টিকা–আতঙ্ক

করোনার টিকা
ছবি: এএফপি

প্রাইমারির ছাত্র ছিলাম। ক্লাস ফোর পর্যন্ত অর্ধেক ভাগা গ্রামের স্কুলে আসা–যাওয়া করতাম। তখন স্কুল মাঠের এক কর্নারে বসে বয়স্ক এক চাচা ঝুরিভাজা বিক্রি করতেন, এক টাকায় কুড়িখানা ঝুরিভাজা পাওয়া যেত। টিফিনের সময় বিস্কুট আর গুঁড়া দুধ স্কুল থেকে ফ্রি পেতাম। বিলেতি দুধ বলতাম। সেখান থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে সবকিছু। এখন ছাত্রছাত্রীরা বই–খাতা টাকাপয়সা পাচ্ছে। মূলত মূল ভিত্তি সেখান থেকেই শুরু।

তখন হঠাৎ ডাক্তার কাকারা স্কুলে প্রবেশ করতেন। উদ্দেশ্য টিকা প্রয়োগ। হাম, যক্ষ্মা, টিটেনাস, পোলিও ইত্যাদি রোগের টিকা ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিয়ে আসতেন। ক্লাস চলছে, হঠাৎ হাজির টিকা কাকারা। তখন এত মোটরবাইক না থাকায় বাইসাইকেলে করে স্কুলে টিকা নিয়ে যেতেন। বাইসাইকেলের হ্যান্ডেলে দুই পাশে দুটি বক্সজাতীয় ব্যাগ নিয়ে ছুটতেন, এ–স্কুল থেকে ও–স্কুলে। সত্যি ওসব রোগ নির্মূলে তারা অনেক অবদান রেখেছেন, কতই–না পরিশ্রম করেছেন।

টিকা কাকারা যখন স্কুল বাউন্ডারিতে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রবেশ করতেন, তখন অনেকেই ভয়ে কেঁদে দিত। আমিও সেই দলের একজন। আস্ত একটা শরীরে সুই প্রবেশ করাবে, এটা মেনেই নিতে পারতাম না। ব্যথার চিন্তা করতে করতে টিকা না নিয়েই কী যে ব্যথা পেতাম, তা কল্পনার মধ্যেও পড়ে না।

একদিন অঙ্কা ক্লাস নিচ্ছেন আমাদের প্রিয় আনন্দ মোহন স্যার। ক্লাস থ্রি। কালো ব্ল্যাক বোর্ড দেয়ালের সঙ্গে ঝুলছে। সাদা চক দিয়ে অঙ্কের হিসাব চলছে। ১৫টা পাখি ডালে বসে ছিল, সেখান থেকে ৬টা পাখি একদিকে উড়ে গেল, এবং অন্যদিক থেকে ৯টা নতুন পাখি ডালে এসে বসল। মাহফুজ, তুমি বলো ওই ডালে এখন কয়টা পাখি আছে?
স্যারের আক্কেল দেখে আমার কম্ম সারা। চোখে আর কারও নজরে এল না, চায়না চশমার ফাঁক দিয়ে নজরে এলাম আমি! আমার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল, ক্লাসে বাইশটা ছাত্রছাত্রী। আর স্যার কিনা আমারে শুধাইল!

স্কুলের মাঠে একটা বটগাছ ছিল। খুব পুরোনো। আসলেই কি পাখি ডালে বসা আছে কি না, উড়ে গেছে কি না, নতুন পাখি এসে বসেছে কি না? নাকি, অঙ্কাটা ডাহা মিথ্যা, এমন প্রশ্নও মাথার মধ্যে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিল। মিছে অঙ্কের মিছে উত্তর দিলে সমস্যা কি? নিশ্চয় স্যারের মাইন্ড করার কথা না। এমন কত ভাবনার মধ্যে নিমজ্জিত ছিলাম।

কেউ কেউ বলত, যার কোনো কাম নেই, সেই শেখে অঙ্ক। আমার তো অনেক কাম ছিল। বন্ধুদের কাপড়ে চুরি করে ফোর টোয়েন্টি লিখে রাখা, ছিঁড়া জামা বা প্যান্ট টান দিয়ে আরেকটু ছিঁড়ে ফেলা, চিকন ইলাস্টিক দিয়ে কানে আঘাত করা, টয়লেটে গেলে বাইরে থেকে ছিটকানি মেরে দেওয়া, মাছি মেরে মেরে অন্যের বইয়ের পাতার মধ্যে গুঁজে রাখা, পথে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে লাথি মেরে ভিজিয়ে দেওয়া। এমন ইত্যাদি ইত্যাদি কত কাজেই না ব্যস্ত থাকতাম। কাজেই অঙ্ক শিখতে পারিনি।

ডালে কয়টা পাখি আছে, এর উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। নিয়ম অনুযায়ী স্থূলবুদ্ধিতে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। ক্লাসরুমে একটা দরজা, তিনটি জানালা। বাতাসে দরজা কুচকুচ করে আওয়াজ হওয়াতে অর্ধভাঙা ইটের টুকরা দিয়ে সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। আর জানালা তিনটা চিচিং ফাঁক, অর্থাৎ জানালাসুদ্ধ চুরি হয়ে গেছে, রড-কাঠ কিছু নেই। এ জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছে আরেক জানালা দিয়ে বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।

অঙ্কের উত্তর দেব দেব করছি, আর এই মুহূর্তে চোখ গেল স্কুল মাঠে। দেখি সাইকেল চালিয়ে টিকা কাকারা আসছেন স্কুলে। টিকা নিতে ভীষণ ভয় পেতাম। আমার মতো ভয় স্কুলের আরও ছাত্রছাত্রীদের ছিল। এবং এ দলের সংখ্যা ভারী ছিল বেশ। এখনকার ভ্যাকসিন দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষেত্রে আর তখনকার ভ্যাকসিন দেওয়া বা নেওয়ার ধরন বা পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। তখন একটা সুচ, অপেক্ষাকৃতভাবে একটু মোটা। সুচটা আগুনে হিট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হতো। তারপর তাতে মেডিসিন লাগিয়ে ডানায় ধীরে ধীরে কুপিয়ে একটা মোচড় দেওয়া হতো। এতে ভয় ছিল আমার। যমের মতো ভয়বিহ্বল।

টিকা কাকাদের আসা দেখামাত্র একটা চিৎকার দিয়ে জানালা দিয়ে জাম্প দিয়ে পাটের খেত ডিঙিয়ে অন্য গ্রামে গিয়ে উঠলাম। আমার দেখাদেখি ক্লাসের বিজয়, সেন্টু, রেহান, অজয়, হাসি, চুমকি, রুবিয়া, আজাদসহ প্রায় সবাই জানালা দিয়ে পগারপার।
আমি যখন দৌড়াচ্ছিলাম তখন একটা সত্য অঙ্ক আবিষ্কার করি। পাখির অঙ্কটা ডাহা মিথ্যা ছিল। কারণ, স্কুলের বটগাছের ডালে কোনো পাখিই ছিল না। আর আমার অঙ্কটা ছিল: একটা ক্লাসে ২২ জন ছাত্রছাত্রী ছিল। টিকা কাকাকে দেখে টিকা নেওয়ার ভয়ে জানালা দিয়ে ১৮ জন ছাত্রছাত্রী ক্লাস পলায়ন করল। টিকা দেওয়ার জন্য অন্যান্য ক্লাস থাকে আরও ১৬ জন ছাত্রছাত্রী একত্র করা হলো। এখন ওই ক্লাসে কতজন ছাত্রছাত্রী আছে?

শুধু যে ক্লাস থ্রির ছাত্রছাত্রী টিকা নেওয়ার ভয়ে পালিয়েছিলাম, তা কিন্তু নয়। ফোর ও ফাইভ থেকেও গায়েব হয়ে গেছিল প্রায় সব ছাত্রছাত্রী। অল্প কিছু ছাত্রছাত্রী ছিল যারা হয়তো কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্যারদের হাতে আটক হয়ে গেছিল।

জানালা দিয়ে বের হয়ে সবাই পশ্চিম দিকে দৌড় দিলাম। আমি প্রথম সেদিকে দৌড় দিই। আমার দেখাদেখি বাকি সবাই আমার পিছু নেয়। সবার আগে আমি ছিলাম। সবাই যখন আমার পিছু দৌড়াচ্ছে, তখন আমার ধারণা হলো যে আমার গ্রেপ্তার করার জন্য স্যার ওদের লেলিয়ে দিয়েছেন। এ ভেবে আমি দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। অবশেষে একটা চিকনচাকন খাল পার হতে গিয়ে চালকুমড়ার মতো গড়াইয়া গড়াইয়া কাদা মিশ্র পানিতে মিশে গেলাম। সেখান থেকে বন্ধুরা টেনে তোলে আমাকে।

