ডাকাত পরিবারে বিয়ে–শেষ পর্ব

ছবিটি প্রতীকী
ছবি: কবির হোসেন

গত দুই দিন আগে আমি বউয়ের ভয়ে পালিয়ে কক্সবাজার চলে এসেছি। গতকাল ঢাকায় আমার বউভাত হওয়ার কথা ছিল। অনুষ্ঠানটি হয়েছে কি না, তা–ও আমি জানি না। কারণ, আমার সঙ্গে ঢাকার কারও কোনো যোগাযোগ নেই। কেউ যেন আমাকে ট্রেস করতে না পারে, সে কারণে এখানে এসেই আমি ফোনের সিম খুলে ফেলেছি। মা ছাড়া আর কেউ জানে না আমি এখন কোথায় আছি।

নির্ধারিত দিনের দুই দিন আগে চলে আসায় প্রথমে আমি একটি সাধারণ হোটেলে উঠেছিলাম। আজ দুপুরের দিকে আমি আমার হানিমুনের জন্য বুক করা নির্দিষ্ট রিসোর্টে উঠেছি।
রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ পুরো রুম সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। বিছানার ওপর গোলাপের পাপড়ি ছিটানো। আর ফুল দিয়ে সেখানে লেখা ‘জাস্ট ম্যারেড’। লেখাটা দেখে কেন জানি বুক থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।

ঢাকা থেকে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছিলাম। গতকাল কক্সবাজার বার্মিজ মার্কেট থেকে দুটি বার্মিজ লুঙ্গি আর কিছু শামুক, ঝিনুকের মালা কিনেছি। ঠিক করেছি লুঙ্গি পরে, শামুক-ঝিনুকের মালা গলায় দিয়ে বাউলের মতো সেজে সৈকতে ঘুরব। যে কয়েক দিন এখানে থাকি, বাউলদের মতো জীবন অতিবাহিত করব। হানিমুনের যেহেতু পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাই বুঝতে পারছি না হানিমুন কতটা মজার হয়। তবে একা একা হানিমুনটা খুব একটা খারাপ লাগছে না।

বিকেল বেলা বাউল সাজে বের হলাম। সাজটা খারাপ হয়নি, তবে হাতে একটা একতারা থাকলে ভালো হতো। অনেক রাত পর্যন্ত সৈকতে আর পথে পথে ঘুরলাম। রিসোর্টে যখন ফিরলাম, তখন রাত প্রায় ১১টা। রুমে ঢুকেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাবলাম কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে একটু বিশ্রাম নিই। এরপর উঠে গোসল করব। শুয়ে পড়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ পেলাম। দ্রুত চোখ খুললাম। দেখলাম কুংফু গার্ল কনা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছে। মাথায় সুন্দর করে তোয়ালে পেঁচানো। সম্ভবত সে এতক্ষণ বাথরুমে গোসল করছিল। আমি তাকে দেখেই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড় দিলাম। দরজার লক খোলার জন্য হাত বাড়াতেই কনা ধমকের সুরে বলল,
দরজা খুললে একেবারে খুন করে ফেলব। পাগলামি অনেক করেছ আর না। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসো।

আমি মলিন মুখ করে ধীর ধীরে বিছানায় গিয়ে বসলাম। কনা এসে আমার সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসল। মানুষের কাছ থেকে শুনেছি মেয়েরা গোসল করে আসার পর শরীর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু গন্ধটা যে এতটা মিষ্টি, সেটা আমার জানা ছিল না। কনা সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম সুরে প্রশ্ন করল,
আমি এখন তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব। প্রতিটা প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেবে। ঠিক আছে?
জি, ঠিক আছে।
তোমার সমস্যা কী?
আমার তো কোনো সমস্যা নেই।
অবশ্যই সমস্যা আছে। না হলে বারবার পালাচ্ছ কেন?
ভয়ে পালাচ্ছি।
কিসের ভয়ে?
জীবনের ভয়ে।
মানে কী! এসব কী উল্টাপাল্টা বলছ!
আমি উল্টাপাল্টা বলছি না। বিয়ের দিন রাতে আপনার ভাবি বললেন, উনি আর উনার স্বামী দা-বঁটি নিয়ে বাইরে বসে থাকবেন। এ কথা শোনার পর শুধু আমি কেন, সিনেমার ভিলেন মিশা সওদাগরও ভয় পাবে।

