তপ্ত মরুর দেশের তিন বছরের সুপ্ত কথা

১৯৯২ সালের ১৪ অক্টোবর। বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা উড়ে পৌঁছাল সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি শেখ জায়েদ বিন আল নাহিয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ১৮৩ জন যাত্রীর মধ্যে আমিও একজন। স্বপ্নে বিনা ভিসায়, বিনা টিকিটে, নিরাপত্তা–তল্লাশি ছাড়া অনেকবার আকাশে উড়েছি, কিন্তু বাস্তবে এটাই প্রথম আকাশভ্রমণ। বড় ভাই মরহুম এম এ সাত্তার খান বিমানের সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা থেকে বিমানের পাইলট ও বিমানসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে সেবার মানটা আমার জন্য বেশ আপগ্রেড ছিল।

আবুধাবির স্থানীয় সময় বিকেল চারটায় নামলাম। ইমিগ্রেশন থেকে বের হওয়ার পর মনে হলো, আগুনের ফুলকি গায়ে লাগছে, এতটাই গরম আবহাওয়া, ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা। অপেক্ষায় ছিলেন সেজ ভাই এম এ কুদ্দুস খান। তিনিই আমার কর্মস্থল টেইলস রিয়েল এস্টেটের মালিক। ট্যাক্সিতে করে বাসায়, মানে মেসে গেলাম। একটি দশতলা ভবনের দ্বিতীয় তলার তিন রুমের বাসায় ছয়জন থাকেন, আমিসহ সাতজন। ভাইয়ের রুমমেট ছিলেন পাকিস্তানের শিয়ালকোটের। আবুধাবি আর্মির সৈনিক।

খাওয়াদাওয়ার পর ভাই অফিসে নিয়ে গেলেন। সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন ও লোকাল স্পনসর আল হামাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বলা বাহুল্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিদেশি কোনো নাগরিক যদি তখন ব্যবসা করতে চাইতেন, তাহলে স্থানীয় কোনো নাগরিকের সঙ্গে ৪৯ শতাংশ ও ৫১ শতাংশ পার্টনারশিপের মাধ্যমে ব্যবসা করতে হতো। স্থানীয় নাগরিকের ৫১ শতাংশ পার্টনারশিপের জন্য তিনি কোনো মূলধন খাটাতেন না, বরং তাঁকে মাসে মাসে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিতে হতো। তবে ব্যবসার জন্য কোনো কর দিতে হতো না। আমাদের কাজ ছিল বাড়ি ভাড়া নিয়ে আবার ভাড়া দেওয়া এবং বাড়ি বা দোকানপাট ও জমি কেনাবেচার মধ্যস্থতা করা, মানে দালাল। ১৮ জন কর্মচারী কাজ করতেন।

আমি ছিলাম অফিসের দ্বিতীয় বস। সেই সুবাদে অফিসের সেক্রেটারি মিসরের মেয়ে আমেলকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সে বলল, আমি গরিব দেশের মানুষ, তাই প্রেমিক হওয়ার যোগ্য নই। আমাদের অফিসের সে কর্মচারী, এটা কোনো ব্যাপার না।
অফিস ছিল সকাল আটটা থেকে বেলা একটা ও বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। ভাই চাইতেন, যেহেতু নিজেদের ব্যবসা, তাই অফিস আওয়ার ছাড়াও অফিসের কাজ করি। কিন্তু অফিস আওয়ার শেষ হলে আমাকে পেতেন না।

আমি বাংলাদেশ খবর গ্রুপের আমিরাত ব্যুরোপ্রধান হিসেবে বিনা বেতনের সাংবাদিকতা শুরু করি। তা ছাড়া আবুধাবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করি। অফিসে মন না বসার কারণ ছিল মাস শেষ হলে বেতন দিত না ভাই। পকেটখরচ দিত এবং তার নিজের জন্য যা কিনতেন, আমাকেও কিনে দিতেন। দেশে জমি কিনলেও দুজনের নামে কিনতেন এবং দেশে যাওয়ার বিমানের টিকিটসহ সব দিতেন। আমার রাজনীতি করা ছিল তাঁর খুব অপছন্দ। তখন আবুধাবিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন জিয়াউস সামস চৌধুরী। তিনি আমার সাংবাদিকতায় সহযোগিতা করেছেন। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে লিখলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চাকরি চলে যায়। আবুধাবিতে পতিতাবৃত্তির ওপর প্রতিবেদন করে তো বিপদেই পড়েছিলাম। কারণ, আমাদের দেশের একজন সাংবাদিক সেই লেখা আরবিতে অনুবাদ করে সেখানকার পুলিশকে দেয়। পুলিশ আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। মুচলেকা দিই যে আর এ ধরনের লিখব না। তারপর ছেড়ে দেয়। পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেন, ৯০ শতাংশ বিদেশি পুরুষ, যাঁরা আবুধাবিতে কাজ করেন বা থাকেন, তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক। আবার অনেকে বিবাহিত, তবে স্ত্রী দেশে। তাই তাঁরা যৌনপেশাকে ওভারলুক করেন। তা ছাড়া বিদেশিরা যদি এ সুযোগ না পান, তবে তাঁরা স্থানীয় মেয়েদের নিরাপত্তার হুমকি হতে পারেন। তাই জানাজানি না হলে তাঁরা যৌনপেশাকে ওভারলুক করেন। আবুধাবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আমার বন্ধু জাহাঙ্গীর চৌধুরী ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা ফজলুল হক আমাকে ছাড়িয়ে আনেন। অন্যদিকে, নির্মাণ ঠিকাদার কোম্পানির দুর্নীতি নিয়ে লেখার কারণে কমিউনিটি পুরস্কার লাভ করি। আবুধাবি রেডিওর বাংলা বিভাগে কাজ করতেন রফিক সিকদার ও কাদের সিদ্দিকীর ছোট বোন সেলিনা সিদ্দিকী ও বুলবুল মহলানবীশ। তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করার সুযোগ হয়েছে।

সব মিলিয়ে অফিস আর ঠিকমতো করা হয় না। সেজ ভাই ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপের ভিসা লাগিয়ে, গালফ এয়ারের টিকিট ও দুই হাজার ডলার হাতে দিয়ে বলল, যাও ভাই ইউরোপ, এই মরুভূমি তোমার জন্য নয়। এবার নিজেরটা নিজে করে খাও। সেই থেকে করে খাচ্ছি।