নানা রঙের শৈশব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সন্ধ্যায় ব্যাডমিন্টন খেলে পা ধুচ্ছি...কেন যেন ছোটবেলার কথা মনে হলো...ছোটবেলা, মানে যেদিনগুলো গ্রামের বাড়িতে ২০-৩০ জন চাচাতো ভাইবোন মিলে দাঁড়িয়াবান্ধা/ গোল্লাছুট খেলতাম! মনে নেই নিয়মকানুন! নামটাই সঠিক কি না, জানি না...ফুফাতো ভাই ছিল রকস্টার!

কী যে হল্লা হতো! দাদা রেগে বেহায়ার দল বলে গালি দিতেন...ওইটাই ছিল ওনার খারাপ গালি! নামাজের আজানের সঙ্গে সঙ্গে খেলা শেষ!

পেছন দুয়ারে আমাদের জন্য বালতি ভরা পানি থাকত...হাত–পা ধুয়ে তারপর ঘরে ওঠা...নয়তো ঘরে ওঠা যাবে না! কোনো দিন প্রশ্ন করিনি কেন! সেটাই নিয়ম ছিল...প্রশ্ন করার কথা মাথাতেও আসত না! ঢাকাতেও খেলতাম সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত...কিন্তু কেন জানি মন পড়ে থাকে সেই গ্রামের বাড়িতে!

পেছন দুয়ারের আরেক মাহাত্ম্য ছিল...দুষ্টুমি করে সাজার ভয়ে...দাদা–দাদির কাছে লুকিয়ে থাকা! কার সাহস ছিল সেখান থেকে বের করে!

একবার ছোট কাকার ফুটবল খেলা দেখে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়...কাকা তো ব্যস্ত তার সাগরেদদের নিয়ে...বাড়ি ফিরে কে মায়ের সামনে পড়ে...হাত–পা ও মুখ ধুয়ে দাদার পাশে! কী সাধারণ জীবন ছিল!

বাড়িতে তিনবেলা নয়, চারবেলা খাবার হতো...সকালে এখনকার মতো দুধ, মুড়ি, ফল...১০টায় প্রপার খাবার... লাঞ্চ...আরলি ডিনার আর আরলি ঘুম! দুইবেলা বাজার...ফ্রেশ খাবার! দুধের ঘন সরটা না হলে হতো না!

ঘুম! ইশ্‌ ঘুমটা যে কী প্রিয় ছিল! না দুপুরে ভাতঘুম হতো না! টোটো কোম্পানির ম্যানেজার ছিলাম! ঘুমটা পেত ঠিক তখন, যখন মাস্টার আসতেন আদর্শলিপি/ নামতা পড়াতে! পড়তে পড়তে কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে ঢুলুনি শুরু হতো, টেরও পেতাম না!
মাঝেমধ্যে দুই বোনের কাজ পড়ত সামনের আর পেছন দুয়ার ঝাড়ার...বিশাল উদ্যোগে কাজ হতো...তারপর সেই পেছন দুয়ারে হাত–পা ধুয়ে সামনের বারান্দায় বসে চাচি, বোন, ভাবিরা চুল বেঁধে দিত ইচ্ছামতো নারকেল তেল দিয়ে! তারপরের কাজ ছিল মা–চাচিদের কেরোসিনের বাতি, হারিকেন গোয়ালঘর ছুঁয়ে পশ্চিম ঘর ছাড়িয়ে বাড়ির মসজিদে দিয়ে আসা...যাতে মাগরিব আর এশার নামাজে আলো থাকে মসজিদে...অফকোর্স সেই সময় ইলেকট্রিসিটি ছিল না!

মাসুক হেলাল

পশ্চিম ঘরের পেছনে তালগাছের পাতা বাতাসে দোলা দেখতাম আর বাহারি তালপাতার বাতাস (অর্গানিক) মন্দ ছিল না কিন্তু! সন্ধ্যার পর তালগাছে তাকানোও অলিখিত নিষেধ ছিল...তালগাছটা এখন আর নেই! কত রাতে মাকে দেখেছি, তাল পড়ার শব্দ পেলে তুলে আনতে!

ফসল ওঠার দিনগুলো ছিল খুবই ব্যস্ত...কোত্থেকে লোকজন আসত মাঠে কাজ করতে মাসের পর মাস থাকত...কী বিশাল গামলা ভরে তাদের ভাত–তরকারি দিত...আমি ওদের খাওয়া মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতাম! খুঁটিতে ধান ছড়ানো, সারা উঠান ভরা ধান, ডাল, পাট, হলুদ, মরিচ, পাট...যখন যে সময়! ধান–ডাল ঝরিয়ে নিমেষেই ঢেঁকিতে ধান, জাঁতায় ডাল...রান্নাও সঙ্গে সঙ্গেই! তারই পাশাপাশি চলত মুড়ি আর খই বানানো! যেদিন খই, মুড়ি, পিঠা, কাসুন্দি বানানো হতো, সেদিনগুলো স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ!

বৃষ্টির দিনগুলোতে পশ্চিম ঘর থেকে চুলার পাড়ে যাওয়া কষ্টই ছিল! সামনের দুয়ার পেরিয়ে দাদার ঘর...সেখান থেকে পেছন দুয়ার পার হয়ে রান্নাঘর! ছাতা কি খুব ছিল?...কলাপাতা মাথায় দিয়ে ভিজতে ভিজতে যাওয়া...আর দৌড় দিলে কপালে থাকলে মাছ ধরা (পিছলে পড়া)! তার মধ্যেও পড়শি চাচিরা গল্প করতে এসে রান্নাঘরের বারান্দায় আটকে যেতেন! দুপুরের খাবার খেয়ে যেতেন তাঁরা। সেই বারান্দায় বসে খেতে খেতে আমরা খাবার ছুড়তাম বাইরে ইচ্ছামতো...মুরগিগুলো খেয়ে যেত! কিছু বেঁচে থাকলে কুকুর! কী স্বাধীন জীবন!

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

ছোট চাচি খাবার শেষে কুকুরের আচায় খাবার দিতেন! বেহিসাবি নষ্ট করতাম মনে হয় আজকাল! কিন্তু সবাই তার ভাগ পেত! বাড়ির বিড়ালের মাছের অভাবও হয়নি কখনো! এসব দেখেও নিজের বাচ্চাদের বিড়াল দিতে রাজি নই আমি! আমাদের কোনো নিয়ম ছিল না, খাবার খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া...আমি এখনো কী তেমনি আছি?

রান্নাঘরটা কি এখনো সেখানে আছে? পশ্চিমের ঘরে কেউ থাকে না...ভেঙেচুরে গেছে...! মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে...নতুনদের নামে, চেহারায় কাউকেই জানি না! বাঁচি পুরোনো স্মৃতি নিয়ে!

*লেখক: শারমীন বানু আনাম, চিকিৎসক