পৃথিবীর দুর্দিনে ছোটরা ছোটদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াল

শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তীর নির্দেশনা ও পরিচালনায় কলাকারের আর্টস ইউকের নতুন উদ্যোগ হলো শিশুশিল্পীদের সংগীত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইউনিসেফের শিশুদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা।

কলাকারের প্রযোজনা ‘মিউজিক্যাল মাস্কস’, ছোটদের নিয়ে হিন্দুস্তানি, কর্ণাটকি আর পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যান্ড। ব্যান্ডের সবার বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। তবলায় কলকাতা থেকে আর্চিক ব্যানার্জী, হিন্দুস্তানি আর কর্ণাটকি সংগীতে বেঙ্গালুরু থেকে ১৩ বছরের শ্রীনিবাস গিরিধার, পাশ্চাত্য সংগীতে উর্বী অধরা, পূর্বা মধুরা, ড্রামসে মোজেস অমৃত জেকবস।

ব্যান্ডের প্রথম অনুষ্ঠান ‘মুক্তি’ আগামীকাল ১৪ অগাস্ট ব্রিটেনের সময় বেলা তিনটায় শুরু হবে (ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা আর বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা)। অনুষ্ঠানের আয়ের অর্থ যাবে ইউনিসেফের শিশুদের জন্য।

এদিনের অনুষ্ঠানে মিউজিক্যাল মাস্কসের ছোটদের সঙ্গে যোগ দেবে মুম্বাই থেকে মুরাদাবাদ ঘরানার ৪ জন শিশু সারেঙ্গীবাদক, একজন শিশু তবলাবাদক। এরা প্রত্যেকে বিখ্যাত সারেঙ্গীবাদক ওস্তাদ গুলাম সাবির খান সাহেবের শিষ্য। লন্ডন থেকে অনুষ্ঠানে অংশ নেবে ইন্দ্রাণী দত্ত কত্থক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দুই শিশুশিল্পী দিঠি বসু ও প্রথম চৌধুরী।

কলাকার আর্টস ইউকে মানেই বিশ্বমানের অসাধারণ সব অনুষ্ঠান, যে অনুষ্ঠানগুলো দেখার জন্য সংগীতপিপাসু দর্শক অপেক্ষায় থাকেন প্রতি শনিবার। এই বছর এপ্রিল মাস থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার পর সংগীতগুরু পণ্ডিত এ কাননের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্দেশ্যে কলাকারের ফেসবুক অনলাইন অনুষ্ঠান শুরু হয়। শিল্পীরা যোগ দিয়েছেন অনুষ্ঠানে, কথা বলেছেন গুরু-শিষ্য পরম্পরা নিয়ে, পরিবেশন করেছেন অসামান্য এক-একটি সন্ধ্যা, যার রেশ থেকে যাবে বহুদিন। ওস্তাদ রাশিদ খান, ওস্তাদ সুজাত খান, ওস্তাদ শহীদ পারভেজ, ওস্তাদ মাশকুর আলী খান, পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জী, পণ্ডিত গৌরব মজুমদার, পণ্ডিত সঞ্জু সহায়, পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, পণ্ডিত বিজয় কিছলু, পণ্ডিত কুমার বোস, বিদুষী শুভ্রা গুহা, পণ্ডিত হিন্দোল মজুমদার, পণ্ডিত ধর্মবীর সিংহ, পণ্ডিত রূপক কুলকার্নি, শ্রী অনুপ জালটা, ডাক্তার রাধিকা চোপড়া, বাংলাদেশ থেকে লাইসা আহমেদ লিসা, শুভমিতা, রূপঙ্কর, তুষার দত্ত, ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, শ্রাবণী সেন যেমন থেকেছেন, তেমনি কলাকার বর্তমান যুগের শিল্পীদের নিয়েও অনুষ্ঠান হয়েছে। ইন্দ্রায়ুধ মজুমদার, চিরঞ্জিত মুখার্জী, রাগেশ্রী দাস, দীপাঞ্জন গুহা, ওমকার দাদারকার, রিম্পা শিব, ইন্দ্রাণী দত্ত, অসিন ভাটিয়া, কুমার সত্যম, দেবদীপ মিশ্র, এখন পর্যন্ত আর কোনো অনলাইন অনুষ্ঠানে এত কম সময় এমন মহাতারকা সমাবেশ দেখা যায়নি। ভারতের এনডিটিভি থেকে শুরু করে টেলিগ্রাফ—ভারতের বিপুল জনপ্রিয় সংবাদপত্রগুলোর শিরোনামেও জায়গা করে নিয়েছে কলাকার।

