নীল–গোলাপি খামে চিঠি স্যার হুমায়ূন আহমেদকে

বিটিভিতে ‘বহুব্রীহি’ প্রচারের পর থেকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মামা ও কাদের চরিত্র দুটি
ফাইল ছবি

১৯ জুলাই বিষণ্ন একটা দিন। বৃষ্টি হচ্ছে সারা দিন। মুনা বসে আছে বারান্দায়। বৃষ্টির ছাঁট লেগে ভিজে যাচ্ছে ও। হাতে নিয়ে বসেছে গোলাপি প্যাড, নীল কলমও আছে। প্রিয় লেখকের কাছে না লেখা চিঠিটা আজ ও শেষ করবেই।

প্রিয় স্যার,

‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’ সায়েন্স ফিকশান বইটা সেই কবে পড়েছি। জীবনের প্রথম মনে মনে ভয় হয়েছিল ভালোবাসার মানুষগুলোকে মহাকাশে হারিয়ে ফেলার। খুব ইচ্ছা হতো তখন লিখতে স্যার, গল্পে গল্পে হলেও ভালোবাসার মানুষগুলোকে কক্ষনো মহাকাশে হারিয়ে যেতে দেবেন না।

তারপর শুরু হয়েছিল নাটক ‘বহুব্রীহি’। বই হাতে এসেছে অনেক পরে। মামা, কাদেরসহ সবাইকে কেন যেন নিজের পরিবারের অংশ মনে হয়েছিল। যেন নিজের আটপৌরে জীবনের অংশ। সবাই যখন জীবনের প্রয়োজনে ছিটকে গেল, খুব লিখতে ইচ্ছা করছিল স্যার, জীবনের শেষটা ওদের সাদামাটা প্রিয়জনের মুখ দেখে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কাটিয়ে যেতে দিন তো। ছোট ছোট সুখের জীবন কেন চিরস্থায়ী হয় না।
তারপর এল ‘অয়োময়’। গ্রামের জীবন। প্রথম পরিচয়। নারী–পুরুষের ভেদাভেদ। মনে হয়েছিল চির শহরবাসী আমার অন্য পৃথিবীর কোনো কাহিনি। লিখতে ইচ্ছা করছিল আপনাকে, কলমের শক্তিতে মুছে দিন বিভেদ, অন্যায়; উঠে আসুক সাম্য।

দেখলাম নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’। মুনা সে নাটকের নায়িকা। আমার নামে নাম। সুন্দর–কোমল মুনা নামের মেয়েটার স্বপ্নমাখা চোখে ছিল আটপৌরে একজন। তত দিনে ভালোবাসার তীব্রতা কী কঠিনভাবে বুঝতে শিখেছি। তারপর সেই কোমল মেয়েটিকেই ভালোবাসাহীনভাবে কঠিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হয়েছিল। মোড়ের দোকানের বাকের ভাইকেও হারতে হয়েছিল অন্যায়ের কাছে। জীবনছোঁয়া কাহিনি। খুব চাইছিলাম লিখতে, বদলে দিন না মুনার জীবনটাকেই আপনি।

আবদুল কাদের, আসাদুজ্জামান নূর ও লুৎফর রহমান জর্জ ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে
ফাইল ছবি

একটা সময়ে ভ্রমণের নেশা হয়েছিল বই পড়ে পড়ে। ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ পড়ে নর্থ ডাকোটাতে যেতে চাইত মন; ‘যশোয়া বৃক্ষের দেশে’ পড়ে মন থাকত ক্যালিফোর্নিয়ার কোনো মরুতে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে অসুস্থ আপনার সঙ্গে আমিও ছিলাম। তারপর একদিন জানলাম, আপনার ক্যানসারের কথা। খুব লিখতে ইচ্ছা করছিল, বদলে দিন নিজের জীবনের গল্পটা, প্লিজ।

আমার খুব ইচ্ছা ছিল কোনো এক খোলা আকাশের নিচে চারদিকে কাচঘেরা একটা কফি শপ থাকবে আমার। দেয়ালটা হবে হালকা নীল, ছাদ হালকা গোলাপি, কফি দেওয়া হবে হালকা গোলাপি আর হালকা নীল কাপে, কাচের সাদা ফুল তোলা চামচে, এক পাশে থাকবে আপনার সব বই, কফি খেতে খেতে মুগ্ধ পাঠক ভুলে যাবে জীবনের সব না পাওয়া অতৃপ্তির কাব্য। এ রকম ঘোর বর্ষণে মেঘ বলেছে যাব যাব বা তেঁতুল বনে ভালোবাসার প্রেমিক–প্রেমিকারা বৃষ্টি দেখবে কাচঘরে মুগ্ধ হয়ে। আপনার বই পড়বে। আপনি তো এখন মেঘের ওপরে বাড়ি করেছেন। অভিমানী কেউ কেউ লিখে যাবে খোলা চিঠি, নতুন নতুন গল্প উপন্যাসের অপেক্ষায় আছি কিন্তু। আপনি তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে লিখবেন আবার।

সাউন্ড সিস্টেমে বাজবে ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো এক বর্ষায়’।

ইতি,
আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক
মুনা