প্যারিসের তুলনা প্যারিস নিজেই

অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা ও জ্ঞান–বিজ্ঞানের পুণ্যভূমি প্যারিস শহরকে নিজ চোখে দেখব আর বইয়ের পাতা থেকে সরাসরি নিজেকে ইতিহাসের দোরগোড়ায় নিয়ে যাব। আর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো গত সপ্তাহে।

সকাল ঠিক ৭টা ৩০ মিনিটে পা রাখলাম প্যারিসের বারসিতে। খুবই সুন্দর সকাল, চমৎকার আবহাওয়া। বিশাল সবুজ খোলা মাঠের মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলাম প্যারিসের মেট্রোরেল স্টেশনে। প্রথমে গন্তব্য হস স্টেশনে। (ফরাসি ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে মিল রেখে আমি স্থানগুলোর বাংলা নাম লিখেছি)। প্রথমে চিন্তা করলাম আগে একটু দেখি কীভাবে গন্তব্যে যাওয়া যায়। কারণ, জার্মানির সঙ্গে মেট্রোরেলের সিস্টেমের খানিকটা ভিন্নতা রয়েছে। তারপর গেলাম টিকিট কাউন্টারে। ইংরেজিতে বললাম আমার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য একটি টিকিট দিতে। কিন্তু তিনি ইংরেজি না জানায় আমাকে ইশারা করলেন অন্য কাউন্টারে যেতে। গেলাম। টিকিট কাউন্টারে ভদ্রমহিলা বুঝতে পারলেন আমি একজন ভ্রমণকারী। তাই আমার হাতে তুলে দিলেন একটি প্যারিসের ভ্রমণ গাইড বই।

এরপর মেট্রো-১ রেলে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরে অবাক হয়ে সামনের দিকে থাকলাম আর নিজের কাছে প্রশ্ন করলাম ট্রেন চলে কিন্তু ড্রাইভার কোথায়? পাশের জনের কাছে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলাম ট্রেনের চালক কোথায়? তিনি বললেন, এ ট্রেন ১৪ নম্বর মেট্রো কম্পিউটারনিয়ন্ত্রিত, চালক ছাড়া চলে। তখন একটি অন্য রকম অনুভূতি। হসে আমার প্রিয় শিক্ষার্থী আলমগীর অভ্যর্থনা জানাতে ও গ্রহণ করতে অপেক্ষায় ছিল।
তারপর প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আলমগীরের বাসায় বিশ্রাম নেওয়ার পর পরিকল্পনা অনুসারে বেরিয়ে পড়লাম প্যারিস দেখতে। প্রথমে গন্তব্য ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান জাদুঘর Cit des Sciences et de l'Industrie (City of Science and Industry)। ভবনের প্রাচুর্য দেখে অনেক দূর থেকে যেকোনো পর্যটক ছুটে আসবেন এখানে। তারপর গেলাম প্যারিস শহরের প্রধান আকর্ষণ আইফেল টাওয়ারে। টোর আইফেল স্টেশনে নামার পরই দূর থেকে দেখতে পেলাম সেই স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার। যার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের মাধ্যমে। নিজের ভেতরে কেমন যেন শিশুসুলভ আনন্দ অনুভূত হচ্ছিল। আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে পৌঁছে গেলাম পাঁচ মিনিট হেঁটে। সেখানে মিলিত হলাম বাকী উল্ল্যাহর সঙ্গে, যার সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্র হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সে পড়ত সাংবাদিকতা বিভাগে আর আমি ইংরেজিতে। যতই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল, ততই আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল। টাওয়ারের প্রায় ২০ হাজার বাতি ও ৩ হাজার প্রজেক্টর পুরো শহরকে করে তোলে অন্য রকম সুন্দর আর বর্ণিল।