আরে ভাবি তো তোমার সঙ্গে একটু মজা করেছে। তুমি কি ফানটাও বুঝবে না? শোনো, এই দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে আমি বেঁচে থাকতে আমার স্বামীর গায়ে হাত দেয়।
অন্য কারও হাত দেওয়ার দরকার কী? আমাকে মারার জন্য আপনিই তো যথেষ্ট।
এ কথা কেন বললে?
কারণ, আমি দেখেছি আপনি বালিশের নিচে হাতুড়ি লুকিয়ে রেখেছেন। এ হাতুড়ি কার জন্য রেখেছেন? অবশ্যই আমার জন্য।

মাই গড তুমি ওই হাতুড়ি দেখে পালিয়েছ? তোমার ধারণা ওটা আমি তোমাকে মারার জন্য রেখেছি? শোনো, ছোটবেলা থেকে আমি তেলাপোকা আর টিকটিকি প্রচণ্ড ভয় পাই। সে কারণে সেই ছোটবেলা থেকেই সব সময় ওই হাতুড়ি আমার বালিশের নিচে থাকে।

আরও পড়ুন

তেলাপোকার জন্য হাতুড়ি রাখতে হবে কেন? আপনি তো মার্শাল আর্ট জানেন।
তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি টিকটিকি আর তেলাপোকার সঙ্গে কুংফু করব?
সেটা অবশ্য ঠিক। তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন ওই হাতুড়ি আমার ওপর ব্যবহারের জন্য রাখেননি?
অবশ্যই না। তবে এই দুই দিন তুমি যেসব কাণ্ড ঘটিয়েছ, তাতে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে ওটা তোমার ওপরও ব্যবহার করতে হতে পারে।
আমি আবার কী করলাম?

প্রথমে বাসরঘর থেকে পালালে। এরপর তোমার বাড়িতে আমাকে একা রেখে পালালে। তোমার এবং আমার দুই পরিবারের সামনে আমাকে হাসির পাত্র বানালে। তারপরও বলছ আমি কী করলাম?
এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। আচ্ছা, আমি যে এখানে এসেছি, এটা আপনি জানলেন কীভাবে? এটা তো মা ছাড়া কেউ জানে না। মা আবার রিসোর্টের ঠিকানা জানে না। তাহলে আপনি এখানে এলেন কীভাবে?

মা–ই আমাকে বলেছেন। তবে রিসোর্টের ঠিকানা পেয়েছি তোমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে। সেদিন তুমি পালানোর পরপরই মা বললেন তুমি কক্সবাজারে পালিয়ে যাচ্ছ। তখনই তোমার পেছনে পেছনে রওনা দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি তো তোমার মতো দায়িত্বহীন নই। তাই বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে এসেছি। মামা আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন। আমি আনিনি। তুমি জানো, গতকাল কমিউনিটি সেন্টারে বউভাতের অনুষ্ঠানে সবাই তোমাকে খুঁজছিল।

তা সবাইকে কী বললেন?
কী আর বলব? সত্য তো আর বলতে পারব না। তাই মায়ের সঙ্গে যুক্তি করে সবাইকে বলেছি, তোমার করোনা পজিটিভ হয়েছে। তুমি কোয়ারেন্টিনে আছ। এভাবে পরিবারের সবাইকে বিব্রত না করলেও পারতে।
সরি।
তুমি সরি বলছ কেন? তোমার চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না তুমি সরি। আমি জানি, তুমি সুযোগ পেলে আবার পালাবে। কে জানে, হয়তো এখনো মনে মনে পালানোর প্ল্যান করছ।

আরও পড়ুন

বলেই কনা খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই কনা তার ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়ানো ছোট একটি প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিল।
এটা কী?
তোমার ঘটক তোমার জন্য এই গিফটটি পাঠিয়েছেন। বউভাতের অনুষ্ঠানে প্যাকেটটি গোপনে আমার হাতে দিয়ে বললেন তোমাকে দিতে। খুব নাকি জরুরি জিনিস।
মাই গড, এই বেটা তো আসলেই একটা বদমাশ, একটা খচ্চর।