বন্ধু অজয়। এক ক্লাসে পড়ি। বুদ্ধিশুদ্ধি ভালো, আমার মতো বেফায়দা ছাত্র ছিল না, ভালো ছাত্র সে। টিকা নেওয়ার ভয়ে যারা স্কুল থেকে চম্পট দিলাম, তাদের সবাই পশ্চিম দিকে দৌড় দিলাম। কিন্তু একমাত্র এই অজয় দৌড় দিল দক্ষিণ দিকে। সেদিকে কয়েকটি বাড়িঘর ছিল। ওদিকে একটা কুকুর ছিল, অজয়ের জানা ছিল তা। কিন্তু তখন হিসাব মেলাতে পারেনি। মাথার মধ্যে হয়তো ডালের পাখি খোঁচাখোঁচি করছিল। দৌড় দেওয়া মানুষের একদম অপছন্দ কুকুরের। কুকুরের নাপছন্দ হওয়ায় কামড় থেকে বাঁচতে পারেনি অজয়। তিন–চারটি কামড় খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি পৌঁছায়। একটা টিকার হাত থেকে বাঁচতে কয়েকটি ইনজেকশন নিতে হয়েছিল তাকে।

টিকা কাকারা সেদিন জুত করতে না পরে স্যারদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে আরেক দিন আসার দিনক্ষণ ঠিক করেন। এবং সেদিন ঠিক গোপনে আসবেন। জানালাগুলো ধীরে ধীরে আলগা ইট দ্বারা অর্ধাংশ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

দুই সপ্তাহ পর সোমবারে স্কুল সময়ের আগেই এদিন টিকা কাকারা এসে লাইব্রেরিতে চুপচাপ বসে আছেন। ক্লাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একযোগে সব কটি ক্লাসে প্রবেশ করলেন তাঁরা। সেদিন আর কোনো অবস্থাতেই পলায়নের সুযোগ ছিল না, তাদের দেখামাত্র পিলে চমকে ওঠে। স্যার প্রশ্ন করলেন, কে আগে নেবে? ভাবলাম মরছি যখন, তখন বদ্যের বড়ি খেয়েই মরি। উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি।

এরপর আর কোনো দিন আমার শরীরে সুচ লাগেনি। করোনা মহামারিতে যখন বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা করোনা ভ্যাকসিন বা টিকা বানাতে ব্যস্ত, তখন আমি ভয়ে ভয়ে দিন পার করি। মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম, ভ্যাকসিন যেন না আসে, ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট আসুক। কিন্তু অবশেষে আমার চাহিদাকে পদাঘাত করে জয়লাভ করল সেই ভ্যাকসিন।

কেপটাউন, এখানে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। টিকাকেন্দ্রে শৃঙ্খলার সঙ্গে জনতার ভিড়। দিন দিন টিকা নেওয়ার মানুষ বেড়ে যাচ্ছে। ক্যাপসুলের খবর নেই, আশার বাণীও শুনি না। আর লুকাতে পারলাম না। রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম। দোকানে এক ম্যাডাম আসেন নিয়মিত কাস্টমার সূত্রে। তিনি আলেকজান্ডার হাসপাতালে চাকরি করেন। তাঁকে আমার টিকা–আতঙ্কের কথা খুলে বললাম। তিনি হেসেই কুটিকুটি। পরক্ষণেই আমাকে নির্ভয় দিলেন। এমন সাহস দিতে লাগলেন যেন আমি পাহাড় হয়ে গেছি। টিকার সুচ কেন, কুড়াল মারলেও পাহাড়ের কিচ্ছু হবে না।

আমার টিকা–আতঙ্কের কথা তিনি নিজের ভেতরেই রাখেননি। হাসপাতালের নার্সদের কাছে রসিয়ে রসিয়ে রস বিলিয়েছেন।

তারিখ ঠিক হলো। ওই ম্যাডামের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। নিয়মের সিঁড়ি ডিঙিয়ে নার্সের কাছে পৌঁছে গেলাম। নার্স আমাকে দেখে হেসে দিলেন। আরও কয়েকজন নার্স আমাকে উঁকি মেরে দেখে গেলেন।

যিনি আমাকে টিকা দেবেন, তিনি একটার পর একটা প্রশ্ন করতে লাগলেন। প্রশ্নের তালে তালে টিকা দেওয়ার জন্য ডানা বানিয়ে নিচ্ছেন। সাহস দিচ্ছেন। আমার কাছ থেকে উত্তর নিচ্ছেন। কথায় কথায় কখন যে টিকা পুশ করেছেন, আমি তা বুঝতেও পারিনি।

টিকা দেওয়া শেষ করে নার্স আমাকে যা বললেন, ‘আমি শুনেছি তুমি টিকা নিতে ভয় পাও। তোমার স্কুলজীবনের ঘটনাটাও শুনেছি। আর কখনো ভয় পাবে না। শুধু মনে রাখবে: একটা চকলেট খুলে খেতে যত কষ্ট, একটা টিকা নেওয়া তার চেয়ে কম কষ্ট।’

* লেখক: মাহফুজার রহমান, কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা