইচডির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেনড্রাইভে ছিল। পরবর্তীতে ল্যাব, বাসা ও আরও অনেক জায়গায় খুঁজে না পেয়ে অনেক হতাশ হয়ে পড়ি। কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। দুই দিন পর আমার ল্যাবমেট এক ইন্দোনেশিয়ান আমাকে জানান যে, তিনি একটি পেনড্রাইভ কোপের খাওয়ার কক্ষের একটি টেবিলের ওপর দেখেছেন। আমি তৎক্ষণাৎ কোপে গিয়ে আমার পেনড্রাইভটি দেখতে পাই। আমি ভাবতেও পারিনি, আমার পেনড্রাইভটা এখানে ফেলে রেখে যাব এবং দুই দিনেরও বেশি সময় পরে একই টেবিলের ওপর তা পেয়ে যাব। অথচ এই খাওয়ার কক্ষে প্রতিদিন অনেক ছাত্রছাত্রী আসেন। কেউ একটিবার ছুঁয়ে দেখেননি পেনড্রাইভটি।
প্রতি বছরই কয়েকজন নতুন ছাত্রছাত্রী আসেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য। আমরা যারা এখানে আগে থেকেই আছি তারা নতুনদের প্রথম দিকের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকি। গত বছর একজন নতুন ছাত্রের জন্য আমি তাঁর বেডিং সামগ্রী একটি দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসি। নিয়ম হলো বেডিং সামগ্রী কোন তারিখ, কয়টায় ও কোথায় পৌঁছাতে হবে শুধু সেটা দোকানে বলে দিলেই হলো। দোকান থেকেই লোকজন নির্দিষ্ট সময়ে ট্রাকে করে বেডিং সামগ্রী পৌঁছে দেবে এবং ডেলিভারির পর টাকা (ইয়েন) পে করতে হবে।
আমি সেদিন বেডিং সামগ্রীর কেনার জন্য পর্যাপ্ত টাকা নিয়ে গেলেও তা পরিশোধ করতে হয়নি। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখলাম আমার ওয়ালেটটা পকেটে নাই। অথচ মানিব্যাগে আমার টাকাসহ জাপানিজ রেসিডেন্স কার্ড (বাইরে সব সময় বহন করা বাধ্যতামূলক), স্টুডেন্ট কার্ড, লাইব্রেরি কার্ড, হেলথ ইন্স্যুরেন্স কার্ড ও ব্যাংকের সকল ক্রেডিট কার্ড ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল নিয়ে চলে গেলাম সেই দোকানে। সেখানে ও আশপাশে না পেয়ে সারা রাত দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারিনি। পরদিন সকালে সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবের উদ্দেশে রওনা দিলাম। মেইন রোডে উঠে কিছু দুর যাওয়ার পর রাস্তার মাঝে আমার ওয়ালেট পড়ে থাকতে দেখলাম। হাতে নিয়ে দেখি সবকিছুই আছে এমনকি একটি টাকাও কম ছিল না। জাপানিরা সাধারণত খুব তাড়াতাড়ি রাতে ঘুমাতে যায় এবং খুব সকালে উঠে কাজে লেগে পড়ে। হয়তো আমার ওয়ালেটটা অনেকের চোখে পড়েছে কিন্তু কেউ তা ছুঁয়েও দেখেনি।
অন্য একদিন আমার বাসার পাশের শপিংমল থেকে অনেক কিছুর সঙ্গে স্ট্রবেরি কিনে বাসায় এসে দেখি স্ট্রবেরির প্যাকেটটি নাই। জাপানে ফলের দাম অনেক বেশি। যা হোক আমি পুনরায় দোকানে গিয়ে স্ট্রবেরির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তারা এ রকম ফলের প্যাকেট পায়নি বলে উত্তর দেন। কিন্তু দোকানের অনেকেই তখন আমাকে বসিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিল। তাদের দোকান থেকে একটা জিনিস হারিয়ে গেছে বলে তারা লজ্জিত বোধ করছিল। পরে আমি আরেকটা স্ট্রবেরির প্যাকেট কিনে বাসায় ফিরে আসি। কিন্তু অন্য একদিন আমি আবার একই দোকানে কিছু কিনতে গেলে একজন আমাকে দূর থেকে দেখে দৌড়ে এসে আমি সেই লোক কিনা জিজ্ঞেস করেন। আমি হ্যাঁ বলতেই, আরেকজন কর্মকর্তা এসে আমার কাছে প্রথমেই সরি বললেন। আমি ঘটনা কি বলতেই আমাকে বললেন, সেদিন তাঁদের দোকান থেকে আমার স্ট্রবেরি হারিয়েছে বলে আমি মনে করেছি, তাই বিষয়টার জন্য কর্তৃপক্ষ আমার কাছে ভীষণভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তাঁরা কিন্তু আমার স্ট্রবেরির প্যাকেটটা তখনো খুঁজে পায়নি। আমি বললাম, হয়তো আমিই প্যাকেটটা অন্য কোথাও হারিয়েছি। অবশেষে ওই কর্মকর্তা আমাকে বললেন, তাদের কর্তৃপক্ষ আমার স্ট্রবেরি হারানোর ব্যাপারে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাকে তার যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে। তারা আরেকটা নতুন স্ট্রবেরির প্যাকেট আমাকে বিনা মূল্যে দেবে অথবা যদি আমার স্ট্রবেরি না লাগে তাহলে তার যে মূল্য ছিল তারা আমাকে সেটা ফেরত দেবে। আমি তো অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। আমি যতই বলি ভুলটা আমারই, তারপরও আমাকে যেকোনো একটা নিতেই হবে এবং কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। আমি অপারগ হয়ে স্ট্রবেরি নিতে বাধ্য হলাম এবং তা নিতে রাজি হওয়ায় মনে হলো ওই কর্মকর্তা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
জাপানের পাবলিক টয়লেটগুলি হলো ড্রয়িং রুমের মতন সাজানো ও পরিষ্কার। সকল আধুনিক ও টেকনোলজির সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একেকটি টয়লেট। একদিন ভুল করে আমি আমার মোবাইল একটি টয়লেটে রেখে আসি। পরবর্তীতে অনেক পরেও গিয়েও একই স্থানে মোবাইল সেটটি খুঁজে পেয়েছি। কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করেননি। জাপানে কোনো হারানো জিনিস পেয়ে পুলিশকে না জানানো বড় ধরনের অপরাধ।
এ রকম অনেক কাহিনি আছে জাপানিজদের সততার। আর জাপানে বাংলাদেশিদের অবস্থানও অনেক ওপরে। অথচ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জাপানি হত্যার ব্যাপারে আমার অধ্যাপক থেকে শুরু করে সাতজন জাপানি ল্যাবমেট কোনো দিনও আমাকে জিজ্ঞেস করেননি, কেন এই হত্যা? আমার কাছে মনে হয়েছে তাঁরা মনে হয় জানেনই না বাংলাদেশের এই হত্যার ব্যাপারটা। এত উঁচু অবস্থানে থেকেও কতিপয় কিছু বিপথগামীদের জন্য আমাদের নিজেদের অনেক ছোট মনে হয় জাপানিদের কাছে।

(লেখক পিএইচডি শিক্ষার্থী, কাগাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কাগাওয়া, জাপান)