ঝিনুকের মতো হাসিতে মুক্তা ফলায় প্রবাসী সৈনিকেরা

ঈদের আনন্দ আপামর মানুষের জন্য খুবই খুশির, অনিঃশেষ আনন্দের, নিঃসীম আহ্লাদের, এ আনন্দে রয়েছে আলাদা সুখানুভূতি, অনন্য আমেজ, বিশেষ করে তাঁদের জন্য, যাঁরা স্বদেশে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করেন বা পরিবার নিয়ে প্রবাসে থাকেন।

কিন্তু বিপরীতে যাঁরা পিতামাতা, ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়স্বজন ছাড়া দেশের বাইরে থাকেন, তাঁদের গল্পটা ভিন্ন, বড়ই নিরানন্দের। করোনাকালে প্রবাসীদের ঈদ আরও নিরানন্দের, অতলান্ত কষ্টের। অনেকের চাকরি নেই, কেউ কেউ স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দে শামিল হতে দেশে আসতে পারছে, কারও কারও বেতন অর্ধেক, কেউ দেশে ছুটিতে এসে দিগ্‌ভ্রান্ত। সচেতন মহলের সবাই জানি, একজন সাধারণ মানুষ ব্যথা সহ্য করেন সর্বোচ্চ ৪৫ ইউনিট গেল। অন্যদিকে একজন মা প্রসবব্যথা সহ্য করেন ৫৭ ইউনিট ডেল পর্যন্ত। সন্তান প্রসবের জন্য মায়েদের এ ত্যাগ-তিতিক্ষা অসহনীয়, অবর্ণনীয়। একজন মা ছাড়া এ ব্যথার অনুভূতি, প্যারামিটার সাধারণ মানুষ অনুধাবন করতে পারে না, পারবে না।

যেমনটি বলছিলাম, মায়েদের প্রসববেদনার কষ্টের উপাখ্যান একজন মা ছাড়া যেমন কেউ বোঝেন না, তেমনি একজন প্রবাসীর পরবাসের অনুভূতি কেমন হয়, যে কখনো প্রবাসে কঠোর শৃঙ্খল দেখেননি, তাঁর পক্ষে অনুধাবন বহু দূর। দেশে বসে সুন্দর সুন্দর গল্পের ইতি টানা যায়, দেশে বসে প্রবাসের অনুভূতি নেওয়া যায় না। কষ্টের, হৃদয় দহন অনুভব করা যায় না, প্রত্যেক প্রবাসীর রয়েছে অব্যক্ত, নীল কষ্ট। এ যেন সংগ্রামী জীবনযুদ্ধের একেকটি উপাখ্যান। প্রবাসীরা চাপা রাখেন নিজেদের কষ্ট। তাঁরা ছোট ছোট সুখ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। কষ্টগুলো হৃদয়ে পুঁতে দেন। ভবিষ্যৎ জীবন উজ্জ্বল করার আশায়, নিজের জীবনের ছন্দময়, বর্ণময়, আনন্দময় দিনগুলোকে কবর দেন তাঁরা।

চেইন অব কমান্ডের দেশ কোরিয়া। আজব এক ঈদানুভূতি রয়েছে আমার ও কোরিয়া প্রবাসীদের। আরব দেশগুলোতে ঈদের ছুটি থাকে কিন্তু কোরিয়ায় কোম্পানি থেকে ছুটি নেওয়া দুষ্কর। যদিও ইদানীং কিছু পরিবর্তন এসেছে। গত বছরের শেষের দিকে আমার কোরিয়ার প্রবাস জীবনের ইতি হয়। একটি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য চলে আসি জার্মানিতে। জার্মানিতে কয়েক মাস অবস্থান করে এবার ঈদ করতে দেশে আগমন। তবে জার্মানিতে ঈদের স্মৃতি না থাকলেও কোরিয়ার আছে ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা মিলে ২১টি ঈদের দিনলিপি।

ঈদের জন্য অনেকেই কোরিয়া বলুন বা অন্য দেশ বলুন, ঈদের ছুটি পাই না, ছুটির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মধ্যপ্রাচ্য। বলা বাহুল্য, ঈদের নামাজের জন্য অনেকেই কোম্পানি থেকে ছুটি পান না, অনেকেই সকালে ডিউটির আগে ঈদের নামাজ পড়েন, তবে করোনাকালে তা-ও সম্ভব না। দুই বছর ধরে সম্মিলিতভাবে ইফতার করতে পারিনি।

পরিবারের অনুভূতিই যেন তাঁদের অনুভূতি। এত কিছুর পরেও চলতি বছর প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণে রেকর্ড গড়েছেন। যেন ঠিক সময়ে পরিবারে ঈদের টাকা পাঠাতে পারলেই প্রবাসীদের হৃদয় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। ঈদে পরিবারের মুখে হাসি দেখলে এরা আনন্দে বিভোর হয়ে যান। ঈদের সারাটা দিন প্রবাসীর মনটা পড়ে থাকে পরিবারের কাছে। প্রবাসে প্রত্যক প্রবাসীর কর্মব্যস্ততার মধ্যেও মনটা থাকে দেশে।

সবকিছুর পরেই প্রবাসীদের জীবন চলে নিরন্তর। লক্ষ্যের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এ যোদ্ধারা। এ জীবনে যখন তাঁরা ব্যর্থতার তিক্ত স্বাদ পান, তখন চোখ বুজে সয়ে যায়। ঝিনুক নীরবে সহে, ঝিনুক নীরবে সহে যায়, হাসিতে মুক্তা ফলায়।