১৮ হাজার ৩৮ খণ্ড লোহার তৈরি ছোট–বড় জোড়া দিয়ে টাওয়ারটি তৈরি করা হয়। সীমাহীন আনন্দ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ফেসবুকেও করে ফেললাম একটি লাইভ। টাওয়ারকে খুব কাছ থেকে দেখার জন্য ২৬ ইউরো দিয়ে কেটে ফেললাম টিকিট। তারপর টাওয়ারের ওপরে উঠলাম আর সমগ্র প্যারিস শহরকে চোখের একনজরে দেখে নিলাম। আর ভাবতে থাকলাম কেমন করে এত উঁচু, লোহার তৈরি টাওয়ার তৈরির চিন্তা সেই ১৮৮৯ সালে প্রকৌশলী আইফেলের মাথায় এল? শুধু তাই নয়, প্যারিস শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেখে মনে হবে বেশ পুরোনো আর অবাক করার মতো। টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় রেস্টুরেন্ট আর এক ছোট শপিং সেন্টার রয়েছে। টাওয়ার থেকে সেইন নদীর দৃশ্য দেখতে অন্য রকম সুন্দর। টাওয়ারের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো সন্ধ্যায় প্রতি ঘণ্টার শুরুতে পাঁচ মিনিট অন্য রকম আলোকসজ্জা যে কাউকে অবাক করে তুলবে। সব মিলিয়ে আইফেল টাওয়ার এক বিস্ময়কর স্থাপনা।
এরপরের দিন গিয়েছিলাম বাস্তিল দুর্গ ও ল্যুভর মিউজিয়াম দেখতে। হস থেকে মেট্রো করে বাস্তিল স্টেশনে নামলাম। মাটির নিচের স্টেশন থেকে উঠতেই চোখে পড়ল সুবিশাল বাস্তিল দুর্গটি। এটি ঐতিহাসিকভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ, যার পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এ বিপ্লব ছিল তদানীন্তন ফ্রান্সের শত শত বছর ধরে নির্যাতিত ও বঞ্চিত ‘থার্ড স্টেট’ বা সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই বিপ্লবের আগে সমগ্র ফ্রান্সের ৯৫ শতাংশ সম্পত্তির মালিক ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষ। অথচ সেই ৫ ভাগ মানুষই কোনো আয়কর দিতেন না। যাঁরা আয়কর দিতেন, তাঁরা তেমন কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারতেন না। এবং এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করতেন, তাঁদের এ বাস্তিল দুর্গে বন্দী করে নির্যাতন করা হতো। বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক। একবার কোনো বন্দী সেখানে প্রবেশ করলে জীবন নিয়ে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকত না। কারাগারের ভেতরেই মেরে ফেলা হতো অসংখ্য বন্দীকে। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই নির্বাচিত প্রতিনিধি, রক্ষীবাহিনীর সদস্য এবং বাস্তিল দুর্গের আশপাশের বিক্ষুব্ধ মানুষ বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে রওনা হয়। রক্তক্ষয় এড়াতে প্রতিনিধিরা দুর্গের প্রধান দ্য লোনের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব ছিল বাস্তিলে সাতজন রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া। দ্য লোন সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বিক্ষুব্ধ জনতার ঢেউ বাস্তিল দুর্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুর্গের সৈন্যরাও ভেতর থেকে কামান দাগাতে থাকে। এরপর চারদিক থেকে উত্তেজিত বিক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটায়। জয় হয় সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতার। ইতিহাসের পাতা থেকে সরাসরি চোখে দেখে নিজের মধ্যে এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে। এখানে ঘণ্টা দেড়েক সময় পার করে রওনা দিলাম সেই জগদ্বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে।

ঠিক ১২টা ৩০ মিনিটে ল্যুভর মিউজিয়ামে পৌঁছালাম। দূর থেকে মিউজিয়ামের পিরামিড আকৃতির প্রবেশমুখ যে কাউকে অভিভূত করবে। তারপর লম্বা লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে আমি ও আলমগীর প্রবেশ করলাম জগদ্বিখ্যাত মিউজিয়ামে। করোনার কারণে আমাদের টিকিট নিতে হয়েছিল অনলাইনে। প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই বিশাল মিউজিয়ামে অন্য কোনো শিল্পকর্মের দিকে চোখ না দিয়ে চলে গেলাম লেওনার্দো দা ভিঞ্চির শ্রেষ্ঠ ও জগদ্বিখ্যাত মোনালিসার ছবিটি দেখতে। দিকনির্দেশনা অনুসারে চলে গেলাম সেই মোনালিসার কাছে। ওই আর্ট গ্যালারিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম লম্বা লাইন। সম্পূর্ণ মিউজিয়ামে একমাত্র মোনালিসার ছবি দেখার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে এবং ছবির দুই পাশে তিনজন করে মোট ছয়জন লোক সারাক্ষণ পাহারা দেন। এ চিত্র আর অন্য কোনো শিল্পকর্মের জন্য দেখিনি। দীর্ঘ লাইনের পর মনভরে মোনালিসাকে দেখলাম, ছবি নিলাম, ভিডিও করলাম। তারপর মোনালিসার জীবনী পড়লাম। একে একে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিলাম আটটি বিভাগে বিভক্ত প্রাচীন মিসরীয় শিল্পবস্তুসমূহ, নিকট প্রাচ্যের শিল্পবস্তুসমূহ, গ্রিক শিল্পকলা, রোমান শিল্পবস্তুসমূহ, ইসলামি শিল্পকলা, ভাস্কর্য, আলংকারিক শিল্পকলা, চিত্রকর্মসমূহ, ছাপশিল্প ও অঙ্কনে। আর পছন্দের শিল্পকর্মের সঙ্গে ছবি তুলে নিলাম। এই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এত বড় মিউজিয়াম। এক দিন কিংবা মাত্র ছয় ঘণ্টায় সম্পূর্ণ ধারণ করা সম্ভব নয়।
সফরের তৃতীয় দিনের পরিকল্পনা অনুসারে চলে গেলাম ইউনেসকোর সদর দপ্তরে। অসাধারণ ভবনটি দেখে মন জুড়িয়ে গেল। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া আলোচিত ব্যক্তিদের নিয়ে ফেস দ্য ওয়ার্ড আর্ট গ্যালারি পরিদর্শন করলাম। একপর্যায়ে আফগানিস্তানের অবুঝ চিন্তিত শিশুর পেইন্টিংয়ে চোখ পড়ে নিজের মধ্যে কেমন যেন কষ্ট অনুভূত হলো। সেখানে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় পার করে সোজা হেঁটে চলে গেলাম মিউজিয়াম দ্য লিবারেশনে। অনেক দূর থেকে ভবনের মিনার যেকোনো পর্যটকের দৃষ্টি ধরে রাখবে। প্রতিটি টিকিটের দাম ১৪ ইউরো। কিন্তু নিচে লেখা আছে ইউরোপীয় শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র পাঁচ ইউরো। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাঁচ ইউরো দিয়ে টিকিট কেটে নিলাম। আর প্রথমে প্রবেশ করলাম নেপোলিয়ানের ডোমে।
ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এবং ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে জানতে ও স্বচোখে স্মৃতিলিপি দেখে অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা পেলাম। স্বচোখে দেখলাম নেপোলিয়ান ও তাঁর সৈনিকদের ব্যবহৃত অস্ত্র, নেপোলিয়ানে ঘোড়ার মমি, তরবারিসহ সৈনিকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস ও রাজকীয় পোশাক-পরিচ্ছদ, যা আমাকে নিয়ে গেছে বইয়ের পাতা থেকে ইতিহাসের দোরগোড়ায়। প্রায় ছয় ঘণ্টা পরিদর্শনের পর সোজা হাঁটা দিলাম আলেকজান্ডার ব্রিজের দিকে। এ তো ব্রিজ নয়, যেন এক ইতিহাসের ভাস্কর্যের তৈরি বই। অসাধারণ অসংখ্য ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আলেকজান্ডারের (তৃতীয়) বীরত্বগাথা। ব্রিজ পার হয়েই রওনা দিলাম এলিজি প্যালেস দেখতে, যেখানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সহধর্মিণী বাস করেন। চারদিকে পুলিশ আর পুলিশ। কঠিন পাহারায় ভবনটি ঘিরে রেখেছে। কাছে গিয়ে খুব তেমন একটা আভিজাত্য মনে হলো না। ইউরোপের প্রায় অন্যান্য সাধারণ মানুষের বাসভবনের মতোই মনে হলো।

তারপর সেইন নদীর টানেলে গেলাম স্বচোখে দেখতে, যে জায়গায় ১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস ডায়ানা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। প্রায় সন্ধ্যা নেমে এল। বাকী উল্ল্যাহ ফোন দিয়ে বলল যেন এনভার্স গির্জা দেখে তার বাসায় দাওয়াতে অংশগ্রহণ করি। এনভার্স গির্জার ওপরে উঠে দেখি এক অন্য রকম প্যারিস। পাহাড়ের চূড়ায় হাজারো পর্যটক প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। একটু অন্ধকার নেমে এলেই জ্যাক দেখালেন আগুন দিয়ে কয়েকটি অসাধারণ খেলা। মুহূর্তের মধ্যে করতালি আর অভিনন্দনে সবাই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে আর খেলা শেষে বৃষ্টির মতো সবাই তাঁকে বকশিশ দেওয়া শুরু করল।
আসলেই প্যারিসের তুলনা প্যারিস। হাজার বছরের পুরোনো প্যারিস সম্পর্কে জানতে হাজার বছর লেগে যাবে। এত সমৃদ্ধ শহর—প্রতিটি রাস্তা, রাস্তার মোড় এমনকি মানুষের ঘরবাড়িসুদ্ধ ভাস্কর্যের চিত্র, শিল্পকর্মে ইতিহাস–ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলেছে। এ যেন শিল্পকলা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বর্গরাজ্য।