কানন সাহেবের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে কলাকার শুরু করেছে আরও কয়েকটি অনুষ্ঠান। মাসে একবার ‘গড সেন্ডস’ অনুষ্ঠানে থাকেন এমন সব শিল্পী, যাঁরা কোনো না কোনোভাবে সাধারণের চেয়ে বেশ কিছুটা আলাদা হয়েও সংগীত বা অন্য কোনো আর্ট ফর্মের উচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন। গড সেন্ডস অনুষ্ঠানে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে জন্মগতভাবে ডাউনসিনড্রোম রৌনক পাল সবাইকে হতবাক করেছে পিয়ানোবাদক হিসেবে। ভবিষ্যৎ অনুষ্ঠানে থাকবেন চেলোবাদক অনুপ বিশ্বাস আর জন্মান্ধ সেতারবাদক বালুজি শ্রীবাস্তব। জীবনের কোনো হতাশা, কোনো প্রতিবন্ধকতাই এঁদের সংগীতচিন্তার বিকাশ ঘটাতে বা শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পথে বাধা হতে পারেনি। এমন শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করে কলাকার আরও কত শত মানুষের মনে আশা জাগাল।

এত সবের পর নামমাত্র মূল্যে সংগীত শিক্ষার জন্য কলাকার নিয়মিত ওয়ার্কশপও আয়োজন করে, যেখানে সংগীত নৃত্য ও বাধ্য প্রশিক্ষণে থাকেন পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পীরা।

এ বিশাল কর্মযজ্ঞের অনুপ্রেরণা আর শক্তি কোথা থেকে পান, লন্ডনের একটা বড় লাইব্রেরিতে চাকরি করেন, সেই সঙ্গে বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত গান শেখান, নিজের অনেক অনুষ্ঠান থাকে—সবকিছু পরিচালনা করতে ক্লান্ত লাগে না? চন্দ্রাকে এই প্রশ্ন কলাকারের অনেক দর্শকের।

চন্দ্রার বিনীত উত্তর, ‘আমার গুরু পণ্ডিত এ কানন ক্যানসার অপারেশনের পরও তিন মাসের বেশি গান শেখানো বন্ধ রাখেননি। কাজের মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকা। আর আমি যা করি, লাইব্রেরি ম্যানেজ করা, গান শেখানো, নিজে গান করা, নতুন শিল্পীদের প্রোমোট করা বা ছোটদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা—এর কোনোটাই তো আমার “কাজ” নয়—ভালোবাসা। কাজ করতে গেলে ক্লান্তি আসতেই পারে, কিন্তু ভালোবাসায় কি ক্লান্তি আসে? তাই যত দিন বেঁচে আছি, একটা দিন বসে থাকার সময় নেই। তবে কলাকারের যাত্রায় আমার সঙ্গীরাও তো আছেন, যাঁরা প্রতি মুহূর্তে আমার পাশে থেকে আমাকে সাহস আর ভরসা জুগিয়ে চলেছেন। কলাকারের এনইডি ড. সংযুক্তা ঘোষ, ড. সিদ্ধার্থ করগুপ্ত, পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জী, পণ্ডিত গৌরব মজুমদার, পণ্ডিত বিজয় কিছলু, লেখিকা মীনা ব্যানার্জী, প্রজেক্ট ডিরেক্টর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ইমরান খান, আমার ছাত্রী শতরূপা ঘোষ, অন্য টিম মেম্বার যাঁরা আছেন, কামালবীর নান্দ্রা, রুমা দাস রায়, সমরজিৎ দাস রায়, সুশান্ত সাহা, লাবণী সাহা, চন্দ্রেয়ী বসু, কলকাতা থেকে পাশে আছেন লেখন কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রকাশক চয়নিকা চক্রবর্তী—এঁদের নানা রকম সাহায্য ছাড়া আমি এত কিছু করতে পারতাম কি না, জানি না। আর রয়েছেন অগণিত দর্শক। সারা পৃথিবী থেকে যাঁরা আমার অনুষ্ঠান দেখেন। দিন দিন দর্শকসংখ্যা বাড়ছে, এই তো আমার প্রেরণা! কলাকার এখন শুধু আমার একার নয়, কলাকার এক বিশাল সাংগীতিক পরিবার!’