প্রিয় মক্কা মদিনায়

১.
বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা মনে মনে উমরাহর নিয়ত করলেও নানা কারণে সেই সৌভাগ্য হয়নি। অবশেষে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে এক সপ্তাহের জন্য পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরিফে উমরাহ পালনের জন্য যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সে এক শান্তিময় ভ্রমণ।
 
আমার মেয়ে ইসরার বয়স তখন তিন। আমরা তখন ইংল্যান্ডের লিডসে থাকি। লিডসের আল-রায়ান ট্র্যাভেলসের মালিক ওয়াহিদ চাচা। ভাবির চাচা, সেই সুবাদে লিডসে আমাদের সবার চাচা; যদিও আমরা দুজনই এম সি কলেজে একসঙ্গে ইন্টার পড়েছি। আমাদের জন্য খুব সুন্দর এক সপ্তাহের একটা উমরাহ হজের প্যাকেজ করে দেন। মক্কায় ভোর চারটায় পৌঁছে ফজরের পরই তওয়াফ, এরপর তিন রাত মক্কায় থেকে গাড়িতে করে মদিনায়। আরও চার দিন মদিনায় এবং মদিনা এয়ারপোর্ট থেকে ফিরতি ফ্লাইট ধরা। ইসরা ছোট বলে উনি রেকমেন্ড করেন মক্কার ক্লক টাওয়ারের সুইস হোটেল। হোটেলের নিচে নামলেই হারামাইন শরিফ মসজিদ।

হাজিদের ভিড়ে প্রাণোচ্ছল মক্কার ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরোনো। চার হাজার বছর আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী হাজেরা আর শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)–কে আল্লাহর নির্দেশে পবিত্র মক্কার জনমানবহীন প্রান্তরে রেখে চলে যান। তপ্ত মরুভূমি, আশপাশে কোনো লোকালয় নেই। বিবি হাজেরা (আ.) সাফা–মারওয়া দুই পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো পানি বা খাবারের সন্ধান পাননি। এরপরই হঠাৎ মরুভূমির তপ্ত মাটি থেকে শীতল পানি বের হওয়া শুরু হয়। সেটাই পবিত্র জমজমের পানি, যা শুধু তৃষ্ণাই মেটায় না, ক্ষুধাও নিবারণ করে। কিয়ামত পর্যন্ত যে কূপ থেকে পানি আসা অব্যাহত থাকবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে বেঁচে গেলেন মা ও শিশু।
উমরাহ বা হজের জন্য সৌদি আরব প্রবেশের আগে মেনিনজাইটিস ভ্যাকসিনের সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক। মেনিনজাইটিসের চারটি স্ট্রেইনের জন্য একটা ককটেল ভ্যাকসিন প্রাইভেটলি কোনো কেমিস্ট থেকে নিতে হয়। গেলাম আমি যে জিপিতে ডাক্তারি করি, তার পাশের বুটস কেমিস্টে। আমার আর খালেদার ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কেমিস্টের ফারমাসিস্ট ওয়াজির বললেন, উনার ১২ বছরের নিচের বাচ্চাদের ভ্যাকসিন দেওয়ার ট্রেইনিং নেই। উনি আমাকে ভ্যাকসিন ধরিয়ে দিয়ে বললেন, শামীম তুমি ইসরার ভ্যাকসিন দিয়ে তোমার জিপি সার্জারির স্ট্যাম্প দিয়ে দিয়ো সার্টিফিকেটে। ভ্যাকসিন সুন্দর করে প্যাকেট করা। ইসরা খুব উৎসাহ নিয়ে আমার সঙ্গে প্যাকেট খুলছে, মনে করেছে নতুন কোনো টয় নিশ্চয়ই। একটু পরেই ইনজেকশনটা পুশ করতেই অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে, আব্বু কীভাবে ওকে ব্যথা দিল, এই বিস্ময়ে প্রথমে কাঁদতেও ভুলে গেছে। একটু পরেই ভ্যা করে কেঁদে ওর আম্মুর কোলে উঠেছে।

এক সন্ধ্যায় ওয়াহিদ চাচার বাসায় গিয়ে দাওয়াত খেয়ে নিয়ে এলাম উমরাহ ভিসাসহ পাসপোর্ট, এত ভালো লাগল, মনে হচ্ছিল এত বছর পর এবার নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর মেহমান হিসেবে আমাদের পবিত্র মক্কা ও মদিনা শহরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন।
২.
ইজিপ্ট এয়ারের ফ্লাইটে ম্যানচেস্টার থেকে পাঁচ–ছয় ঘণ্টায় যখন আমরা কায়রো পৌঁছেছি, তখন কায়রোতে রাত ১০টা। এক ঘণ্টা পরে জেদ্দার ফ্লাইট। তাই কায়রো এয়ারপোর্টে জেদ্দার প্লেনে ওঠার আগে ইহরাম পরার জন্য নামাজের এরিয়াতে গেলাম।

ওজুর জায়গার পাশে যেতেই এয়ারপোর্টের একজন আরবিতে কিছু জিজ্ঞেস করলেও কিছুই বুঝলাম না। ইহরামের কাপড় দেখাতেই একটা দরজার তালা খুলে দিলেন ইহরাম পরার জন্য। আসার আগে লিডসে ইউটিউব দেখে ইহরাম বাঁধার অনেক প্র্যাকটিস করলেও সেলাইবিহীন এই বিশাল সাদা কাপড় দিয়ে সারা শরীর মোড়ানো শাড়ি পরার মতোই এক শিল্প। এক দিনে শুধু ইউটিউব দেখে তা আয়ত্ত করা সহজ কর্ম নয়। বেরোনোর পর সেই এয়ারপোর্ট কর্মী আমার অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন। উনার পকেট থেকেই একটা সেফটিপিন দিয়ে ঠিকঠাক করে দিলেন। উমরাহর নিয়ত করে নফল নামাজ পড়ে নিলাম।

এয়ারপোর্টের সেই কর্মচারীর সঙ্গে আবার দেখা হলো। বুঝতে পারলাম নিশ্চয় কিছু টিপসের অপেক্ষা করছেন। ওয়ালেট আমি খালেদার কাছে রেখে এসেছিলাম, উনাকে সঙ্গে আসতে বললাম। ১০ পাউন্ড দিতেই বারবার শুকরান বললেন। ইসরা আমাকে ইহরাম পরা অবস্থায় দেখে খুব মজা পেয়েছে। ইহরাম ধরে খেলা শুরু করেছে। আমি ভয়ে আছি এক সেফটিপিন দিয়ে তা আটকানো, উমরাহ পর্যন্ত টিকবে তো।
জেদ্দার ফ্লাইটের ডাক আসতেই গেটের কাছে চলে এলাম। অনেকেই আমাদের মতো উমরাহর যাত্রী। এই ফ্লাইট মাত্র ৯০ মিনিটের মতো। লোহিত সাগর বা রেড সির অপর পারেই জেদ্দা শহর। মিকাতে (মক্কার চারদিক ঘিরে এক সীমানা, সেই সীমানায় প্রবেশের আগে ইহরাম ও হজ বা উমরাহর নিয়ত করতে হয়) প্রবেশের আগে পাইলটের ঘোষণার সঙ্গে অন্য হাজিদের সঙ্গে আমরাও কণ্ঠ মেলালাম-‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির’।

জেদ্দা এয়ারপোর্টে আমরা রাত একটার দিকে পৌঁছে গেলাম। ইমিগ্রেশনে লম্বা লাইন। আর গতি কচ্ছপের চেয়েও ধীর। ইসরা কাঁধে ঘুমিয়ে আছে। স্ট্রলার আমরা লাগেজের সঙ্গে দিয়েছিলাম, যাতে হাতে কম জিনিস থাকে। এখন বুঝেছি সঙ্গে থাকলেই ভালো ছিল। মাইকেল পেলিন তাঁর জেদ্দা ভ্রমণে লিখেছিলেন যে জেদ্দার বিল্ডিং, রাস্তা সব আমেরিকার মতো বিশাল ও ঝকঝকে, তবে তাদের সিস্টেম রাশিয়ার মতো স্লো। কিন্তু তা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে এক অফিসার আমাদের কাছে এসে পাসপোর্ট চাইলেন এবং তাকে ফলো করতে বললেন। এক বন্ধ ইমিগ্রেশন ডেস্কে নিয়ে আমাদের পাসপোর্টে অ্যারাইভাল স্ট্যাম্প দিয়ে দিলেন। এবার আমাদের বারবার শুকরান বলার পালা।

লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ২০ রিয়াল দিয়ে একটা সৌদি সিম কার্ড কিনে মিনহাজ ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আল-রায়ান থেকে নাকি বারবার বলা হয়েছে, তিনি যাতে এয়ারপোর্টে থাকেন। শুধু ড্রাইভার পাঠালে হবে না। এয়ারপোর্ট থেকে মসৃণ রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলছে জেদ্দার রাস্তায়। এত রাতেও দেখলাম অনেক দোকান খোলা। মরু শহরগুলোতে দিনে প্রচণ্ড গরমের কারণে অনেকেই রাতে বের হন, তাই দোকানপাট অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
জেদ্দার গল্প সেই ছোটবেলা থেকে এত শুনেছি। আমার বড় আপা, দুলাভাই অনেক বছর ছিলেন এখানে। দুলাভাই জেদ্দা হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন সে সময়। আমি ক্লাস ফাইভে থাকতে আপা বিয়ের পর জেদ্দা চলে আসেন। এয়ারপোর্টের পাশেই আল-সাফা এলাকায় থাকতেন। আমার দুই ভাগনে–ভাগ্নির জন্ম এখানে। প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে উনারা বাংলাদেশে গেলে অনেক গল্প শুনতাম জেদ্দা, মক্কা ও মদিনার।

প্রায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আপারা মক্কায় চলে আসতেন, শুক্রবার দিন কাবাঘরে কাটিয়ে বাসায় ফিরতেন। আপারা এখন কানাডায়, দুলাভাই এখন রিয়াদ হাসপাতালে চাকরি করেন। রিয়াদ খুব দূর হওয়ায় আমাদের সঙ্গে দেখা হবে না বলে খুব আক্ষেপ করেছেন ফোনে।

রাত বলে বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তিন–চার লেনের হাইওয়ে ধরে ১০০ মাইল গতিতে গাড়ি ছুটছে। এখানে স্পিড লিমিটের কোনো বালাই নেই। ১০০ মাইল যেন ইউকের ৭০ মাইল। আড়াই ঘণ্টা লাগার কথা। মিনহাজ ভাই বললেন, আমরা হোটেলের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতেই ফজরের সময় হয়ে যাবে। ফজরের নামাজের পর উমরাহ করে নিতে পারব। আমাদের সঙ্গে একজন হুজুর দেওয়ার কথা বলে রেখেছিলাম, যাতে উমরাহ সঠিকভাবে করতে পারি। তিনি বললেন, হাফিজ তাজুল ইসলামকে বলে রেখেছেন। তিনি আমাদের হোটেলের রিসেপশনে থাকবেন। পথে সার্ভিসে আমাদের ড্রাইভার পেট্রলের জন্য থামল। আসার সময় দেখি সবার জন্য কিছু আরব স্ন্যাকস আর কোক নিয়ে এসেছেন। খাবার দেখে মনে হলো আসলেই খুব খিদে লেগেছে।

সুইস হোটেলের ২২ তলায় আমাদের রুমে পৌঁছে দিয়ে মিনহাজ ভাই বিদায় নিলেন। আমাদের জন্য সারা রাত জেগেছিলেন। তাঁকে এত কষ্ট করে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিলাম, নাহলে এত রাতে নতুন এক শহরে এভাবে জার্নি করার সাহস হতো না।
৩.
রুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হতে না হতেই ফজরের আজান হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি নিচে নেমেই হোটেলের লবিতে হাফিজ তাজুল ইসলামকে পেয়ে গেলাম। বাড়ি সুনামগঞ্জে। সৌদি আরবে পড়তে এসেছেন, এখন পাশাপাশি বাংলাদেশি হাজিদের স্থানীয় এজেন্টদের সঙ্গে কাজ করেন।

মসজিদুল হারামের আজান তখন কানে আসছে, সেই চেনা সুর, যা বিটিভিতে আমরা শুনতাম, মনে হলো যেন একই কণ্ঠ। ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ তখন প্রায় পূর্ণ। নামাজ শেষে কাবার উদ্দেশে মসজিদের ভেতরে পা দিলাম। হাজার হাজার পাখি তখন পুরো এলাকা মাতিয়ে রেখেছে। মসজিদের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আস্তে আস্তে কালো রঙের কাবাঘর দৃষ্টির সীমানায় চলে এল। সে কি এক অনুভূতি! জন্ম থেকে যে কাবার দিকে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছি, সেই কাবা শরিফ দূর থেকে দেখা যাচ্ছে।

আমি খুব ছোট থাকতে দাদা হজে যান, আসার সময় আমার জন্য লাল রঙের একটি ক্যামেরা এনেছিলেন, তাতে কাবা শরিফ, আরাফাতের ময়দান, মদিনার ছবি দেখা যেত। ছোট বেলার আবছা আবছা সেই ছবিগুলোই যেন একে একে দেখতে পাচ্ছিলাম। আর্দ্র চোখে কালো কাবাঘরের সামনে দাঁড়ালাম। পেছনে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। আমরা উমরাহর তওয়াফ করা শুরু করলাম। ফজরের নামাজের পর অনেক লোক তাওয়াফ শুরু করে দিয়েছেন। ইসরাকে কোলে করে আমরাও তাওয়াফ করে নিলাম। প্রতি তাওয়াফে কাবার কিছু কাছে আসছি। একসময় হাত দিয়ে পবিত্র কাবা শরিফ স্পর্শ করলাম।

খুব ভিড়, কোলে ইসরা থাকায় হাজরে আসওয়াদে দূর থেকেই চুমু খেলাম। তাওয়াফ শেষে আমরা হাঁটা শুরু করলাম সাফা–মারওয়া পাহাড়ের দিকে। পথে পড়ল জমজম কূপ। আসলে জমজম কূপ কোথায়, তা ঠিক আমাদের হুজুরও বলতে পারলেন না। জমজম কূপ থেকে পাইপে করে মসজিদের বিভিন্ন জায়গায় হাজিদের জন্য পানের ব্যবস্থা করা আছে, ঠিক মসজিদে যেমন ওজুখানা থাকে, সে রকম।

মসজিদের ভেতর দিয়ে হেঁটেই সাফা–মারওয়া পাহাড়ে চলে আসা যায়। এখানে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার পুরো পথই এখন তিনতলার এক বিশাল টানেলের মতো করে করা, হাজিদের সুবিধার জন্য শীততাপনিয়ন্ত্রিত। সাফা পাহাড় থেকে আমরা হাঁটা শুরু করলাম মারওয়া পাহাড়ের উদ্দেশে। এখানে কাবা শরিফে তাওয়াফের সময় যে ভিড় ছিল, তা নেই। বিশাল বিশাল ফ্যান ঠান্ডা বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা পথে। ইসরা এবার ফাঁকা জায়গা পেয়ে হাঁটা শুরু করেছে। এক পাহাড় থেকে গিয়ে অন্য পাহাড় ছুঁলে এক সায়ি হয়। এভাবে সাতবার সায়ি করার পর আমাদের উমরাহর তৃতীয় স্টেপ শেষ হলো।

উমরাহে চুল কাটা হয়। মসজিদের সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ড এক মার্কেট আছে। সামনে যেতেই এশিয়ান একজন ওর সেলুনে নিয়ে গেল। শুধু সেলুন নয়, ওখানে ফাস্টফুড, মোবাইলের দোকান, খেলনাসহ যাবতীয় জিনিসের দোকান আছে। চুল কাটা শেষে আমরা নাশতা করার জন্য একটা ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে পড়লাম। তাজুল হুজুর দেখলাম ফাস্টফুডে তেমন উৎসাহী নন, পাশে আরেকটু হাঁটলে একটা বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর কথা বলছেন, নাশতায় পরোটা পাওয়া যায়! ক্লান্ত থাকায় তাঁকে ওখানে আগামীকাল নিয়ে যেতে বললাম।

৪.
বিকেল বেলা হোটেল থেকে নিচে নামলাম। দোতলায় বিশাল ফুডকোর্ট। আরবের বিভিন্ন দেশের খাবার সঙ্গে কেএফসিও আছে। নাশতা করে ঠিক করলাম মহানবী (সা.)–এর জন্মস্থান দেখে আসব। গেলাম সেখানে। অনেক দর্শনার্থী। পাশে বাস দাঁড়িয়ে আছে। পাশের শহর বা অন্য দেশ থেকে আসা হাজিদের নিয়ে। সিলেটে শাহজালালের দরগাহর পাশে এ রকম অনেক কোচ থাকত অন্য শহর থেকে আসা মাজার জিয়ারতকারীদের নিয়ে। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই কোচ আসা শুরু হতো। স্কুলে থাকার সময় আমার বন্ধু ফারহানের দরগাহ গেটের বাসায় টেবিল টেনিস খেলার জন্য শুক্রবার বিকেলে যেতাম আমরা অনেক বন্ধু। টেবিল টেনিস খেলার ঘরের পাশের খালি জায়গায় মাজার জিয়ারতকারীদের পাওয়া যেত। কেউ কেউ জানালা দিয়ে আমাদের খেলা দেখত।

বাইরে প্রচণ্ড গরম, মরুভূমির বাতাসও খুব গরম। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়লাম। মসজিদে এসি থাকায় বাইরের প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় হলো। আসলে বড় বড় দালান তৈরি হয়ে যাওয়ায় বইয়ে পড়া বা শোনা কাবা শরিফ আর আশপাশের যে চিত্র মনে ছিল, তার সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যায় না। সব ইট–কংক্রিটের ইমারত। এমনকি সাফা–মারওয়া পাহাড়ও মসজিদের ভেতরে চলে এসেছে।

আসরের নামাজের জন্য কাবার খুব কাছে এক জায়গায় বসে পড়লাম। যখনই সুযোগ পেয়েছি, এমন জায়গায় নামাজে দাঁড়িয়েছি, যাতে চোখের সামনে কাবা দেখা যায়। কাবাকে চোখের সামনে রেখে নামাজ পড়ার এ এক অদ্ভুত অনুভূতি।

এত কাছে জায়গা পেয়েছি যে মাগরিবের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হব ঠিক করলাম। মাঝখানে বের হলে এত কাছে জায়গা পাওয়া যাবে না। ইসরা ওর ব্যাকপ্যাকের খেলনা বের করে খেলা শুরু করেছে। হাজিদের এক গ্রুপ তখন বিকেলের নাশতা করছে। আমরাও ওদের গ্রুপের মধ্যে বসে আছি। সবার সামনেই খাবার দিয়ে যাচ্ছে ওদের লোকজন। মনে হলো টার্কিশ গ্রুপ, রুটি খেজুর, কাবাব দিয়ে গেল। আমরা ইতস্তত করছি দেখে পাশের ভদ্রলোক ইশারায় খাওয়া শুরু করতে বললেন। খাবারের পর আবার সবার জন্য টার্কিশ টির ব্যবস্থা। আমাদের সঙ্গে কোনো খাবার ছিল না যে পাশের ভদ্রলোককে দেব। ঠিক করলাম, এখন থেকে কিছু সঙ্গে রাখতে হবে। ইসরা কিছু খাচ্ছে না দেখে একজন একটা জুস দিয়ে গেল ওকে।
পুরো মসজিদেই ফ্রি ওয়াই–ফাই। জায়গায় জায়গায় লগ ইন করার নিয়ম লেখা।

হাইটেক ব্যবস্থার পুরো ফায়দা নিচ্ছেন দূর প্রাচ্যের হাজিরা। তাঁদের সবাই খুব কম বয়সী। কাবা তওয়াফের সময়ও ভিডিও কলে আছে, হয়তো দেশে থেকে পরিবারের সবাই দেখছে। তাদের বিশাল দল, সবার পোশাক ম্যাচিং, সামনে গাইড সবুজ/নীল পতাকা নিয়ে থাকবে, বাকিরা গাইডের পেছনে পেছনে। কোনোভাবে একজন পেছনে পড়ে গেলে ঠেলেঠুলে গাইডের পেছনে আসবে।
পরের দিন সকাল ১০টার দিকে হাফিজ তাজুল হুজুর গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আজ আমাদের মক্কা শহর ঘুরে দেখাবেন। নবীর স্মৃতিবিজড়িত কয়েকটি জায়গা এবং সর্বশেষে আরাফাতের ময়দান।

পবিত্র মক্কা পাথরের পাহাড়ঘেরা এক উপত্যকা। কাবা থেকে কিছু দূর গেলেই পাহাড়ের নিচে টানেল করা হাইওয়ে।

প্রথমেই আমরা গেলাম জাবাল আন নুর অর্থাৎ আলোর পাহাড়ে। জাবাল আন নুরের পর আমরা গেলাম পবিত্র মক্কার কাছেই তুর পাহাড়ের। গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটলেই বিশাল পাথরের পাহাড়।

আমরা এরপর গেলাম আরাফাতের ময়দানে। হজের সময় লাখ লাখ মানুষে গমগম করা ময়দান তখন ফাঁকা। আমাদের মতো অনেক দর্শনার্থী। পাশেই ছোট পাহাড় যেখানে বাংলায় লেখা ‘রহমতের পাহাড়’। একটু উঁচু পাথরের এক টিলার মতো জায়গা, সেখান থেকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন।
আরাফাতের ময়দানে অনেক খাবারের ভ্যান। একজন বাংলাদেশি দোকানির কাছ থেকে আইসক্রিম কিনে খেলাম। হোটেলে ফেরার পথে হাজিদের ক্যাম্প, শয়তানকে পাথর মারার জায়গা দেখে এলাম আর মনে মনে বললাম, আল্লাহ যেন জীবনে একবার হলেও পবিত্র হজ পালনের সুযোগ করে দেন।

রাতে তাজুল হুজুরকে বললাম আমাদের বাংলাদেশি হোটেলে নিয়ে যেতে। এসব মিষ্টি মিষ্টি আরব ভাত, কারি ভালো লাগছে না। তিনি আমাদের বাংলাদেশি এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। বললেন, আগে আরও অনেক রেস্তোরাঁ ছিল। সব ভেঙে দামি দামি হোটেল হচ্ছে আর এশিয়ান দোকানগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। ৩–৪ দিন ধরে আরবের মিষ্টি তরকারি খাচ্ছিলাম, বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর গরুর মাংস দিয়ে ভাত তাই অমৃতের মতো লাগল। খাবার শেষে কিছু শপিং করলাম। দোকানিরা বেশির ভাগই আমাদের উপমহাদেশের। দরদাম করতে হয় কিন্তু পাশেই বিন দাউদ সুপার মার্কেট, যেখানে সব ফিক্সড প্রাইস। সময়ও বাঁচল, তাই বিন দাউদ থেকেই গিফট শপিং করলাম।

আজ রাতই মক্কায় আমাদের শেষ রাত। কাল দুপুরে আমরা মদিনায় রওনা হব। রাত ১২টার দিকে আমরা আবার কাবা শরিফ তওয়াফ করে এলাম। আর আল্লাহর কাছে আবার তাঁর ঘর দেখার সুযোগ করে দেওয়ার দোয়া করে এলাম।
*লেখাটি উমরাহ পালনকালে আমার/আমাদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা। হজ ও উমরাহ সম্বন্ধে আলোচনার জন্য নয়। তবে উমরাহ ও হজ পালনের রীতিগুলোর উৎস প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে, কোনো ভুল হলে ক্ষমা করবেন এবং জানাবেন।
*শামীম আহমদ, কেন্ট