নিকলাস এখন হলিউডের উদীয়মান তারকার বাবা

বাবার কোলে নিকিতা

হেই রহমান, হুর মোর দু (কেমন আছ)? সেনার দু ইয়েন মেই (আমাকে চিনতে পেরেছ)? আরে, এ দেখি সেই নিকলাস, আমার এক কলিগ উলরিকার ছেলে। বহু বছর পরে হঠাৎ এক চেনা মুখ সামনে হাজির। তা তোমরা কেমন আছ? তোমার মা কেমন আছে? মেয়ে নিকিতার খবর কী? একগাদা প্রশ্ন করলাম ঝটপট করে। সেই সতেরো বছর আগে তাকে দেখেছি সদেরতেলিয়েতে (S dert lje), স্টকহোমের অদূরে একটি শহরে।

নিকলাস চাকরি করে সুইডিশ রেলে। সে রেলগাড়ির চালক, বয়স মাত্র কুড়ি বছর। কলেজ শেষ করেই চাকরিতে ঢুকেছে। নিকলাস রাতে যখন রেল চালায়, ডিউটি শেষে ক্যামেরার মাধ্যমে দেখে কেউ রেলের বগিতে থেকে গেল কি না। কারণ, অনেক সময় দেখা যায়, মাঝরাতে কোনো কোনো যাত্রী এত বেশি পরিমাণ ড্রিংক করেছেন যে স্টেশনে না নেমে ঘুমিয়ে গেছেন বা ভুলে গেছেন নামতে, তখন ট্রেনের মধ্যে থাকতে চেষ্টা করেন। নিকলাস তাঁদের ঘুম থেকে তুলে প্রায়ই সাহায্য করে ট্যাক্সিতে করে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিতে।

আজ ঘটেছে কিছুটা ভিন্ন। হঠাৎ দেখে একটি মেয়ে, বয়স ১৬-১৭ হবে, শেষের বগিতে বসে কাঁদছে। রাত অনেক অথচ একা একটি সুন্দরী মেয়ে বাড়িতে না গিয়ে ট্রেনে বসে কাঁদছে কেন? কী ব্যাপার? এই মেয়ে তোমার নাম কী? একা একা বসে কাঁদছই–বা কেন? মেয়েটি বলল, আমার নাম ক্রিস্টিনা, মা মারা গেছে, বাবার সঙ্গে থাকি। বাবা নতুন বিয়ে করেছে, আমার তেমন খোঁজখবর নেয় না। বাড়িতে যেতে মন চাইছে না, তাই বসে আছি। নিকলাস বলল, আমি এখন ট্রেন বন্ধ করে বাড়িতে চলে যাব। তোমাকে একা রেখে যেতে পারব না। তুমি আমার সঙ্গে চলো, তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব। ক্রিস্টিনা রাজি হলো। নিকলাস তাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিল। সে ট্যাক্সিতে করে নিজের বাড়িতে এল।

কিছুদিন যেতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবার ক্রিস্টিনা বাড়িতে যেতে নারাজ। কী করবে নিকলাস? বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে। নিকলাসের মা উলরিকা বিষয়টি জানার পর ক্রিস্টিনাকে বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয়। সময়ের সঙ্গে নিকলাস ও ক্রিস্টিনার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। তাদের ঘর আলো করে আসে একটি কন্যাসন্তান, নাম নিকিতা।

উলরিকা, নিকলাসের মা তখন আমার কোম্পানিতে কাজ করেন। তিনি তাঁর ছেলের মেয়ে নিকিতার জন্মদিনে আমাদের দাওয়াত করেছিলেন। আমি দাওয়াতে গিয়েছিলাম সেদিন নিকিতার জন্মদিনে, সেই ছোট্ট শহর সদেরতেলিয়েতে। প্রথম যেদিন নিকিতাকে দেখেছিলাম, তখন তার বয়স মাত্র দুই বছর।

হঠাৎ এত বছর পর গতকাল নিকলাসের সঙ্গে আমার রেলস্টেশনে দেখা। একথা–সেকথা বলার পর জিজ্ঞাসা করলাম নিকিতার কথা। নিকলাস বলল, সে তিন বছর বয়সে তার মা ক্রিস্টিনার সঙ্গে আমেরিকায় চলে যায়। আরও বলল, ক্রিস্টিনা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে এক আমেরিকানকে বিয়ে করে হলিউডে স্থায়ী হয়েছে। সেই থেকে নিকিতা আর সুইডেনে আসেনি এবং আমাদেরও দেখা হয়নি।
আমি আবারও জিজ্ঞাসা করলাম, নিকিতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আছে কি না! নিকলাস বলল না, তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তবে গত বছর সামারে সুইডেনে এসেছিল একটি ছবির শুটিংয়ে। খবরটি পেয়ে অনেক চেষ্টা করেছিলাম দেখা করার, কিন্তু দেখা মেলেনি। তবে মুঠোফোনে কথা হয়েছিল। তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া উচিত, যোগাযোগ থাকা উচিত, কিন্তু বুঝিয়েও লাভ হয়নি। আমার সব চেষ্টা বিফলে গেছে। নিকিতা অতীতের স্মৃতিগুলো ভুলে গেছে। তিন বছর বয়সের কী স্মৃতিই–বা তার মনে আছে! তা ছাড়া সে এখন হলিউডের উদীয়মান তারকা। সব মিলিয়ে ভালোই চলছে। আমি যে জীবনের প্রথম তিনটি বছর তার সংস্পর্শে ছিলাম, সে কথা তার মনে নেই। মনে থাকবেই–বা কী করে সে তো বহু বছর আগের কথা। অতীতের স্মৃতিচারণা করতে করতে ট্রেন এসে গেল, এবার বিদায়ের পালা।

সবশেষ আমি জানতে চাইলাম উলরিকা ও নিকলাসের বর্তমান অবস্থার কথা। উলরিকা সদেরতেলিয়েতেই বসবাস করছে। নিকলাস নতুন করে বিয়ে করেছে। সে থাকে স্টকহোমের অদূরে টুম্বাতে এবং ভালোই আছে।

মস্ত বড় পৃথিবী তারপরও হঠাৎ তা–ও যেন ছোট্ট একটি গণ্ডি যেখানে দেখা মেলে বহুদিনের চেনা মুখ। কখনো সেসব মুখে আমরা শুনতে পাই ভালো খবর, আবার কখনো মন্দ। ভাবতে ভাবতে আমি নিকলাসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গন্তব্যে পা বাড়ালাম।

লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন[email protected]