ছি, তুমি মুখ খারাপ করছ কেন? একজন মানুষ ভালোবেসে তোমাকে একটা গিফট দিল, আর তুমি তাকে গালমন্দ করছ?
করছি, তার কারণ আছে। আপনি জানেন এর মধ্যে কি আছে?
অবশ্যই জানি। হারবাল ওষুধ। তোমার নাকি শারীরিক দুর্বলতা আছে? উনি বলেছেন প্রতিদিন তিন বেলা মধু দিয়ে খেতে। তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।

মাই গড, ওই বেটা এগুলো আপনাকে বলেছে!
না আমাকে বলেনি। ওই প্যাকেটের সঙ্গে একটি চিঠি ছিল। কীভাবে খেতে হবে সেখানে লেখা ছিল। সরি, সেটা আমি খুলে পড়েছি।

বেটা একটা ফাজিল। শোনেন, আমি ওই দিন রাতে বাসস্টেশনে বসে ওই বেটারে ফোন দিছিলাম। আমি বাসস্টেশনে বসে আছি বলতেই বলল, ভাইজান, বাসররাতে আপনি ঘরের বাইরে? তার মানে আপনার শারীরিক দুর্বলতা আছে, হারবাল ওষুধ খান। বেটার ধারণা, আমি শারীরিক দুর্বলতার কারণে বাসরঘর থেকে পালিয়েছি।

তুমি শুধু উনাকে দোষ দিচ্ছ কেন? আমারও তো একই ধারণা।
বলেই কনা উচ্চ স্বরে হাসতে লাগল।
সিরিয়াসলি! আপনিও ওই বেটার মতো মজা নিচ্ছেন? আপনি হাসছেন?
সরি, আর হাসব না। আচ্ছা, তুমি দেখি এখনো আমাকে আপনি করে বলছ?
ঠিক আছে আর বলব না। আচ্ছা, আমি কি এখন একটু বাথরুমে যেতে পারি?
প্রশ্নই আসে না। তোমাকে বাথরুমে একা পাঠানোর রিস্ক আমি আর নিচ্ছি না। তোমার কোনো বিশ্বাস নাই।

দেখুন, আমার সারাটা শরীর ঘামে ভিজে আছে। আমাকে গোসল করতে হবে।
তুমি গোসল কর আর যাই করো, একা বাথরুমে যেতে পারবে না। যদি যেতে হয়, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

তুমি আমার সঙ্গে যাবে মানে!
তোমার সঙ্গে যাব মানে তোমার সঙ্গে যাব। প্রয়োজনে আমিও তোমার সঙ্গে গোসল করব।

ছবি: প্রথম আলো

ছি ছি, এটা তুমি কী বলছ? তুমি তো এখন নির্লজ্জের মতো কথা বলছ।
শোনো, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কমপক্ষে একজনকে একটু নির্লজ্জ হতে হয়। তা না হলে সমস্যা। তোমার তো লজ্জা বেশি। এখন আমিও যদি তোমার মতো লজ্জা পাই, তাহলে তো সমস্যা। এভাবে তো আমি জীবনেও মা হতে পারব না। কিন্তু আমাকে তো এ জীবনে অনেকগুলো বাচ্চার মা হতে হবে।

তুমি কী বলছ এসব!
শোনো, এত বুঝতে হবে না। তার চেয়ে চলো এখন দুজনে গোসল করি।
কিন্তু আপনি তো এইমাত্র গোসল করে বের হলেন!
সেটা কোনো সমস্যা না। তোমার সঙ্গে আমি আবার গোসল করব। আচ্ছা শোনো, গোসলে যাওয়ার আগে ঘটকের পাঠানো হারবাল ওষুধের এক ডোজ কি খেয়ে নেবে? আমি কিন্তু সঙ্গে করে মধু নিয়ে এসেছি। চাইলে খেতে পারো।

বলেই কনা খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি অবাক হয়ে এই পাগলি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? শোনো, এভাবে তাকিয়ে থেকে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এমনিতে তুমি আমার চার দিন সময় নষ্ট করেছ। এখন বোকার মতো এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে চলো।

বলেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। আমি মনে মনে বললাম, হে মাবুদ, এই ডাকাত বউয়ের হাত থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কইরো।
বি. দ্রষ্টব্য:
স্বামী বা স্ত্রী দুজনের একজন একটু পাগলাটে হওয়া ভালো। কারণ, ছোটখাটো পাগলামি সংসারজীবনকে অনেক মধুর করে তোলে।
(সমাপ্ত)

*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]