তুমি
‘জীবনকে একটা আশীর্বাদের মতো বহন করতে শেখো—সকালে ঝোলা হাতে বাইরে যাবা, সারা দিন পথে পথে হাঁইটা যা পাবা তা ঝোলার ভিতরে ভইরা বাসায় আইসা পরবা।’—কথাগুলো বলতেন এই জীবনে দেখা অন্যতম সেরা দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম স্যার। শ্যামিল ডেরায় কলি চাচি পাশের ছোট রান্নাঘরের মতো জায়গায় নামাজ পড়ছেন, টুকটাক রান্না করছেন, এদিকে স্যার একটা চৌকির কাছে টুল লাগিয়ে প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশোর অনুবাদ করছেন। এই তো মাত্র ১৯৯৬-৯৭-এর কথা। ঠিক ওই একই সময়ে আমি আর নাইয়ার বাবা ঢাকা শহরের অন্তত আরও ৩-৪ জন বিখ্যাত শিক্ষক এবং সেরা বুদ্ধিজীবীদের একদম অন্দর মহলে যাওয়া-আসা করতাম। কিন্তু আর কারও কথা তেমন করে মনে আসে না, যতটা আসে সরদার স্যারের কথা।
কেন এত মনে আসে সরদার স্যারকে? মনে মনে বহুবার এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। কয়েকটা কারণের ভেতরে সবচেয়ে বেশি যে কারণটা মনে আসে তা হলো স্যার জীবনের প্রতি নির্মোহ ছিলেন, একদম নির্লোভ ছিলেন, শিশুর মতো একটা মন ছিল স্যারের, সেটা কি অর্জন করা ব্যক্তি মানুষের জন্য খুব সহজ?
কথাগুলো বলছি কেন?
শনিবার সকাল। দেহঘড়িতে অ্যালার্ম সেট করা আছে, বিছানা ছেড়ে উঠে যাই সকাল সাড়ে ছয়টায়, কাঁধে ব্যাগপ্যাক আর কেডস পরে হাঁটা শুরু করি। সুনসান নেইবারহুড। বাসার আশপাশ এলাকায় হাঁটব, দুই চোখ মেলে দেখব এই এক আশ্চর্য পরম পাওয়া জীবনকে। জীবন কি অপার সুন্দর সেই সঙ্গে একান্ত বোঝাপড়া নিজের সঙ্গে—অর্থাৎ প্রতিটা ব্যক্তিকে ভাবতে ভাবতে এগোতে হবে—কী চায় সে এই জীবনের কাছে? কেন চায়? কিসের বিনিময়ে কী পাবে সে? সবচেয়ে বেশি ভাবতে হবে, সৎ থাকতে হলে তাকে হাটতে হবে কতটা পথ?
আবার স্যার এসে যায় চিন্তায়, স্যার বলতেন, ‘বাংলাদেশে সৎ মানুষ একদিন জাদুঘরে রাখতে হবে লুনা?’ আমরা কি কাছাকাছি সময়ে এসে গেছি, স্যার? বিশ্বাস আর প্রলভনের জাল বিছিয়ে ছিল বাংলাদেশের এক তরুণ ছেলে—দুই উদ্দেশ্য ছিল কানাডা আসবে এবং দেশে সব অন্যায়কে একবারে কবর দেবে। এই দুই টার্গেট সামনে রেখে ছেলেটা বড় অঙ্কের ডলার হাতিয়েছিল কিন্তু আর কিছু এগোতে পারেনি। মাত্র ৫ বছর পর ছেলেটার বড় বোনকে ফোনে বলেছিলাম, ‘মানুষ সংসারে এবং মানুষের ওরসে “জারজ” জন্ম দেয়, সেটা আপনার ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় না হলে জানতে পারতাম না। আপা একটা শব্দ করেননি।’
১২ বছরের দোভাষীর কাজে কানাডায় বসে এমন বহু প্রতারণার জাল/দালাল/আর দুশ্চরিত্রকে একদম সামনে বসে দেখার ভাগ্য হয়েছে। কিন্তু কি বলতে গিয়ে এসব বলছি?
সেই এক পুরোনো কথা, ওই দেশেই। ও সমাজেই বড় হয়েছিলেন সরদার স্যার, বরিশালের আটিপাড়া থেকে উঠে আসা কৃষকের সন্তান সরদার ফজলুল করিমের অন্তত ৫-৬টা বই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ লেভেলে রেফারেন্স বই হিসেবে পড়ানো হয়, একমাত্র সৎ পথে হেঁটে এই জীবন অর্জন করেছিলেন স্যার, কত কত ছেলেমেয়েরা স্যারের আলোয় আলোকিত হয়েছেন, তার হিসাব নেই আমার কাছে, আমি জানি কেবল আমার চোখের নোনা জলের কথা, স্যার বলতেন, জীবনে লোভের বাইরে দাঁড়াইতে শেখো লুনা? সেটা কি পারলাম স্যার?
সেই যে ভোরে হাঁটতে বের হয়েছিলাম নেইবারহুডে—ছবির মতো সাজানো দেশ, একদম ছবি। লেখার শেষে কয়েকটি ছবি দেব, সব আজকেই তোলা, অসাধারণ এ দেশে একা একা হাঁটি আর নিজের মনকে প্রশ্ন করি, আরও কিছু কি চাই আমি? যদি চাই, কেন চাই? যা পেয়েছি তার চেয়ে কি না পাওয়ার পাল্লা বেশি?
স্যার, আসলেই আজকে বাইরে গিয়ে নিজের ঝোলায় যা কুঁড়িয়ে এনেছি সেই ‘মানিক-রতন’। যার তুলনা হয় না স্যার, ওই দুর্ভাগা দেশে কি আসলেই সৎ হওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমেই? আপনাকে মনে রেখে লড়াইটা চালিয়ে যেতে চাই স্যার।