প্রবাসী আমরা একে অপরের আপনজন

আঞ্জুমান আরা বেবি আপা-মাসুম ভাই
আঞ্জুমান আরা বেবি আপা-মাসুম ভাই

প্রেমের সংজ্ঞায় সেখানে বাঁধি নিত্য দিনের জীবন। যেখানে আকাশ নেমে আসে অন্তরঙ্গ আতিথেয়তায়। কোনো এক দুর্লভ সময়ের অনুভূতি আজও তাপমাত্রা বাড়ায় জীবনপ্রবাহে, ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন স্বাদে আজও জাগে সেই উত্তাপ। 
বন্দরনগরী বলব, নাকি প্রকৃতির অকৃপণ প্রেমের উপহার তিলোত্তমা নগরী চট্টগ্রাম! ছেলেটি প্রকৃতি ভালোবাসত, তাই রূপের দেবী চট্টগ্রামকে ভালোবেসে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়তে গেল। প্রথম বর্ষ নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ব্যস্ততায় কেটে গেল৷ দ্বিতীয় বর্ষে চাঁপাফুলের মতোই শুভ্র সতেজ উচ্ছল একটি মেয়ে তার হৃদয়ে আলতো আঁচড় কেটে ছেলেটির জীবন রাঙিয়ে তুলল। ছেলেটির নিঃসঙ্গ জীবনে সুখে-দুঃখে মেয়েটি ছায়ার মতো লেগে থাকতে শুরু করল। এভাবেই তারা একে অপরের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়ল। মাসুম ভাই কুমিল্লা থেকে আর বেবি আপা ঢাকা থেকে পড়তে এসেছিলেন এখানে। প্রথমে বন্ধুত্ব, প্রেম, প্রণয় এবং সুখী দাম্পত্য জীবনযাপন। তাঁরা সিডনির বাংলা কমিউনিটির খুবই পরিচিত প্রিয়মুখ; আঞ্জুমান আরা বেবি আপা-মাসুম ভাই দম্পতি৷ পেশায় দুজনই চিকিৎসক। বিয়ের পর তাঁরা প্রথমে নিউজিল্যান্ড তারপর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

অনুষ্ঠানে সমবেত অতিথিরা
অনুষ্ঠানে সমবেত অতিথিরা


নিজ মাতৃভূমির গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কোনো দেশে যখন আমরা বাস করি, তখন সে দেশে আমরা বিদেশি বা প্রবাসী হয়ে যাই। প্রিয়জনের সান্নিধ্য, পেছনে ফেলে আসা স্মৃতি, সোনালি শৈশব, কাদামাটির মেঠো পথ হাতছানি দেয় প্রতিটি প্রবাসি বাঙালিকে। ব্যস্ত শহরে কর্মব্যস্ততা, দিনের ক্লান্তি শেষে নিজ মাতৃভূমিতে ফেলে আসা প্রিয় মানুষ, তাদের সঙ্গ ও স্মৃতি প্রত্যেক প্রবাসীর গহিন হৃদয়ে আঁচড় কাটে৷ শূন্যতায় বুক ভেঙে যায়। তাই প্রবাসে হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ১২ মাসে ১৩ পার্বণের বৈচিত্র্যের রংতুলির আঁচড়ে সাজাতে সচেষ্ট থাকে প্রতিটি বাঙালি। এরই ধারাবাহিকতায় বেবি আপা ও মাসুম আয়োজন করেছিলেন এক অনুষ্ঠানের৷
গত ২৭ ডিসেম্বর ছিল তাঁদের ২৫তম বিবাহবার্ষিকী৷ এ উপলক্ষে তাঁরা আয়োজন করেন হাউস ওয়ারমিং পার্টি। সত্যি বলতে কি, প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে যে দেশপ্রেম আর সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি যে দরদ, তা বিশ্বের অন্য কোনো জাতির মধ্যে দেখা যায় না। সমৃদ্ধ জাতি গঠনে সুস্থ সাহিত্যচর্চায় বাংলা কমিউনিটির অবদান এ ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। এই দূর পরবাসের জীবনে শিল্প-সাহিত্যচর্চা বেশ কষ্টসাধ্য। প্রবাসের মূলধারায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মের জন্য বাংলা সংস্কৃতিচর্চার এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি হয় এখানকার প্রবাসীদের আয়োজিত বিভিন্ন উৎসব, পার্বণ বা স্বদেশি কৃষ্টি-কালচারের মাধ্যমে। প্রথম প্রজন্মের সঙ্গে দ্বিতীয় প্রজন্মের মানসিক টানাপোড়েন ও অন্তর্দ্বন্দ্ব নানান দ্বিমুখী উপলব্ধি থেকেই বেবি আপা, মাসুম ভাই আয়োজন করেছিলেন তাঁদের

বিবাহবার্ষিকীর কেক
বিবাহবার্ষিকীর কেক

বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানের। উদ্দেশ্য একটাই, বিদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে বোঝানো, আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
আমাদের দেশের বিয়ের উৎসব অনেক রঙিন হয়, কনে বাবার বাড়ি পর করে শ্বশুরবাড়ি আপন করে নেওয়ার মাঝে থাকে বিষাদ আর আনন্দে মাখামাখি আত্মতৃপ্তি। আপার দুই মেয়ে মুন ও নুহামনি, আপার বড় মেয়ের জামাই আশফাকুর রহমান ও তাঁর ভাই শিশির অভিনীত একটি নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে সেদিন এ বিষয়গুলোই তুলে ধরা হয়। তাঁদের বিশাল বাড়ির আঙিনায় সেদিন তারার মেলা বসেছিল৷ বাংলাদেশ থেকে আসা অথবা এখানে জন্মেছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমন কচি-কাঁচার আসরে নিজের দেশ, দেশের মানুষ, দেশীয় খাবার আর আপন সংস্কৃতি তুলে ধরার গৌরব অনুষ্ঠানে আগত সবার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে তাঁদের বড় মেয়ের শ্বশুর আফিকুর রহমান এসেছিলেন। প্রবাসে নতুন প্রজন্মকে বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় আর লালন করার চেষ্টা তাঁকেও দারুণ আলোড়িত করেছে। প্রাণের টানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড থেকে সোহেল-আঁখি, ব্রিজব্রেন থেকে আসা চম্পক-মিতালি চক্রবর্তী, পাশের সাবারব ক্যালিভ্যালি থেকে আসাদ জামান-রুক্সানা হুসাইন, মতি রহমান-মুনমুন, নেওয়াজ-মিলি, আশিক-মিথিলা, আশরাফ-সাথি ও শফিক মজুমদার দম্পতিসহ আরও অনেক বাঙালি পরিবার তাদের ছেলেমেয়েসহ এসেছিল। নাগরিক জীবনের কর্মব্যস্ততার মাঝেও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অতিথির সমাগমে মুখরিত হয়ে উঠেছিল বিশাল বাড়ির সবুজ ঘাসের আঙিনাটি।

বেবি-মাসুম দম্পতি পরিবারের সদস্যরা
বেবি-মাসুম দম্পতি পরিবারের সদস্যরা

ভাষা মানে শুধু সংস্কৃতি-কৃষ্টি বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তি নয়, ভাষা মানে অর্থনীতিও। এই ভাষাগত অর্থনীতির ব্যাপারটা প্রথম প্রজন্মের প্রবাসীরা প্রতিদিনই অনুভব করেন। একসময় গুটিকয়েক বাংলাদেশির মধ্যে পরিচয় থাকলেও এখন তা বিন্দু থেকে সিন্ধু পর্যায়ে পৌঁছেছে। একই জনপদের মানুষগুলো অচেনা অপরিচিত হলেও জীবনের তাগিদে আমরা প্রবাসীরা এখন একে অপরের আপনজন। এভাবেই সুন্দর, রৌদ্রোজ্জ্বল, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার এই সিডনি শহরের প্রতিটি বাঙালির বাড়ি হয়ে ওঠে সিডনির বুকে ‘এক টুকরো বাংলাদেশ’। কর্মব্যস্ত জীবনে এ ধরনের অনুষ্ঠান এই দূর পরবাসে সত্যিকার অর্থেই তীব্র আনন্দের উৎস হয়। সুপ্রিয় পাঠক, এই যে আনন্দ জোয়ার বা আজকের এই অনুভূতি, তা এমনি এমনি হচ্ছে না। বেশ তৃপ্তি করে আমার জন্মভূমির ভাষায় মন খুলে এই যে লিখতে পারছি বা বলতে পারছি, এটিও এমনি এমনি হয়নি। বেশ স্বচ্ছ স্বাচ্ছন্দ্যভঙ্গিতে প্রাণ খুলে কথা বলার এই মনোবল শক্তি আমি পেয়েছি আমাদের সাহিত্য থেকেই। চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য ও শিল্পের উজ্জ্বল ভান্ডার আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি। বিদেশ বিভূঁইয়েও যে পৃথিবী কাঁপানো বাংলা সাহিত্য জন্মে, বাংলা ভাষায় সনেট বা ‘চতুর্দশপদী’ কবিতার জনক মাইকেল মধুসূধন দত্ত প্রমাণ করে দেখিয়েছেন আজ থেকে দেড় শ বছর আগেই। প্রথম ওই সনেটের পর বাকি সবই জন্ম নেয় বিদেশে। ১৮৬২ সালের জুন মাসে ক্যান্ডিয়া জাহাজে করে বিলাতে যান তিনি। ভার্সাইয়ে থাকার সময়ে সনেট লেখায় মন দেন। রীতিমতো বিপ্লব আসে সনেটে, ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয় তাঁকে। লালসালু খ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ফ্রান্সের প্রবাস জীবনেই লিখেছেন তাঁর অমর সৃষ্টি অনবদ্য গল্প, কবিতা ও উপন্যাস। মানুষের জীবন চেতনার ১২ আনাই দেশ-কালের দান, বাকি চার আনা অনুশীলনলব্ধ।

বেবি-মাসুম দম্পতি পরিবারের সদস্যরা
বেবি-মাসুম দম্পতি পরিবারের সদস্যরা


আমাদের মাতৃভাষার দায় রয়েছে জন্মভূমির কাছে। আমি শুধু জানি, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বাঙালি আর বাংলা লেখা দেখলে আমার চোখে পানি আসে!! পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে যখন ঢাকায় ফিরি, আমার মনে হয় আমি মায়ের কোলে ফিরে আসলাম! এই প-র-বা-স-ই আমাকে শিখিয়েছে স্বদেশ তুমি বিহীন আমি কতটা অসহায়...!
এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবি তুলেছেন সুব্রত পাল৷
হ্যাপি রহমান
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
ছবি তুলেছেন সুব্রত পাল