দুই পাগল

বাসার সামনে থেকে একটি রিকশা ঠিক করে আমি আর নিতু তাতে উঠে বসলাম। তারপর রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম,

-মামা, আজ আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। আমরা এখন আপনার রিকশায় একটু ঘুরব। তিন ঘণ্টা পর আপনি আমাদের চিড়িয়াখানায় নামিয়ে দেবেন।

কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই নিতু ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে প্রশ্ন করল,
-কী বললা? আমাদের কোথায় নামিয়ে দেবে?

আমি নরম সুরে উত্তর দিলাম,
-চিড়িয়াখানায়। কেন, কোনো সমস্যা আছে?

-অবশ্যই সমস্যা আছে। দুনিয়ার এত জায়গা থাকতে বিবাহবার্ষিকীতে আমরা চিড়িয়াখানায় কেন যাব?

-শোনো, আমি ঠিক করেছি, আজকের এই বিশেষ দিনে আমরা দুজনে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাব।

-প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে মন চেয়েছে, হারিয়ে যাবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। সে ক্ষেত্রে আমরা কোনো একটা পার্কে যেতে পারি। কিন্তু চিড়িয়াখানায় কেন?

-কারণ, চিড়িয়াখানায় আমরা আজ সারা দিন বানরের সঙ্গে সময় কাটাব, আর ওদের সঙ্গে খেলব। আর ওদের কলা খাওয়াব। ওরা কলা খাবে আর একটু পরপর সব দাঁত বের করে আমাদের ভেংচি কাটবে। সে এক রোমান্টিক দৃশ্য।

খেয়াল করে দেখলাম, নিতু আর রিকশাওয়ালা মামা দুজনে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি নিতুকে প্রশ্ন করলাম,

-এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
নিতু ভুরু কুঁচকেই উত্তর দিল,

-বান্দর আমাদের দেখে দাঁত বের করে ভেংচি কাটবে আর তুমি বলছ, সেটা রোমান্টিক দৃশ্য!

-অবশ্যই। আর শোনো, শুধু বানরই ভেংচি কাটবে না, আমরাও বানরের মতো ভেংচি কাটব।

-আমরাও বান্দরের মতো ভেংচি কাটব! আমি বুঝলাম না, হঠাৎ করে বান্দরের প্রতি তোমার এত আগ্রহ বাড়ল কেন?

-শোনো, ডারউইন বলেছেন, বানর হচ্ছে আমাদের পূর্বপুরুষ। তাই আমি ঠিক করেছি, আমরা এখন থেকে বানরের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলব। এবং মাঝে মাঝে গিয়ে বানরের সঙ্গে সময় কাটাব।

-শোন, বান্দর আমার না, তোর পূর্বপুরুষ ছিল। তাই তুই যেয়ে বান্দরের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখ, বেটা মেন্টাল।

-শোনো, রাগ করো না। বানরের সঙ্গে সময় কাটানোর একটা আলাদা আনন্দ আছে। আমি ঠিক করেছি, চিড়িয়াখানায় গিয়ে তুমি আর আমি বানরের মতো লাফাব। আর মুখ দিয়ে বানরের মতো আওয়াজ করব। দেখবে সেই রকম মজা।

-কী বললা! আমি শাড়ি পরে বান্দরের মতো লাফাব, আর মুখ দিয়ে বান্দরের মতো আওয়াজ করব! মাই গড, এই শালা তো দেখি পুরাই মেন্টাল!
-তুমি আমাকে মেন্টাল বলছ কেন?

-কারণ, মেন্টাল ছাড়া কারও পক্ষে এমন উদ্ভট পরিকল্পনা করা সম্ভব না। আমাকে এত দিন বললে, প্রথম বিবাহবার্ষিকী নিয়ে তুমি মহা এক পরিকল্পনা করেছ। এই তোমার মহাপরিকল্পনা?

