জীবনের বিচক্ষণ ভ্রমণ, সঙ্গে তাজ্জব ঘটনা

ইতালির সুদূর দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের বৃহত্তম দ্বীপ সিসিলিতে একটি ভ্রমণ ছিল জীবনের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সমুদ্রসৈকত, ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান, বিস্তৃত শপিং এবং বিশ্বখ্যাত খাবারসহ বলা যেতে পারে সে ছিল আমার কাছে ইতালির সবচেয়ে সেরা আকর্ষণ।

সিসিলি বিভিন্ন ধরনের, পাহাড়–পর্বতমালার অসাধারণ প্রকৃতিকে অফার করে। এখানকার পাহাড়ি গ্রামগুলো গড়ে উঠেছে সমুদ্রসৈকতের পাশ দিয়ে, তারপর রয়েছে আগ্নেয়গিরি এটনা, অনুর্বর মস্তক এবং সুন্দর পালেরমো শহর—যা দ্বীপের রাজধানী। পালেরমো একসময় মাফিয়াদের আড়তখানা ছিল, সেই খারাপ খ্যাতি মহানগরকে পেছনে ফেলে বর্তমানে এটি একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক শহরে পরিণত হয়েছে। সেই অতীতের আকর্ষণীয় মাফিয়া আড়ত আজ বিদ্যমান গোটা বিশ্বে। তবে সিসিলিতে আবিষ্কার করার মতো অনেক কিছু এখনো আছে।

সিসিলিতে আমার ভ্রমণের সময় ছিল ১৯৯৯ সালে। পুরো ভ্রমণটাই ছিল জীবনের এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। আগ্নেয়গিরি স্বর্গ দ্বীপ সিসিলির উত্তরে রয়েছে আইওলিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, পোসেইডনের পুত্র আইওলোসের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় সাতটি ছোট ছোট আগ্নেয় দ্বীপ রয়েছে এখানে। স্ট্রোম্বোলি আগ্নেয়গিরি থেকে গর্জন শিখা দেখা, কাদা ও স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটা, জীবনের একটি বিশেষ সময় যা শেয়ার করার মতো। জুনের প্রথম দিকে এক ঝাঁকুনির সন্ধ্যায় আমি নেপলস থেকে স্ট্রোম্বোলি, আইওলিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ফেরি করে যাই। ফেরিটি পোর্টা দে ম্যাসা বন্দর থেকে ছেড়ে যায়।

আগ্নেয়গিরি দ্বীপের সর্বোচ্চ পর্বতের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে আগুনের ক্যাসকেড এবং অগ্ন্যুৎপাত থেকে উত্তাপ দ্বীপের শীর্ষে একটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত মেঘের রিং। আহ কীই–না চমৎকার সেটা দেখতে। স্ট্রোম্বোলির ওপর অনেক কিছুই জানা এবং দেখার রয়েছে। শুরুতে এ দ্বীপে কয়েকজন জেলে পরিবার দ্বারা জনবসতি লাভ করে। এখান থেকে রবার্তো রোজেলিনি স্ট্রোম্বোলি টেরা দি ডিও চলচ্চিত্র দিয়ে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেছিলেন সুইডেনের হলিউড তারকা ইঙ্গ্রিড বার্গম্যানের সঙ্গে তাঁর রোমান্সের মধ্য দিয়ে। আবহাওয়া ভালো থাকলে নৌকায় করে পুরো আগ্নেয়গিরি দর্শনের আকর্ষণটি সবার মন কেড়ে নেয় এবং স্থানটি দেখার সুযোগ আরও বেড়ে যায়।

তারপর রয়েছে পানারিয়া দ্বীপ, এটা অন্যান্য ছোট দ্বীপগুলোর মধ্যে একটি, বর্তমানে দ্বীপটি মূলত উত্তম-তুর্কি উত্তরাঞ্চলীয় ইতালিবাসী দ্বারা জনবহুল, যারা উচ্চ মৌসুমে তাদের বিলাসবহুল ইয়ট (একটু বড় ধরনের বোট) দিয়ে ছোট ছোট বন্দরটি পূরণ করে। খুব সুন্দর একটি দ্বীপ, পাশাপাশি স্ট্রোম্বোলি গাড়িযুক্ত এবং চারদিকে ঘোরাঘুরি করার জন্য ভালো ব্যবস্থা রয়েছে।

