দ্বিতীয় জন্ম

ডিসেম্বরের প্রচণ্ড ঠান্ডা! সবে দেশ থেকে এসেছি। বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকি আকাশ ফুঁড়ে তুষার ঝরা, চারদিকের ন্যাড়া গাছ, আর তার গায়ে ক্রিস্টালের মতো ঝকমক জমে থাকা বরফ: যেন অন্য কোনো এক পৃথিবী! দেশ থেকে আসার পর অনেক অভ্যাস পাল্টাতে বেশ সময় লেগেছে: যেমন, এক কাপড় দ্বিতীয়বার পরা; হাইহিল ছুড়ে ফেলে হাঁটার অভ্যাস করা। তবে কিছু ব্যাপারে বিকল্পও খুঁজে পেলাম, যেমন: পরিধেয় কাপড়টা ধুয়ে ঘর গরম করা হিটারের ওপর মেলে দেওয়া এবং শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটা সরিয়ে ফেলা, বেশি হিটে আগুন লাগার ভয়ে। তো একদিন স্বামী বেড়াতে নিয়ে গেল বেশ দূরে। পথে মনে পড়ল, আরে হিটার থেকে তো কাপড় সরিয়ে আসিনি; কাপড় গরম হয়ে আগুন লেগে যেতে পারে...! ছোটবেলা বাড়ি থেকে কোথাও বেড়াতে গেলে বাড়ি আসার জন্য যেমন কান্নাজুড়ে দিতাম, ঠিক সে রকম কান্নাজুড়ে দিলাম। স্বামীকে ভয়ের কথা না বলে উল্টো বললাম, আমি কোথাও যাব না, বাসায় যাব! বাড়ি এসে দেখি নাহ কাপড়গুলো গরম ঠিকই, কিন্তু আগুন লাগেনি...কী যে আনন্দ তখন মনে! এটি একটি ছোট উদাহরণ, আগে কত বোকা ছিলাম তার। আর একটা ব্যাপার বিশ্বাস করতাম, এ জীবন ছাড়া যাপিত অন্য কোনো এক জীবন আছে, যদিও তার সংজ্ঞাটা তখনো আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। ঠিক পুনর্জন্ম না বলে তাকে দ্বিতীয় জন্ম বলাই ভালো।

অনার্স প্রথম বর্ষে প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলেও লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তবেই আমেরিকা এলাম। তখন রান্না, হাঁড়িপাতিল ধোয়া বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল আমার কাছে। কিচেনে যাতে ককরোচ না হয়, তাই সবকিছু ক্লিন রাখতে গিয়ে দুই হাতের ওপরে উঠে গেল র‌্যাশ। এদিকে সিদ্দিকা কবীরের বই দেখে রান্না করায় স্বামীর প্রশংসাও পেতে লাগলাম! কিন্তু গর্ভবতী হওয়ার পর শারীরিক অসুস্থতায় বই দেখে মেপে মেপে রান্না করা শিকেয় উঠল! যা রাঁধতাম তা আর মুখে তোলা যেত না! এরপর দুই বাচ্চার মা আমি ফুলটাইম গৃহিণী হয়ে ভুলে গেলাম সেই মেয়েটির কথা, যে একদা বিস্তৃত আকাশে চন্দ্র-মেঘ-তারা-সূর্যাস্ত দেখতে ভালোবাসত; ফুলের বাগান, খেলাধুলা, উপন্যাস-কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকত! বাচ্চারা একটু বড় হলে বাসার আশপাশে ম্যাকডোনাল্ডস, ডানকিন ডোনাটস, ফুড বাজারে সপ্তাহখানেক কাজ করে ভালো না লাগায় ছেড়ে দিয়েছি। প্রবাসে কোনো কাজই ছোট নয়, কিন্তু আমার মনে হতো এ জীবন ঠিক আমার জন্য নয়!  আমি তখন ভাবতে থাকি আমাকে পরিবর্তিত হতে হবে...অথচ তখনো জানি না ঠিক কীভাবে! বাচ্চা দুটিকে ফুলটাইম স্কুলে পাঠানোর পর বাসার পাশেই টার্গেটে কাজ নিলাম! ওদের স্কুলের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে কাজ করতাম যাতে ওরা কখনো বুঝতে পারে না যে আমি কাজ করি!

এভাবে আমেরিকায় ১০ বছর পরিয়ে আমি বাংলা/ইংরেজি/বোটানি/ মাইক্রোবায়োলজি সব ভুলে গেছি তত দিনে। তবে নিজেকে সম্মানের সঙ্গে এ দেশে টিকে থাকার তাগিদটা খুব উপলব্ধি করতাম। কাজ থেকে আমাকে সাহায্য করল স্কুলের খোঁজ পেতে! অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে দেখি আমার লেভেল ক্লাস ফোরের বাচ্চাদের সমান। কারণ, আমি জানতাম না, একটা প্যাসেজের মেইন আইডিয়া অথবা টপিক সেনটেনস কী! শুরু করলাম পার্টটাইম কাজের সঙ্গে ফুলটাইম স্কুলে যাওয়া। প্রকৃত অর্থে সেই মুহূর্তে জিইডি অথবা হাইস্কুল পাস করা ছিল আমার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন। তিন মাস শেষে হাইস্কুল পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলি এবং পাস করি! অনেকে বলল, হাইস্কুল ডিপ্লোমা থাকলে পোস্ট অফিসে কাজ পাওয়া যাবে। কিন্তু না, আমি ওতেও সন্তুষ্ট নই। ছোটবেলা থেকে আমার একটা বদভ্যাস, সেরা জিনিসটা চাই। আর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাকে ঠেলে দিল আরও উচ্চশিক্ষা নিতে।