-শোনো, আগেই হতাশ হয়ো না। আমার পরিকল্পনা তো এখনো শেষ হয়নি। আমরা তো শুধু বানর না, হনুমান এবং শিম্পাঞ্জির সঙ্গেও খেলা করব।

-হনুমান-শিম্পাঞ্জির সঙ্গে তুই খেলা কর। আমি তোরে দেখছি, আমার এই জীবনে আর বান্দর, হনুমান, শিম্পাঞ্জি—কোনো কিছুই দেখা লাগবে না।

বলেই সে আমাকে রিকশা থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল। তারপর ওই রিকশা করেই চলে গেল। আমি বোকার মতো রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। বানর-হনুমানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে এই মেয়ের সমস্যা কোথায়, সেটা আমি বুঝলাম না।

বিবাহবার্ষিকীর মতো এমন একটি দিনে স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থাকাটা ঠিক হবে না। তাই আমিও অন্য একটি রিকশা নিয়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। কারণ, আমি জানি, নিতু ওখানেই গেছে।

শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে দুই ব্যাগ কলা কিনলাম। বাসার সামনে পৌঁছে রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম,

-মামা, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসছি। আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। আমরা আজ সারা দিন আপনার রিকশায় ঘুরব।

-যান, মামা। কুনু সমস্যা নাই, আমি খাড়াইতেছি।

বাসায় ঢুকে শাশুড়ির হাতে কলার ব্যাগ দুটো দিয়ে ড্রইংরুমে বসলাম। দেখলাম আমার একমাত্র শ্যালক টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখছে। ওর নাম নয়ন। ও দশম শ্রেণির ছাত্র। আমি গম্ভীর গলায় নয়নকে বললাম,

-নয়ন মিয়া, এভাবে খেলা দেখে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

-দুলাভাই, বলেন কী, খেলা দেখা খারাপ! তাহলে কি টিভি দেখব না?
-অবশ্যই দেখবে। তবে সেটা গঠনমূলক আর শিক্ষামূলক জিনিস হতে হবে। চলো, তোমাকে গঠনমূলক এবং শিক্ষামূলক কিছু জিনিস দেখাই।

বলেই রিমোটটা নিয়ে ইউটিউবে বাংলা গানের একটা মিউজিক ভিডিও ছাড়লাম।

মিউজিক ভিডিওটা পুরোনো বাংলা সিনেমার গান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সেখানে একটি মেয়ে আর একটি ছেলে বিনা কারণে অযথা পানির মধ্যে বানরের মতো লাফাচ্ছে আর গান গাইছে,
‘মনের এই ছোট ঘরে
আগুন লেগেছে হায় রে
পানিতে নেভে নারে কী করি উপায়
বেঁচে থাকা হল দায় সজনী গো
বেঁচে থাকা হল দায়...’

খুবই মনোযোগসহকারে আমি গানটি শুনছিলাম এবং ওদের লাফালাফি দেখছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, নয়ন টিভির দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে তাকাতেই বলল,
-দুলাভাই, আপনি কি সিওর, এটা শিক্ষামূলক গান?

-অবশ্যই। এটা এক শ ভাগ শিক্ষামূলক গান। ভালো করে খেয়াল করে দেখো, এ গানে মেয়েটি কী বলছে। মেয়েটি বলছে, তার ঘরে আগুন লেগেছে। কিন্তু পানিতে নিভছে না। আমাদের কে এখন গবেষণা করে ওই আগুন নেভানোর কৌশল বের করতে হবে।

-কিন্তু দুলাভাই, আমার মনে হয় আপনি বুঝতে পারেননি। এখানে মেয়েটি যে আগুনের কথা বলছে, সেই আগুন কিন্তু আসল আগুন না।

-নয়ন, শোনো, আগুন আগুনই। এখানে আগুনটা কী ধরনের, তা নিয়ে না ভেবে আগুনটা কীভাবে নেভাবে, তা নিয়ে ভাবো।

ঠিক সে সময় নিতু ড্রয়িংরুমে ঢুকল। ঢুকেই চিৎকার করে বলল,
-ছি, নয়ন, তোরা টিভিতে এগুলো কী দেখছিস?

-নারীর দেহ-মনে আগুন লাগলে কীভাবে সেই আগুন নেভানো যায়, দুলাভাই আমাকে সেই টেকনিক শেখাচ্ছেন আপা। চাইলে তুমিও শিখতে পারো। খুবই জ্ঞানের জিনিস।

নিতু কটমট করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চাপা গলায় বলল,
-বদমাশ বেটা, তোর মাথায় কি ভালো কিছু খেলে না? তুই আমার ভাইকে এই সব বাজে জিনিস কেন শেখাচ্ছিস?

