নতুন ভূরাজনৈতিক ভরকেন্দ্র

ব্রেক্সিটের পরে বরিস জনসনের ভারত সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বলা হয় যে তারা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের নীতিকে পুনর্বিবেচনা করবে। এটিকে তারা তাদের নীতিগত টিল্ট বা কোনো এক দিকে ঝুঁকে থাকা বলে বর্ণনা করে। ব্রিটেনের বিদেশনীতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে—এটা ধরেই নেওয়া যায়, কারণ এই অঞ্চল বিশ্বের নতুন ভূরাজনৈতিক কেন্দ্র। ব্রিটেনের কুইন এলিজাবেথ নৌবহর ওই অঞ্চলে মোতায়েন থাকবে প্রথমবার। সঙ্গে থাকবে ন্যাটোভুক্ত অন্য দেশের নৌবাহিনীও। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পরে জনসনের এই ভারত সফর থেকে স্পষ্ট বিশ্বজুড়ে এই মহামারির পরে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে তিনি কতটা গুরুত্ব দেবেন। অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ এশিয়ান নেশনের সঙ্গেও হাত মেলাতে চায় ব্রিটেন।

বাণিজ্যিক সম্পর্কে জোর

গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এমন ছোট কিছু দেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে স্থাপনে বিশেষ আগ্রহী ব্রিটেন। মুক্ত বাণিজ্য নীতির সূচনা হতে পারে। তবে তার আগে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। ভারতে ব্রিটেনের রপ্তানির পরিমাণ ৮.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ৬.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার—সেটা ২০২০-২১ সালে। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, ব্রেক্সিটের পর ভারতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য কার্যকর করা সহজতর হবে। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রসচিব ডমিনিক রাবের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠক হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। সন্ত্রাসবাদ রুখতে ও সমুদ্রপথের নিরাপত্তা বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষার পার্টনারশিপ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এর পরে গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসচিব এলিজাবেথ ট্রুস ও ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের বৈঠক হয়। এলিজাবেথ বলেন, একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হওয়া দরকার। মুক্ত বাণিজ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্রে দুই দেশে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে চায় ব্রিটেন ও ভারত।

ব্রিটেনের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসে দক্ষিণ এশিয়ার মিনিস্টের লর্ড তারিক আহমেদও সম্প্রতি ভারত সফর থেকে ফিরেছেন। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন থেকে না-হওয়া ইন্ডিয়া-ইউকে এনহ্যানসড ট্রেড পার্টনারশিপ এবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে এগোতে হবে ব্রিটেনকে।

এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তি হলো দুই দেশের মানুষ, মূল্যবোধ ও শক্তি। বরিস জনসনই সম্ভবত প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যিনি ভারতের সঙ্গে হার্দিক ও বিশ্বাসের সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় ভরসা রাখেন। ভারতের সঙ্গে প্রকৃত পার্টনারশিপ গড়ে তোলার জন্য এটা ব্রিটেনেরও বড় সুযোগ। গত এক দশকে এই দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেই শূন্যতাকে পরিবর্তন করার সময় এসেছে। এ সুযোগকে হাতছাড়া করা ব্রিটেনের পক্ষেও ভালো হবে না। ভারতের ১২০ কোটি মানুষ ও ভারতের মতো গণতন্ত্রের সঙ্গে অর্থপূর্ণ ও মজবুত সম্পর্ক গড়ে তুললে লাভ হবে ব্রিটেনেরও।

কিন্তু ব্রিটেনকে কয়েকটি বিষয়ে কড়া নজর দিতে হবে। অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ব্রিটেনের বাক্‌স্বাধীনতার অধিকার ও সে দেশের মাটির অপব্যবহার করে নানা ধরনের প্রচার করে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটেন বেশি সক্রিয় হলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নীতি প্রণয়নে ব্রিটেনের গুরুত্ব আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে কোয়াড গ্রুপ তৈরি করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভারতকে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেখেছেন। এই সুযোগকে হাতছাড়া করা উচিত হবে না ব্রিটেনের থিঙ্কট্যাংক ও নীতি প্রণয়নকারীদের। এই নতুন সমীকরণে বরিস জনসন যাতে পিছিয়ে না পড়েন, সেটা দেখার দায়িত্ব তাঁদেরও। ভারত ও ব্রিটেন দুই দেশের উজ্জ্বল ও ফলপ্রসূ ভবিষ্যতের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে কনজারভেটিভ পার্টির নেতাদের উচিত এই বিষয়ে তাঁদের নেতা বরিস জনসনের আন্তরিক প্রয়াসকে পূর্ণ সমর্থন করা।

লেখক: প্রিয়জিৎ দেবসরকার, লন্ডন, ভারতীয় উপমহাদেশের বিশিষ্ট ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞ।