মাস্ক পরে নিশ্বাস নেবেন; না কবরে হিমশীতলে যাবেন মাস্ক ছাড়া

মাস্ক
ফাইল ছবি

গত বছর আমার করোনা পজিটিভ হওয়ার পরপরই প্রথম কাজ ছিল, পেশেন্ট বাদে কার কার সঙ্গে সে সপ্তাহে ইন্টারঅ্যাক্ট করেছি, তাদের কথা ভাবা। দুই দিন আগেই প্রতিবেশীর মেয়ের সঙ্গে খেলেছি—সুস্থ ছিলাম। ও ওর বাবল সোপ নিয়ে আমার কাছে এসেছে, ব্লো করে বাবল বানিয়ে দিয়েছি। শঙ্কায় মন ছোট হয়ে গেল, এতটুকু বাচ্চার আমার জন্য কোভিড হবে? পেশেন্ট এনকাউন্টার তো মাস্ক, গ্লাভস পরে, সেখানে আমার থেকে তাদের হওয়ার আশঙ্কা শূন্য!
সে যা–ই হোক, স্বামী আমার প্রতিটি পারসোনাল কনট্যাক্টকে ট্রেস করে তাদের জানিয়েছে, তাদের কন্ডিশন মনিটর করতে, আইসোলেশনে থাকতে আর টেস্ট করাতে।

বাঙালি আমরা মনে করি, অসুস্থ হওয়া মানে গজব! লুকোচুরির ব্যাপার। এটার জন্য যে সচেতনতা; তাই নেই। ভয় পাই, কেউ কোভিড হয়েছে জানলে একঘরে করে দেবে! মিশবে না।
আসলে এ সময় নিজেদেরই সবার থেকে দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। কোভিডের উপসর্গ দেখা দিলেই, নিজেদের পরিবারের সবার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। তারা যাতে অসুস্থ না হয়।

এটা দুমুখী প্রক্রিয়া। আপনার হয়তো ভাত বেড়ে কেউ বাতাস করতে করতে খাওয়াবে না—সেটা প্র্যাকটিক্যাল নয়! তবে ভাতটা দিয়ে গেলে, বেড়ে খাওয়ার মতো হাতের জোর আর সে ঘটিবাটি মাজার কবজির জোর নিশ্চয়ই আছে। তাদের অসুস্থ বানানোর কোনো কারণ নেই। তবে উপসর্গ দেখা দেওয়ার সময় একসঙ্গে থাকলে, তারাও কোভিডে এক্সপোজড! মানে হয়তো জীবাণু তাদের মধ্যেও বেড়ে উঠছে। তাই বলে তাদের দ্রুত অসুস্থ বানানোর কোনো কারণ নেই। আইসোলেশনে থাকুন, খাওয়াদাওয়া করুন। জোরে শ্বাস নিন মাঝেমধ্যে। কদিন সাফার করে হয়তো ভালো হয়ে যাবেন।
আর সবচেয়ে দরকারি যে কাজ উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর, সাত দিন আগে থেকে কার কার সঙ্গে মিশেছেন, তাদের খুঁজে বের করে জানানো যে আপনার উপসর্গ দেখা দিয়েছে, এখন তারাও যেন নিজেদের দিকে খেয়াল রাখে—উপসর্গ দেখা দিলে নিজেদের পরীক্ষা করায়।

মাস্ক পরেই দরকার হলে ঘরের লোকদের সঙ্গে কথা বলবেন। পানির গ্লাসও শেয়ার করবেন না। সর্বোপরি, নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করুন যেন, নিজেরা বা পরিবারের কেউ অসুস্থ না হয়! অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন; পরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন, টেনশন না করে! দরকার হলে হসপিটালে চলে যান!
কোভিডে সবার হাসপাতালে যাওয়ার দরকার হয় না। অসুস্থতা যদিও এক বা দুই সপ্তাহে সেরে যায় না। কোভিডের সমস্যা; এটার উপসর্গ অনেক দিন থাকে। তবে পুরো সময়ও ওষুধ খেতে হয় না।

ঘ্রাণশক্তি ও খাবারের স্বাদ কি সবার যায়?

সবার ঘ্রাণশক্তি বা খাবারের স্বাদ চলে যায় না। অনেকেরই ভীষণ মৃদু উপসর্গ—জ্বরও হয় না। অনেকের খালি মৃদু কাশি, অ্যালার্জি থাকলে বোঝাই যায় না, এলার্জি না কোভিড। কনজেশন, মাথাব্যথা, সাইনাসের প্রদাহ, কাশিই প্রধান উপসর্গ। অনেকেরই ডায়রিয়া, পেট খারাপ হয়। রুচি কমে যায়। মনোযোগ কমে যায়। আর সত্যি বলতে, ভয় পাই আমরা সবাই—অজানা নতুন এই সংক্রমণে আক্রান্ত হলেই—সেটাও ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়।