-বাজে জিনিস শেখাব কেন? আমি তো ওর আই কিউ লেভেলটা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।
-কোনো দরকার নাই। আমার ভাইয়ের না, তুই তোর আই কিউ বাড়ানোর চেষ্টা কর। মানুষের আই কিউ জিরো হয় শুনেছি, কিন্তু মাইনাসও যে হতে পারে, সেটা তোরে না দেখলে বুঝতাম না।

একথা বলেই সে টিভি বন্ধ করে দিল। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল,
-তুমি দুই ব্যাগ কলা কেন আনছ?

-তুমিই তো বলছ, শ্বশুরবাড়িতে কখনো খালি হাতে না আসতে।

-তাই বলে শ্বশুরবাড়িতে তুমি শুধু কলা নিয়ে আসবে? তা–ও আবার এতগুলো কলা!
-আসলে বানরের জন্য কলা কিনছিলাম, তখন হঠাৎ মনে হলো, বাবা-মায়ের জন্যও কিছু কলা নিয়ে যাই। ওখানে এক ব্যাগ কলা বানরের জন্য, আরেক ব্যাগ কলা বাবা-মায়ের জন্য এনেছি।

-কী বললা! বানরের জন্য কলা কিনতে গিয়ে তোমার আমার বাবা-মায়ের কথা মনে পড়েছে? আমার বাবা-মা আর বানর তোমার কাছে এক হলো?
-তুমি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছ।

-শোন, আমার আর কিছু বোঝার নাই। তোর এসব পাগলামি আমি আর নিতে পারছি না। তুই তোর কলা নিয়ে এখনই বাসা থেকে বের হয়ে যা।
-কই যাব?

-কই যাবি মানে? চিড়িয়াখানায় যাবি। সেখানে যেয়ে তোর পূর্বপুরুষ বান্দররে কলা খাওয়াবি।

-তুমিও চলো। শোনো, আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। এমন দিনে আমাদের একসঙ্গে থাকা উচিত।

-তোর একসঙ্গে থাকার গুল্লি মারি। তোর মতো পাগলের সঙ্গে আমি আর নাই। তোরে আমি ডিভোর্স দিব।

আমি কলার ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়লাম। নিচে নামতেই রিকশাওয়ালা মামা বললেন,
-মামা, আমনে একা কেন? মামি কই?

-আপনার মামি আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। সম্ভবত সে আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার প্ল্যান করছে। ভেবেছিলাম, তাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাব, বানরের সঙ্গে সময় কাটাব। কিন্তু সে বিষয়টা না বুঝেই আমাকে বাসা থেকে বের করে দিল।

-মামা, মাইয়া মানুষ বড়ই কঠিন। বান্দরের খেলা এরা বুঝত না। বান্দর একটা সম্মানিত জিনিস, তা ইতারা জানব কেমতে।

-খুব দামি কথা বলেছেন। মামা, আপনার নাম কী?
-সফিক।

-সফিক সাহেব, এক কাজ করেন, আপনিও আমার সঙ্গে এখন চিড়িয়াখানায় চলেন। আমরা দুজনে আজ একসঙ্গে বানরকে কলা খাওয়াব। চিন্তা করবেন না। আপনি সারা দিনে যে টাকা ইনকাম করেন, সেটা আমি আপনাকে দিয়ে দেব। যাবেন?

-অবশ্যই যামু। স্যার, একটা কথা কই। মামির জন্য কষ্ট পাইয়েন না। আমারও দুইবার ডাইভোর্স হইছে। এটা কষ্টের না, এটা বড়ই আনন্দের ব্যাপার।

-সফিক সাহেব, ডিভোর্স মোটেও আনন্দের ব্যাপার না। আর তা ছাড়া সে এখনো আমাকে ডিভোর্স দেয়নি। শুধু বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।

- হে আমনেরে ডাইভোর্স দেয় নাই তো কী হইছে, আমনে হেরে দিবেন। মামা, যে বান্দর পছন্দ করে না, হেরে আমনে ঘরে রাখবেন ক্যান? আমনে এখন বান্দর পছন্দ করে এমন বেডি দেইখা আরেকটা বিয়া করবেন।

-সফিক সাহেব, বানর পছন্দ করে এমন মেয়ে বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না।

-অবশ্যই যাবে। প্রয়োজনে আমরা বান্দর নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরব। দেখব কোন কইন্যা বান্দর পছন্দ করে। যে কইন্যা বান্দর পছন্দ করবে, তার সাথে আমনের বিবাহ হবে।
-আপনার পরামর্শ আমার পছন্দ হইছে। ঠিক আছে, এটা নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে। এখন চলেন আমরা চিড়িয়াখানায় যাই।