দক্ষিণে স্ফটিক স্বচ্ছ জলের সঙ্গে একটি সুন্দর বালুকাময় সৈকত। সৈকত পেরিয়ে সমুদ্র-আবদ্ধ মালভূমিতে আরোহণ গরম সমুদ্রের পানির সঙ্গে মিশে যাওয়া ছিল অন্যতম অনুভূতি। দ্রুত বা ধীরগতির ফেরি দিয়ে দ্বীপপুঞ্জের চারপাশ দেখা এবং সবচেয়ে দূরবর্তী দ্বীপপুঞ্জ ফিলিপুডি এবং আলিকুডিতেও ঘুরে বেড়ানো ছিল দিনের বাকি অংশবিশেষ। পরের দিন এলাম দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে লীলা দ্বীপ সালিনা। উর্বর মাটি যা আঙুর উৎপাদনের জন্য খুবই উপযুক্ত, দ্বীপের সুস্বাদু মিষ্টি ওয়াইন তৈরি হয় এখানে। দ্বীপের অন্যান্য গ্রামের মতো এখানেও বাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে, যা সান্তা মেরিনার বন্দর থেকে ছেড়ে যায়।

সালিনা ছেড়ে এলাম বৃহত্তম দ্বীপ লিপারিতে। এ দ্বীপে ইতিহাস–ঐতিহ্যসহ নানা ধরনের চমকপ্রদ ঘটনা দেখার মতো। আগ্নেয়গিরি লিপাড়ির ঠিক দক্ষিণে পোর্টো ডি লেভান্ত বন্দরের সঙ্গে রয়েছে ভলকানো দ্বীপ। এখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সালফারের গন্ধ পেলাম। পরে পশ্চিম দিকে সূক্ষ্ম দানাদার কালো বালুর সৈকতে নেমে সাঁতার করতে শুরু করলাম, যা ছিল উপভোগ করার মতো।

ভ্রমণের শেষের আগের দিন হারবারের বিখ্যাত কাদা গোসল হবে। সে আবার কী? এ এক বিশাল ঘটনা। সাগরের মাঝখানে টগবগ করে গরম কাদার ঢেউ বইছে। এই কাদায় গোসল করা মানে যার ত্বকে সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, পেশিব্যথা, ফাইব্রোমায়ালজিয়া, বাত ও আরও অনেক সমস্যা রয়েছে, সেসবের সমাধান করতে সহায়তা করে বলে মনে করা হয়। প্রায় ২০ মিনিট উষ্ণ রেশমি কাদার মধ্যে পড়ে থাকা ছিল দিনের সবচেয়ে মজার সময়। কাদা সারা শরীরে এমনভাবে লেগেছে চেনার কোনো উপায় নেই। হঠাৎ এক মেয়ে খুব কাছে বসে মনের আনন্দে গুন গুন করে গান গাইছে। বুঝলাম না, ইতালিয়ান ভাষা, তবে ‘তে আমো’ কথাটি বুঝেছি। আমি তো অবাক প্রেমের বাইনা কাদার মধ্যে? এদিকে গরম কাদায় ডুবে আছি, মনে মনে ভাবছি মেয়েটি যে আমাকে বেশ জড়িয়ে ধরে বসে আছে, আমি তো তার বয়ফ্রেন্ড না! কথা না বলে চুপচাপ মুহূর্তটিকে উপভোগ করতে লাগলাম। হঠাৎ কাদা নিচের দিকে টেনে নিতে শুরু করল। ডুবে যাওয়ার অবস্থা, কী বিপদ? সাগরের মাঝখানে কাদার মেলা যা নিচের দিকে আমাদের টেনে নিতে শুরু করতে লাগল। তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলাম সমুদ্রে ডুবোতে। টগবগ কাদার মধ্যে কিছুক্ষণ রোমান্টিক সময় কেটেছিল বটে, তবে সাগরে ডুবোতে গিয়ে বেশ হাসির বিষয় হয়েছিল যখন একে অপরকে দেখলাম।

