পৃথিবীর স্বর্গ জাভার পারাম্বানান মন্দিরে

পারাম্বানান মন্দিরের ভেতরে
ছবি: সংগৃহীত

আজকের আকাশটা পরিষ্কার নীল। ঠিক যেন আমার মাতৃভূমির আকাশের মতো। নানান দেশের নানান ভাষার মানুষের সংমিশ্রণে আমাদের এই পৃথিবী বিকশিত হলেও এই আকাশের মধ্যে কোনো অমিল দেখি না। মানুষের সভ্যতা, ভাষা, সাহিত্য–সংস্কৃতি আলাদা হলেও এই একটি জায়গায় কোনো নিয়ম বর্তায় না। এই রকম নানান হিজিবিজি চিন্তার মাধ্যমে শুরু হলো সকাল। আমার সফরসঙ্গী শ্রদ্ধেয় গালু ফেব্রি পুত্রা, ইন্দোনেশিয়ান শিক্ষক এখনো এসে পৌঁছাননি। তাই আমি তাঁর অপেক্ষায় বারান্দায় বসে আছি। এখানকার বাড়িগুলো আকারে ছোট, কিন্তু খুব ছিমছাম আর পরিপাটি। প্রতিটি বাড়ির সামনে রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। এরই মধ্যে স্যার এসে উপস্থিত তাঁর বাহিনীসহ। বাহিনীর সদস্য বলতে আমি আর সহপাঠীরা। আমাদের বিশাল বাহিনীর একমাত্র কর্ণধার স্যার গালু। আমাদের ভ্রমণের গন্তব্য পারাম্বানান মন্দির।

জাভার মানুষ মন্দিরকে চান্দি বলে ডাকে। পারাম্বানান মন্দির মধ্য জাভার সুন্দর স্থাপনাগুলোর একটি, যা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও জুটেছে। যদিও মন্দিরটি হিন্দুধর্মের বাহক। তবু এখানে সর্বশ্রেণির মানুষের ভিড় লক্ষণীয়। মন্দিরটি ইন্দোনেশিয়ার বৃহত্তম হিন্দু মন্দির।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পারাম্বানান মন্দিরটির নির্মাণকাজ নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শেষ হয়েছিল। রাকাই পিকাতান নামের রাজা ওই সময়ে জাভার শাসনকর্তা ছিলেন। তাঁর আমলে শুরু হয় মন্দির নির্মাণের কাজ। শেষ হয় রাজা দায়হা লোকাপালার শাসনামলে। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ অবশ্য মনে করেন, এই মন্দির নির্মাণ করেন রাজা সনজায়া।

যা–ই হোক, জাভার অলিগলি বেয়ে প্রায় ১৭ কিলোমিটার ভ্রমণ করে আমাদের জিপ এসে থামল পারাম্বানান মন্দিরের পার্কিং সাইডে। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলাম, কয়েক শ গাড়ি সারিবদ্ধ পার্কিং করা। বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশ হবে। গালু স্যার আগে থেকেই টিকিটের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তাই সাধারণ নিরাপত্তা কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রবেশ করলাম মূল মন্দিরের ভেতর। দরজা থেকে ৩০০ মিটার দূরে হাজারো গাছপালার মধ্যে দেখা যায় মন্দিরের চূড়া। মনটা আনন্দে ভরে গেল।

পারাম্বানান মন্দির
ছবি: লেখক

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যার দেশে দণ্ডায়মান এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম হিন্দু মন্দির, যা দ্বারা বোঝা যায় ইন্দোনেশিয়ার মানুষ কতটা ধর্মকে শ্রদ্ধা করে।

মন্দিরের মূল কাঠামোতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে তিনটি বড় মন্দির। যার একটি সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার, দেবতা বিষ্ণু ও শীবের। মন্দির তিনটি আকৃতিতে এক। মন্দিরের বাইরের দেয়ালগুলোতে স্থান পেয়েছে হিন্দুধর্মের অন্যান্য দেব-দেবীর সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধের চিত্র। অনেকটা হিন্দু মহাভারত, রামায়ণ, গীতার কাহিনি, যা পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া মন্দিরের সিঁড়ির হাতলে রয়েছে সিংহ ও কল্পতরুর খোদাই করা মূর্তি। পাশাপাশি দেয়ালের পাথরে খোদাই করা আছে জাভানিজ লিজেন্ড রারা জংগ্রায়ের মূর্তি। ইন্দোনেশিয়া একটি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হওয়ার কারণে এই মন্দির বিভিন্ন সময় সংস্কার করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ান সরকার ১৯৮৭-১৯৯৩ সালের মধ্যে বিষ্ণুমন্দির সম্পূর্ণ সংস্কার করে।

এই তিন মন্দির ছাড়াও মূল প্রাঙ্গণে রয়েছে তিনটি বাহন মন্দির, যা দেবতাদের বাহন হিসেবে পরিচিত। যার একটি গারুদা, নন্দি, হামসার ছোট মন্দির। এ ছাড়া রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ত্রিমূর্তি আর বাহন মন্দিরের সারিগুলোর মধ্য দিয়ে আর দুটি মন্দির।