অ্যালার্জি, অ্যাজমার রোগীদের সাধারণ সর্দি, কাশিই দুই মাস পর্যন্ত থাকতে পারে, কোভিডেও তাই তাদের সাফারিংটা বেশি সময় ধরে থাকে। ভয় না পেয়ে দরকারি চিকিৎসা নিন। সমস্যা যদি স্যাচুরেশন কমে যায়। এখানে অবশ্য ৯০ শতাংশের নিচে না গেলে ইদানীং হাসপাতালেও ভর্তি নেয় না। ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে ম্যানেজ করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। প্রতিটি সিট একজন মরণাপন্ন রোগীর জন্য ভীষণ দরকারি—তাই যারা স্ট্যাবল, তাদের হসপিটালের সিট দখল করতে দেওয়া হয় না। আইসিইউ তো শুধু মরণাপন্ন রোগীদের জন্যই!

এত সব লেখার উদ্দেশ্য,
—অপ্রয়োজনীয় জনসমাগম পরিহার করুন।
—মাস্ক পরুন সর্বদা জনসমাগমে।

—যদি জানেন কেউ অসুস্থ, তাদের সঙ্গে বাইরে যাওয়া বা দেখা করা বন্ধ করুন।
—যদি এক্সপোজ হয়েই যান, নিজেদের অজান্তে—সবাইকে জানান, নিজেদের আইসোলেশনে নিয়ে যান। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাকমতো করুন।
—উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন এবং যথাযথ চিকিৎসা নিন।
—চিকিৎসকের অফিসে মাস্ক ছাড়া যাবেন না। মাস্ক ছাড়া কোথাওই যাবেন না। বাজারেও না, মুদিদোকানেও না।
—আসলে কোথাওই যাবেন না যদি না প্রয়োজন পড়ে।

—এক্সপোজ হলে বিগত সাত দিন যার যার সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের অবশ্যই জানাবেন, যাতে তারা অন্তত নিজেদের নিয়ে ভাবার সময় পায়। সেম কাজ করবেন অসুস্থ হলে। রোগটি ছড়ানোর দায় আপনারও সেটা খারাপভাবে না নিয়ে, সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করুন।

—সর্বোপরি রোগটি যাতে আপনার বা আপনার পরিবারের কারও না হয়, তার জন্য যতটা সম্ভব দায়িত্বশীল ব্যবহার করা যায়, করুন। মনে রাখবেন বেঁচে থাকলে পার্টি হবে! বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে। মরে গেলে?—কুলখানি। আর সেখানে কয়জন উপস্থিত থাকবেন, সেটা সময়ই বলে দেবে।

—সুস্থ থাকুন, মাস্ক পরুন, জনসমাগম এড়িয়ে চলুন! বেঁচে থাকুন।

যারা এলিজেবল, মানে টিকার আওতায় পড়েন, অবশ্যই টিকা নিন। অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগী বা গুরুতর অসুস্থ রোগী, ডায়াবেটিস বা যেকোনো ক্রনিক মানে দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্ত লোকজন অবশ্যই টিকা নেবেন।

টিকা নেওয়ার পরও অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হতে পারেন, তাই সতর্কতার বিকল্প নেই। যদি টিকা নেওয়াকালীন বা অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়াকালীন কোনো কোভিড রোগীর সংস্পর্শে আসেন, কোভিড হবেই।

একবার কোভিড হলেও আপনি আবার কোভিডাক্রান্ত হতে পারেন—ভেবে নিশ্চিন্ত হবেন না যে, একবার হয়ে গেছে, আর হবে না। তাই সর্বদা মাস্ক পরুন, লোকজন থেকে দূরে থাকুন।

কোভিড হওয়ার পর ন্যাচারাল অ্যান্টিবডি তিন মাসের মতো থাকে, অনেকের অ্যান্টিবডি তৈরিই হয় না। তাই কোভিড হলেও, তার এক থেকে তিন মাসের মাঝে কোভিডের টিকা নিন। তারপরও আপনার গার্ড ডাউন করবেন না। মানে মাস্ক পরবেন আর লোকজনের কাছ থেকে সর্বদাই দূরে থাকবেন।

কোভিড কত দিন থাকবে, আমরা জানি না। সারা জীবনই আমরা কোভিডে আক্রান্ত হতে পারি। এই মাস্ক, সোশ্যাল ডিসট্যান্স হয়তো আমাদের নিত্যসঙ্গীই আপাতত। তাই মাস্ক আর সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের বিপক্ষে না গিয়ে, আসুন তাদের আপন করে নিই। মাস্ক পরেই আপনি সবকিছু করতে পারেন। ভেবে দেখুন নিশ্বাস নেবেন মাস্ক পরে; না, কবরের হিমশীতলে যাবেন মাস্ক ছাড়া!

* লেখক: চিকিৎসক, আমেরিকা,