চিড়িয়াখানায় গিয়ে সফিক সাহেব আর আমি একটা একটা করে কলা বানরের খাঁচায় ছুড়ে মারতে লাগলাম। কিন্তু কেন জানি বানরগুলো কলা খাওয়া তো দূরের কথা, একবার ফিরেও তাকাল না। বুঝলাম না তাদের সমস্যা কোথায়? অনেকক্ষণ পর সফিক সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,

-স্যার, ইতারা তো দেহি বড়ই বেয়াদ্দপ। মানুষরে একটু সম্মানও দেয় না। আমাগো দিকে একবার ফিরাও তাকাইল না। এহন কী করব? স্যার এক কাম করি, শয়তানগুলারে গালি দেই?

-গালি দিবেন? দেন, তবে বেশি খারাপ গালি দিয়েন না। কারণ, এখানে মহিলা বানরও আছে। মেয়েদের সামনে মুখ খারাপ করাটা অভদ্রতা। আপনি এক কাজ করেন, তার চেয়ে বরং ভেংচি কাটেন আর বানরের মতো লাফাতে থাকেন। দেখবেন, ওরা ঠিকই তাকাবে।

-স্যার, ভালো কথা মনে করেছেন। ওই বান্দর, এই দিকে তাকা। ওই বান্দর, এই দিকে তাকা। না হইলে ঘুষি মাইরা তোর নাক ফাটাই দিমু।

একথা বলেই সফিক সাহেব সবগুলো দাঁত বের করে ভেংচি কাটতে লাগলেন। আর দুই হাত মাথার ওপর তুলে বানরের মতো লাফাতে লাগলেন। একটু পর সফিক সাহেব লাফাতে লাফাতে বললেন,

-স্যার, লাফাইতে খুব মজা পাইতেছি। স্যার, আসেন, আমরা দুজনে একসাথে লাফাই।
-লাফাবেন? চলেন, লাফাই।

বলেই আমিও সফিক সাহেবের মতো ভেংচি কেটে, দুহাত মাথার ওপর তুলে লাফাতে শুরু করলাম। খেয়াল করলাম আশপাশের মানুষগুলোই শুধু নয়, খাঁচার ভেতর থাকা বানরগুলোও এখন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা তাদের অবাক করা চোখের সামনেই লাফাতে লাগলাম। একটু পর হঠাৎ করে অনুভব করলাম, কেউ একজন আমার কাঁধে টোকা দিচ্ছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখলাম, নিতু দাঁড়িয়ে আছে। সে চাপা গলায় বলল,
-তুমি এসব কী করছ?

-বানর বানর খেলছি। খুবই মজার খেলা। তুমি না বলেছিলে, তুমি আসবে না?
-বলেছিলাম। কিন্তু তোমার মতো পাগলরে কোথাও একা পাঠানো রিস্ক। তাই পেছন পেছনে চলে এসেছি।

ঠিক সে সময় সফিক সাহেব লাফাতে লাফাতে বললেন,
-স্যার, থামলেন ক্যান। আর এ কে?

আমি সফিক সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
-ইনি আমার স্ত্রী। ওর সামনে এখন লাফান যাবে না। সে খুবই রাগী মানুষ।

আমি মামার কানে কানে বললেও মামা লাফাতে লাফাতে চিৎকার করে বললেন,
-স্যার, আমনে ডরাইতেছেন ক্যান? যে বউরে ডাইভোর্স দিবেন, তারে ডরানোর কুনু দরকার নাই। আমনে আবার লাফান শুরু করেন।

নিতু অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে বলল,
-এই লোকটা কে? আর ও এসব কী বলছে?

-উনি আমার বন্ধু। নাম সফিক মিয়া। খুবই জ্ঞানী মানুষ। উনার রিকশা করেই আমি এখানে এসেছি।

-সে তোমার বন্ধু! মাই গড, এ দেখি এক বান্দর আরেক বান্দররে বন্ধু বানাইছে। আচ্ছা, তুমি তারে কী বলছ? তুমি তারে বলছ, তুমি আমারে ডিভোর্স দিবা?

