প্রবাসে ভার্চ্যুয়াল ঈদ

ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। একটা সময় ছিল যখন সবাই মিলে এ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতাম। কিন্তু প্রবাসে এটি স্বপ্ন। আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া তো দূরের কথা, ঈদের কথাও মনে থাকে না। পরিবার, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে বলতে দিনটা চলে যায়। সবচেয়ে বেশি আনন্দ ছিল শৈশবে। জীবন ছিল প্রজাপতির মতো। জীবনের চাঞ্চল্য ছিল, ভাবনাহীন জীবন ছিল, ছিল অনেক খুনসুটি।

বড়রা যখন ঈদের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হতেন, আমরা ছোটরা তখন বাড়ির পাশে স্কুলের ছাদে চলে যেতাম চাঁদ দেখার জন্য। কারণ গ্রামের বাড়িতে বড় বড় দালানকোঠা না থাকায় চাঁদ দেখা যেত না। স্কুলে গিয়ে ছোট ছোট চোখ দিয়ে বিশাল আকাশের দিকে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখতাম, তারই ফাঁকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে ঈদের চাঁদ দেখার চেষ্টা করতাম। সেই চাঁদ দেখতেও কত আনন্দ। ঈদুল ফিতর কেটে যাওয়ার পর দিন গুনতাম খালি। কখন ২ মাস ১০ দিন পার হবে। ঈদুল আজহার ১০ দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত গরু, ছাগল, ভেড়া কেনার প্রতিযোগিতা। পশুর হাটে চলে যেতাম বাবা-চাচাদের সঙ্গে। গরু কেনার চেয়ে সবাই মিলে যাওয়ায় আনন্দটা বেশি পেতাম। পশুর হাটও তেমন কাছে না, অনেক দূর। আমরা যারা ছোট ছিলাম তাদের আকর্ষণ ছিল সাজানো গরুর দিকে। তখন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে হাটে বিভিন্ন পশু সাজিয়ে রাখা হতো। গলায় মালা পরিয়ে রাখত। দেখতে দেখতে হাটের এপাশ থেকে ওপাশ সব জায়গায় ঘোরা হয়ে যেত। কিন্তু মুরব্বিদের পছন্দমতো গরু পাওয়া যেত না। ওনারা দেখতে দেখতে কয়েক দিন কাটিয়ে দিতেন। কোরবানির দুই-তিন দিন আগে পশু ক্রয়-বিক্রয়ের আমেজ বেড়ে যেত।

গরু নিয়ে আসার সময় সবাই দাম জিজ্ঞেস করলে বলতে বলতে হয়রান হয়ে যেতাম। বেশির ভাগ মানুষের বাসার সামনে গরু কিংবা ছাগল দেখা যেত। চোখের সামনে কেউ গরু নিয়ে যেতে দেখলেই গলা উঁচিয়ে দাম জিজ্ঞেস করা ছিল ঈদের আনন্দের একটা বিশেষ পার্ট। বাড়িতে আনার পর গরুর গলায় মালা থাকলে সে মালা নেওয়ার চেষ্টা করতাম সবার আগে। এরপর কোরবানির দু-এক দিন বাকি থাকলে মাঠে নিয়ে গরু কিংবা ছাগলকে সারা দিন ঘাস খাওয়াতাম।

ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ঝাঁপাঝাঁপি করে গোসল করতে চলে যেতাম বাড়ির পাশে পুকুরে। বাসায় এসেই হালকা সেমাই খেয়ে নতুন কাপড় পরেই মসজিদে রওনা হতাম। নতুন কাপড় কিনলে কাউকে ঈদের আগে দেখাতাম না, কারণ আগেই দেখিয়ে ফেললে ঈদের জামা পুরোনো হয়ে যাবে। ঈদগাহে যেতাম সবার আগে। ওখানে গিয়ে সুরা তিলাওয়াত করতাম। নামাজ শেষে পরম আনন্দে কোলাকুলি করা ছিল খুব আনন্দের ব্যাপার, সবাইকে ঈদ মোবারক বলাটার মধ্যে ছিল এক অন্য রকম অনুভূতি।

ঈদগাহ থেকে নামাজ শেষ করে কখন যে বাসায় ফিরব, সেটার জন্য মন ছটফট করত। কারণ, গরু/ছাগল জবাই না দেখলে তো ঈদই হবে না। মোনাজাত শেষ করার আগেই চলে আসতাম বাসায়। এসে আম্মা, দাদু, বাড়ির গুরুজনদের সালাম করতাম। কারণ ছোট থেকেই দেখতাম অন্যরা সালাম করে। এরপর সালামি নেওয়ার পালা। দিন শেষে আবার অন্য বন্ধুদের সঙ্গেও মিলিয়ে দেখতাম, কে কত পেল। সালাম শেষে কিছু খেয়ে বা না খেয়েই দিতাম ভোঁ দৌড়। জবাই করা দেখে আবার কিছুটা ভয়ও পেতাম। বাড়িতে সবাই মিলে একসঙ্গে বসে মাংস কাটাকাটি করা, যাদের সবার আগে রান্না হয়ে যায়, তাদের থেকে মাংস নিয়ে সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়া, এসব এখন শুধু স্মৃতি।