মজার আরেকটি ব্যাপার, সেটা ছিল সাগরে যখন গোসল করি, দেখি পানি টগবগ করে ফুটছে সাগরের মধ্যে, জুতা পায় ছিল তাই সমস্যা হয়নি, নইলে পা পুড়ে যেত পানির মধ্যে, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। কাদায় গোসল করার মধ্যে মজাই আলাদা, যা যে জীবনে না করেছে তাকে বোঝানো যাবে বলে মনে হয় না। সারা দিন অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। দিন শেষে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল আমরা একসঙ্গে ডিনার করব কি না? আমি উত্তরে বললাম, ঠিক আছে, তবে জানা হলো না তুমি কে? একটু মুচকি হেসে প্রথমে বলল, অনামিকা (নো নোমে)। রসিকতা এবং ভাবভঙ্গির সঙ্গে পরে বলল, ইঙ্গ্রিড বার্গম্যান। আমি বাংলাদেশি হলেও সুইডেন থেকে এসেছি, ফলে তার অজানা নয় সেই রবার্তো রোজেলিনির টেরা দি ডিও চলচ্চিত্র, যেখানে সুইডেনের হলিউড তারকা ইঙ্গ্রিড বার্গম্যানের সঙ্গে রবার্তো রোজেলিনির রোমান্সের কথা। বুঝলাম সেই কারণেই একটু তামাশার ছলে ইঙ্গ্রিড বলেছে। তার সঠিক নামটি জানলাম, ফ্লোরা। সাগরের ধারে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেলাম। বলল, কী খেতে চাই, উত্তরে বললাম, পিৎজা খাব। অর্ডার দিল পিৎজা। মেনুতে যা আছে সেটাই আশা করা স্বাভাবিক। পিৎজা যখন এল দেখি যা যা থাকার কথা তার অর্ধেকই নেই।
জিঙ্গেস করলাম ব্যাপার কী? উত্তরে বলেল, সিসিলিতে যদি কিছু না থাকে তখন শত চেষ্টা করলেও পাওয়া সম্ভব নয়। আমি বললাম, তাহলে দামের ক্ষেত্রে কী হবে? বলেল, সিসিলিতে দাম ঠিকমতো পে করতে হয়। বিষয়টি আমিই নাকি প্রথম মেনে নিতে পারিনি, যা রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ ফ্লোরাকে বলেছিল এবং এ–ও বলেছিল যে আমার হেরিটেজ নিশ্চিত সিসিলির আদিবাসী হবে। যাহোক, ডিনার শেষে প্ল্যান করলাম ভ্রমণের শেষের দিন কী করা যায় তা নিয়ে। ফ্লোরা বলল, পরের দিন সকালে আমরা ক্রেটার রিমে যাব।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বের হয়ে পড়লাম ক্রেটার রিমের উদ্দেশে। ফ্লোরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে। এই আগ্নেয়গিরিটি মাত্র ৩৯১ মিটার উঁচুতে, নুড়ি পাথরের কুচিতে ভরা, তার ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে উঁচুতে হেঁটে যেতে শরীরে ঘাম ছুটে গেল এবং সেই উঁচুতে উঠতে কেটে গেল পুরো এক ঘণ্টা। মাথার ঘাম পায়ে পড়ে পেলে যখন হাজির হলাম ওপরে। লিপারি এবং সালিনার মনোরম দুর্দান্ত দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলাম এবং গর্তের উত্তর প্রান্তে সালফারের ক্ষয়টি ঝরঝর করতে দেখা এক নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। এখানে বেশিক্ষণ হাঁটাহাটি করতে হলে মাস্ক থাকা উচিত এবং ভালো জুতা পায়ে থাকতে হবে, রাবারের জুতা চলবে না, গরমের কারণে জুতা গলে যাবে।

আইওলিয়ান দ্বীপপুঞ্জে মোট পাঁচ দিন ছিলাম। পুরো সিসিলি ঘুরে দেখা সেখানকার সবকিছু উপভোগ করা ছিল অবিরল। কাদার মধ্যে বসে থাকা এবং গোসল করা গরম পানিতে সাগরের মাঝে ফ্লোরার সঙ্গে এবং ডিনারে ইতালিয়ান পিৎজা খাবারের গল্প ছিল মনে রাখার মতো। সেদিনের ফেলে আসা দিনগুলো ফ্লোরার সঙ্গে কিছুটা সময়, সঙ্গে পেছনে শান্তি, শান্ত এবং নীরবতা রেখে চলে এসেছিলাম সুইডেনে। আজ এত বছর পর অনুভবে মনে মনে ফিরে এসেছে সেই স্বর্গরাজ্য, যা এখনো বিরাজিত অনুভূতিতে।

লেখক: রহমান মৃধা, প্রবাসী