নীরার শেষ চিঠি!

এখনো মানুষ মনের কথা প্রকাশ করতে চিঠির আশ্রয় নেয়। মডেল: অসিন
ছবি: সুমন ইউসুফ

আজ শুক্রবার, অফিস নেই। ঘুম থেকে ওঠার তাড়াও নেই। তবু মেসের কাঠের দরজায় ঠকঠকানিতে ঘুম ভেঙে গেছে আমার। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ডাক দিলাম।

- কে?

- আমি, ভাইজান।

গৃহকর্মী এসেছেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক অন্য রকম। উনি ডাকেন আমাদের ভাইজান। আমরা ডাকি খালা! আজব না ব্যাপারটা? জানি আজব লাগবে না, কারণ যখন আজব কিছু সর্বত্র ঘটে, তখন সেটা স্বাভাবিক লাগে।

অন্য শুক্রবারে এসে চুপচাপ রান্না করে চলে গেলেও আজ খালা দরজা ঠকঠক করে ডেকেছেন। কারণ কী!

ঘুমজড়ানো কণ্ঠে কিছুটা বিরক্তির সুরে জানতে চাইলাম।

- কী হয়েছে? মেসে কি ডাকাত পড়েছে?

সংলাপটা আমাদের গ্রামে হাসমত চাচার। উনাকে কেউ জোরে ডাক দিলে এ সংলাপ বলতেন। শহরে আমার বাড়ি নেই, মেসে থাকি। তাই এভাবেই বলতে হলো আমাকে।

একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে খালা বললেন,

- একটা মাইয়া আপনারে এইডা দিবার কইল। একটু আগে দিয়া গেছে। তাই ডাক দিলাম।

খামের ওপর হাতের লেখা দেখেই বুঝে ফেলেছি এটা নীরার লেখা। ও কখনো আমার মেসে আসে না। তাই খালা তাকে চেনেন না। অসম্ভব চমক দিতে পারে নীরা। হয়তো এটা কোনো চমকই হবে তার।

আরে!

নীরাকে তো পরিচয় করে দেওয়া হয়নি আপনাদের সঙ্গে। নীরার সঙ্গে বেশ কয়েক বছরের সম্পর্ক আমার। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমাদের সম্পর্ক একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছে।

নীরার বাবার চোখে যোগ্য হয়ে উঠতে হয়েছে আমাকে। কিছুটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আর কিছুটা আমাকে ভালো লেগেছে বলেই তিনি মেনে নিয়েছেন অবশেষে।

তারপরও পারিবারিকভাবে জানাশোনার জন্য নীরার মামা গিয়েছেন গতকাল শ্রীপুরে, বিয়ের আগে যেমন জানাশোনা করে, সে রকম আরকি।

শ্রীপুর আবার আমার মামার বাড়ি। আমার বাবার বাড়ি বা আমাদের বাড়ি নেই, আসলেই নেই! মামার বাড়িতে থেকেই বেড়ে ওঠা, স্কুল, কলেজ সব সেখানেই।

নীরা হয়তো চূড়ান্ত খবরটা দেওয়ার তর সইতে পারছিল না। তাই এত ভোরে আমাকে চমক দিতে চিরকুট রেখে গেছে। কী আছে চিঠিতে। খুলে দেখা যাক কী বলে।

মুহিন,

মামা ফিরে এসেছেন। তুমি এত বড় সত্য লুকিয়ে রেখে ঠিক করোনি। বাবা তো পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন কোনো বীরাঙ্গনার ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন না। আর আমিও বাবার অবাধ্য হতে পারব না কখনো। আর কখনো আমাদের কথা হবে না, দেখা হবে না। এটাই শেষ চিঠি তোমাকে লেখা। ভালো থেকো।

নীরা।’

কখন যে চিরকুট ভিজে গেল আমার চোখের গড়িয়ে পড়া জলে, বুঝে উঠতে পারিনি।

এ জল মোটেও নীরার চলে যাওয়ার জন্য না।

নীরার বলে যাওয়ার জন্য! আমি বীরাঙ্গনার সন্তান! এ কথা বলে যাওয়ার জন্য।

এ জল মোটেও দুঃখের নয়, সুখের।