বিদেশে এখন আর সেই আনন্দ নেই। ঈদের দিন মোবাইলে পরিবার, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সময় চলে যায়। বাংলাদেশের মতো বাড়িতে বাড়িতে কোরবানি দেওয়ার নিয়ম নেই এখানে। অনেকে একাকী নিজেরা কোরবানি দেয়। তবে বেশির ভাগ প্রবাসীর কোরবানির মাংস ছাড়াই ঈদ কেটে যায়। কেউ কেউ মাংসের স্বাদ মেটানোর জন্য ২/১ কেজি কিনে রান্না করেন ঈদের দিন। পরিবারের সবাইকে ছেড়ে ঈদ, এটাই তো কত কষ্টের।

ঈদের আনন্দে দেশে সবাই যখন আত্মহারা, তখন প্রবাসীরা থাকেন কাজে নয়তো ঘুমে। রাত পেরিয়ে সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর আশপাশে যখন পরিবারকে দেখা যায় না, তখন নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে। মনে পড়ে যায় চিরচেনা গ্রামে ঈদ উদযাপনের স্মৃতিগুলো। নামাজ শেষে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কথা বলে ভুলে থাকার চেষ্টা করি নিজের কষ্টগুলো। কেউ তো আবার ৫ বছর ১০ বছর দেশে যান না। ভিসা জটিলতা, আর্থিক সমস্যাসহ নানা কারণে ইচ্ছে থাকলেও অনেকের দেশে গিয়ে ঈদ উদযাপন কখনো সম্ভব হয় না। এমন লাখো প্রবাসী রয়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, যাঁরা বছরের পর বছর দেশের স্মৃতি নিয়ে প্রবাসে ঈদ উদযাপন করছেন। নিজের পরিবারের ঈদের খরচ পাঠিয়ে নিজে প্রতিনিয়ত কষ্ট করে যাচ্ছেন। এভাবে একের পর এক ঈদ আসে যায়, প্রবাসীদের ঈদ রয়ে যায় নিঃসঙ্গতায় ভরা।

ফজরের আজানের পর দল বেঁধে গোসল সেরে মিষ্টি মুখে নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদগাহে যাওয়া প্রবাসীদের জন্য যেন শুধুই স্মৃতি। বিকেলে সবাই মিলে ঘুরতে বের হওয়া হয় না। কোরবানির মাংস নিয়ে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে আর ছোটাছুটি করতে হয় না। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে বাজারে আড্ডা দেওয়া হয় না। ঈদের পরের দিন ফুটবল খেলা হয় না। শত কর্মব্যস্ততার মাঝে ঈদের ছুটিতে লম্বা ঘুম এখন অধিকাংশ প্রবাসীর ঈদের দিনে মূল কর্মসূচি। আর আমার তো ঈদের দিন নামাজ পড়ার পর সকালে বাসায় থাকলেও বিকেলে কাজে চলে যেতে হয়। বিগত দুই বছর ধরে ঈদ কী, সেটাই ভুলে গিয়েছি।

বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে কিছুটা জাঁকজমকপূর্ণভাবে ঈদ উদযাপন হয়। মোটামুটি সবাই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত। রাতে সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিতে পারে। গত দুবারের ঈদে আমরাও রাতে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা হাসাবিয়াতে কাটাতে পেরেছি। দিনের বেলা খারাপ লাগলেও রাতে একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। পরিচিত সবার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু এবার করোনার কারণে সেটাও সম্ভব হয়নি। সারা দিন বাসায় থেকে বিকেলে কিছুটা সময় সার্ক বিচ থেকে ঘুরে এসেছি। যাঁরা এখানে পরিবার নিয়ে থাকেন তাঁরা কিছুটা আনন্দ অনুভব করলেও বাকিরা আনন্দহীন ঈদ কাটাচ্ছেন। তাঁদের কাছে ঈদ মানেই কষ্ট। আপনজনকে কাছে না পাওয়ার দুঃখ তাঁদের ঈদের আনন্দকে বেদনায় পরিণত করে।

বাংলাদেশের ঈদের আমেজ অনেকটাই অনুপস্থিত আমাদের প্রবাসী জীবনে। তাই তো ঈদের দিনে না চাইলেও মনে পড়ে যায় সেই পুরোনো দিনের কথা, কাছের অতি প্রিয় মানুষগুলোর কথা। ফেলা আসা হারানো দিনের ঈদের আনন্দ এখন কেবলই স্মৃতি। সবাই ব্যস্ত যার যার মতো। প্রবাসে আমরা সংখ্যালঘু, তাই ঈদের আনন্দ অনুভূতিগুলো মনের ভেতরে আটকে থাকে।