সারা দিন অনলাইন ঘেঁটে খুঁজতে লাগলাম, কোন প্রফেশনে আমি যাব এবং মনস্থির করলাম সনোগ্রামের ওপর পড়াশোনা করব। দ্বিতীয়বার মা হওয়ার সময় এক অতি মার্জিত সনোগ্রাফার একটা ছোট মেশিন (ট্রান্সডুসার) আমার পেটে ঘষে ঘষে যখন বলল, তোমার বেবির সেক্স জানতে চাও? আমার যেহেতু একটি মেয়ে আছে, তাই সংশয়ে বললাম, হ্যাঁ! সে আমাকে পৃথিবীর অন্যতম একটি আনন্দের সংবাদ দিল যে আমার একটি ছেলে বেবি হতে যাচ্ছে। তখন থেকে এই প্রফেশনকে আমার পছন্দ; আর সেদিন বেডে শায়িত আমি একদমই জানতাম না যে এই আমি একদিন একজন সনোগ্রাফার হব! আসলে স্বপ্ন দেখতে হয় বড়! তারপর সে স্বপ্নকে পূর্ণ করতে নিজেকে ছুড়ে দিতে হয় চ্যালেঞ্জের মহাসাগরে। আর এই দুর্গম পথে ত্যাগ করতে হয় অনেক কিছু। যেমন: আমি একদম সময় অপচয় করিনি; প্রতিটি সেকেন্ড আমি ব্যয় করেছি টাকার মতো হিসাব কষে! যদিও আমি একদম বেহিসাবি ছিলাম; কিন্তু স্টুডেন্ট হওয়ার পর শপিং, বেড়ানো, আড্ডা—সবকিছুই বাদ দিতে বাধ্য হয়েছিলাম সময়ের অভাবে।

লেখক
ছবি: সংগৃীত

সনোগ্রামো ব্যাচেলর করার আগে ইউনিভার্সিটিতে ঘুরে জেনে নিই বিস্তারিত তথ্য, যা আমাকে এ বিষয়ে চান্স পেতে সাহায্য করবে। কারণ সেখানে সিট খুবই সীমিত। সায়েন্স, ম্যাথে অ্যাসোসিয়েট শেষে ৩.৭ জিপিএ নিয়ে ১৪ জনের একজন হয়ে আমি চান্স পেলাম লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে ডায়াগনস্টিক মেডিকেল সনোগ্রামের ওপর ব্যাচেলর করতে। প্রচণ্ড স্ট্রেসফুল এবং এক্সপেনসিভ একটি প্রোগ্রাম, আর একটু খারাপ করলেই বাদ হয়ে যেতে হবে। প্রতিটা মুহূর্তে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে পড়াটা শেষ করে চাকরি পেলাম নিউইয়র্কের অন্যতম সেরা একটি হাসপাতালে! আর আমার এই ভীষণ দুঃসময়ে আমাকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেছে আমার পরিবার। আমার স্বামী, সন্তানদের সহায়তা ছাড়া এই কঠিন পথ আমি পার হতে পারতাম না। এ ছাড়া পড়াশোনার সময়ে আমি লেখালেখি শুরু করলাম। খাঁটি সোনায় যেমন গয়না হয় না, তেমনি অল্প পড়ায় কোনো বিষয় আত্মস্থ করতে মনোযোগকে মাঝেমধ্যে সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োজিত করলে অনেক কঠিন জিনিসও ব্রেন সহজে অ্যাবজর্ব করতে পারে। লেখালেখি আমাকে দীর্ঘ বছর বাদে আবার পড়াশোনার প্রচণ্ড স্ট্রেসে লাঘব করতে অনেক সাহায্য করেছে।

প্রবাসী অনেক নারীকে বলতে শুনেছি, তাঁরা পরিবারের সমর্থন পান না দেখে কিছু করতে পারেন না। বস্তুত, সফলতা হুট করে আসে না, তার জন্য ক্ষেত্র, মানে নিজেকে তৈরি করতে হয়। আর একটি মেয়ে যখন প্রমাণ করেন যে তিনি সত্যিই পারবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তখন পরিবার তাঁকে সাপোর্ট করে নিজেদের ভবিষ্যতের স্বার্থেই! আর এভাবেই একটি মেয়ে নিজের দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবার ছেড়ে এসেও দ্বিতীয় জন্মের মাধ্যমে নিজের জীবনকে বিকশিত করতে পারেন এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে পরিবারের হাল ধরতে পারেন।

*লেখক: জেবুন্নেছা জ্যোৎস্না, প্রবাসী