আরও রয়েছে পারাম্বানান মন্দিরের চারটি গেটে চারটি ছোট মন্দির। চারদিকে সজ্জিতম করা হয়েছে কয়েক শ ছোট ছোট মন্দির দিয়ে, যার কিছু এখনো টিকে আছে, কিছু বিলুপ্ত। যা–ই হোক, মন্দিরগুলো দেবতাদের হলেও আপাতত এগুলো দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে দেখা মিলল কয়েকজন ইন্ডিয়ানের সঙ্গে। তাঁরা এসেছেন মন্দির আর দেবতাদর্শনে।

রামায়ণ নৃত্য
ছবি: লেখক

আমি অতি ভাগ্যবান যে সঙ্গে পেয়েছি আমার প্রিয় গালু স্যারকে। স্যার ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস আর হিন্দুধর্মকে একই সুতায় গেঁথে দিলেন। বাঙালির ছেলে হিসেবে টুকটাক হিন্দুধর্মের ইতিহাস জানি বলে স্যার আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে দেয়ালের বিস্তারিত বর্ণনাসহ নানান আলাপ জুড়ে দিলেন। সঙ্গে চলল ফটোসেশন আর পানি পান। যদিও বাংলাদেশে এখন শীতকাল আর জাভায় বর্ষাকাল, তারপরও সন্ধ্যার পর এখানকার মানুষ শীতের পোশাক পরিধান করে। পারাম্বানান মন্দিরের মূল কম্পাউন্ড ছেড়ে আমরা চললাম পাশে খোলা মাঠের দিকে। এই প্রথম জাভাতে দেখলাম সবুজ ঘাসে ঢাকা খোলা মাঠ। বাচ্চারা সেখানে নানা প্রকার খেলায় ব্যস্ত। গাছের ছায়ায় কেউ বসেছেন পরিবার নিয়ে আর কেউ প্রেয়সীর সঙ্গে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছেন।

তারপর চললাম মন্দিরের চারদিক দেখতে। এটা ঘুরে দেখতে আছে গাড়ি। গাড়িতে পূর্ণ যাত্রী হলেই ৩০ মিনিট পরপর সম্পূর্ণ মন্দির ভ্রমণের জন্য ছেড়ে যায়। আমাদের খোলা গাড়ি চলা শুরু করল। চারদিকে অসংখ্য ছোট–বড় বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির। এরপর আমাদের গাড়ি গিয়ে থামল নবনির্মিত একটি মন্দিরের সামনে। আমরা সবাই নেমে পড়লাম নতুন মন্দির দর্শনে। মন্দিরটিতে একই সঙ্গে চলছে নির্মাণ আর মেরামতের কাজ। পারাম্বানান মন্দিরের আদলেই নির্মিত হচ্ছে এই মন্দিরগুলো, যা আসলেই নয়নাভিরাম। মন্দিরের ভেতরে ২০ মিনিট সময় অতিবাহিত করে গাড়িতে এসে বসলাম আর আমাদের বহনকারী গাড়ি মন্দিরের বাইরের গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। আকাশের দিকে খেয়াল করতেই দেখলাম, সূর্য হেলে পড়ছে পশ্চিমের আকাশে।

নতুন মন্দিরে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

তারপর আমরা সবাই পাশের একটি রেস্তোরাঁয় জাভানিজ খাবারের স্বাদ নিলাম। ধীরে ধীরে জাভার আকাশে সন্ধ্যা নেমে এল। আমাদের গাড়ি একটু যেতেই থামল। একটা ইউটার্ন নিয়ে গাড়ি আবার প্রবেশ করল পারাম্বানান মন্দিরে। গাড়ি থেকে নামতেই আমরা সবাই হতবাক। ছোটবেলায় কার্টুনে দেখেছিলাম মানুষরূপী হনুমানকে, যে কিনা সীতাকে উদ্ধারে রামকে সাহায্য করেছিল। তারপর বড় হয়ে রামায়ণের কিছুটা পড়েছিলাম আর পঠিত বিষয়ের কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই পড়তে হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাধ বধ’ মহাকাব্য। এখানে দেখতে পেলাম বাস্তবের হনুমান আর সীতাকে, যাঁরা সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে প্রদর্শিত হয় রামায়ণ নৃত্য। অনেক বড় মঞ্চ, অনেকটা আমাদের মুক্ত মঞ্চের আদলে তৈরি। কিন্তু একসঙ্গে এখানে কয়েক হাজার দর্শনার্থী এ শো উপভোগ করতে পারেন। পঠিত বিষয় হওয়ার কারণে নৃত্য বুঝতে আমার সময় লাগল না। পাশে রয়েছেন গালু স্যার, আলোচনা আর নৃত্য দেখা চলল একসঙ্গে।

পার্থক্য শুধু পেলাম রাবণে, যাকে দশানন বলে জেনে এসেছি, জাভায় সেই দেশাননকে দেখলাম শুধু একটি মাথায়, আর গালু স্যারকে বোঝাতেই পারলাম না যে রাবণ দশানন। এভাবেই রাতের আঁধারে সাদা আর সোনালি আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল পারাম্বানান মন্দিরের চূড়া আর সীতার বিরহের সুরে মঞ্চে চলতে থাকল রামায়ণ নৃত্য।