-না, আমি তা বলিনি। তবে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে বানর পছন্দ করে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে উনি আমাকে সুন্দর একটা পরামর্শ দিয়েছেন।

-কী বললি! আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য তুই উনার কাছ থেকে পরামর্শ নিছোস?

র ডিভোর্স নেওয়ার এত শখ? দাঁড়া, তোরে আজ আমি সত্যি সত্যি ডিভোর্সই দেব। তোর সাথে আমি আর নাই।

বলেই নিতু হনহন করে চলে গেল। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। সফিক সাহেব আবারও লাফানো শুরু করলেন। খেয়াল করে দেখলাম, উনি এবার লুঙ্গিটাকে কাছা মেরে নিয়েছেন। একটা বয়স্ক মানুষ লুঙ্গি কাছা মেরে, মাথার ওপর দুহাত তুলে, সব দাঁত বের করে বানরের মতো লাফাচ্ছে—সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। উনি এভাবে লাফাতে লাফাতেই চিৎকার করে বললেন,

-লুঙ্গি কাছা মাইরা লাফাইতে বেশি মজা পাইতেছি, স্যার। স্যার, আমনে লুঙ্গি পইরা লাফাইবেন?

-তা অবশ্য লাফানো যায়। কিন্তু লুঙ্গি পাব কোথায়?

-আমার রিকশার গদির নিচে একটা আছে। দাঁড়ান, আনতাছি।

বলেই সফিক সাহেব লুঙ্গি আনতে দৌড়ে চলে গেলেন। লুঙ্গি আনার পর আমিও সফিক সাহেবের মতন লুঙ্গি পরে কাছা মেরে নিলাম। তারপর সব দাঁত বের করে ভেংচি কেটে, মাথার ওপর দুই হাত তুলে লাফাতে লাগলাম। ইতিমধ্যে আমাদের আশপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। একটু সময় পরেই সফিক সাহেব চিৎকার করে বললেন,

-স্যার, সাবধান, আপা আবার ফিরা আইতাছে। তবে এবার কিন্তু হাতে একটা লাঠি আছে। স্যার, লাঠি দিয়া আমাগো মারব?

আমি দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলাম, নিতু আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাতে লাঠি না, একটা বাঁশ। জানি না কোথা থেকে সে এটা জোগাড় করেছে।

-সফিক সাহেব শোনেন, এই মহিলারে আমি ভালো করেই চিনি। সে কিন্তু বাঁশ দিয়ে ভয় দেখাবে না। সে ঠিক মাথায় বাড়ি মারবে।

-স্যার, মনে হয় মামি আমারে মারবে না। আমি তো বাইরের মানুষ, ঠিক না?
-না, সফিক সাহেব, আপনার ধারণা ভুল। আমার ধারণা, সে প্রথম বাড়িটা আপনার মাথায় দেবে। আর দ্বিতীয় বাড়িটা আমার মাথায়।

কথাটা বলামাত্র সফিক সাহেব বুকে থুতু দিলেন। তারপর উচ্চ স্বরে পড়তে লাগলেন,
‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ যোয়ালিমিন। লা ইলাহা...’
আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম,

-সফিক সাহেব, দোয়া পড়তে পড়তে দৌড় দেন। না হলে মাথা হারাবেন।
বলামাত্র সফিক সাহেব ঝড়ের বেগে দৌড় শুরু করলেন। আমিও সফিক সাহেবের পেছন পেছন ভোঁ–দৌড় দিলাম। দুজন বয়স্ক মানুষ লুঙ্গি কাছা মেরে ঢাকা চিড়িয়াখানায় দৌড়াচ্ছে, সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।

বি. দ্রষ্টব্য:
সব সময় নিয়মকানুন মেনে গাম্ভীর্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করাটা হয়তো একঘেয়েমি লাগতে পারে। তখন এমন একটু–আধটু পাগলামি করে দেখতে পারেন। আশা করি মন্দ লাগবে না।

বি. দ্রষ্টব্যের বি. দ্রষ্টব্য:
এ লেখা মজা করার জন্য লেখা। এর মধ্যে শিক্ষণীয় কিছু খোঁজার চেষ্টা না করাই ভালো। আর সব সময় সবকিছুর মধ্যে শিক্ষণীয় কিছু খুঁজতেই হবে, তার তো কোনো মানে নেই, তাই না? শিক্ষা লাভের জন্য তো দুনিয়ায় অনেক কিছুই আছে।
*[email protected]