প্রেম একবার এসেছিল নীরবে

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

চেনা গ্রাম, চেনা শহর। সবকিছু পরিচিত। তারপরও কেন জানি চারপাশটা নতুন নতুন লাগে। গত কটা বছর প্রবাসে ছিলাম। কয়েক মাসের ছুটিতে দেশে এলাম। এরই মধ্যে সপ্তাহ কয়েক গতও হয়েছে। আমাকে পেয়ে মায়ের আদর, বাবার ভালোবাসা, ছোট বোনের আনন্দ—কোনো কিছুরই কমতি ছিল না। আগের সেই পুরোনো ঘরটা আর নেই। ইট, সিমেন্ট ও রঙের মিশ্রণে বাড়ির রূপের পরিবর্তন হয়েছে। আঙিনার এক পাশে বেলি ও গন্ধরাজ ফোটে আছে। মা-বাবার রুমটা সাদামাটাভাবেই আছে। একটা আলমারি আছে। আলমারির ওপর দেয়ালে ঝোলানো আছে মা-বাবার ছবি। পাশে আমার ছবিটাও আছে। একটা সহজ-সরল মুখ। বোকা বোকা চেহারা। এই বোকা চেহারার ছেলেটা সুদূর প্রবাসে বছরের পর বছর থেকে অর্থ উপার্জন করে। ছোট বোন শেফালীর রুমটা বেশ গোছালো। ছোট্ট একটা খাটের ওপর নরম ফোম তার ওপর চমৎকার ডিজাইন করা একটা চাদর বিছানো আছে। পাশে একটা ড্রেসিং টেবিল, দুটি বাতায়ন। একটা টেবিলের ওপরে পড়ার বই রাখা। টেবিলের পাশে দেয়ালে সাঁটানো আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের ছবি। ড্রেসিং টেবিলে ওপরে একটা ছবির ফ্রেম রাখা আছে। ফ্রেমের দৃষ্টি যেতে একটু অবাক হলাম, সেই সঙ্গে খুশিও হয়েছি। ফ্রেমে দুটি ছবি আছে। একটি শেফালীর, অন্যটি আমার। এ বিষয়ে শেফালীর একটাই জবাব, তার জীবনে তার ভাইয়া হচ্ছে সবচেয়ে আপনজন। আমি অবশ্যই উসকানিমূলকভাবে বলেছি, হুম, আজ আমি আপন, কাল অন্যজন আপন! শেফালী রেগেমেগে বলে, দেখো ভাইয়া, এমনভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলবে না, বলে দিচ্ছি ! থাক আর কিছু বলতে হবে না।

বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। বাংলাদেশে গেলে আমাদের গ্রামের তিনটি ছেলের সঙ্গে চলাফেরাটা খুব বেশি হয়। রনি, সাদ্দাম ও রুমান। তিনজনই প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান। বলতে গেলে তাদের তুলনায় আমি নিম্নমধ্যম পরিবারের। রনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি পড়ছে। অনার্স শেষ পর্যায়ে। চমৎকার মেধাবী ছাত্র। গ্রাম তার খুব পছন্দ বলে গ্রামেই বেশি থাকে। সাদ্দাম প্রবাসজীবনে আছে। রোমান দাড়িয়াকান্দি বাজারে পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এক বিকেলে তিন বন্ধু মিলে ঘুরতে বের হলে বোরকা পরা একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়। মেয়েটি বড্ড লাজুক।  কেননা, এই মেয়েকে আরও কয়েক দিন দেখেছি। কেন জানি মেয়েটিকে খুব ভালো লাগে আমার। বিষয়টা সঙ্গের দুই বন্ধুও অবগত। আজকের বিষয়টা একটু ভিন্ন। বোরকা পরা মেয়েটির কাছে গেলাম। বাজারে কোনো একটা দোকানের সামনে। মেয়েটি প্রাইভেট পড়া শেষ করে নিজ গৃহে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমি মেয়েটির কাছে এসে বলি, একটু শুনবে?
আমার এই কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। সেটা বুঝতে পারছি। মেয়েটি ভয়ে কাঁপছে। আমি বললাম, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুই বলছে না। দুটি চোখ দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। এত সুন্দর চোখ। তার মুখটা যদি একবার দেখতে পারতাম। ভেতরে আমার শত শত অনুভূতি উঁকি দিচ্ছি। কেন সে কথা বলছে না। আমি আবার বললাম, প্লিজ, একটু কথা বলো। না, মেয়েটি কিছুই বলল না। সে ভয় পাচ্ছে। এদিকে আমার সঙ্গে থাকা বন্ধু দুটি একটু দূর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শেষে বললাম, ইফ ইউর ডোন্ট মাইন্ড। একটু কাগজ-কলম দেওয়া যাবে? আমি দেখলাম কাগজ-কলম দেওয়ার সময় মেয়েটা কাঁপছে। আমি আর দেরি না করে নিজের মোবাইল নম্বরটা চট করে লিখে মেয়েটিকে দিয়ে দিয়ে বললাম, এটা আমার নম্বর। যদি ভয় কাটে এবং ইচ্ছা হয় তাহলে আমাকে নক করো। আমি অপেক্ষায় থাকব। মেয়েটি কাগজ-কলম হাতে নিয়ে দ্রুত চলে গেল। যেন আমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে প্রাণ ফিরে পেল। আর আমি বোকারাম পেছন থেকে তার চলে যাওয়া দেখছি। কত সুন্দর করে হাঁটে সে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে চলে গেল সে। আমি যতক্ষণ দৃষ্টিগোচর না হয়, ততক্ষণ তাকিয়ে আছি। পেছন থেকে রনি, রুমান চলে আসে। এসেই বলে ওঠে, কী খবর, রোমিও? আমি বললাম, জানি না।

বেশ কদিন হয়ে গেল। আমি অবশ্যই মেয়েটির ফোনের অপেক্ষায় আছি। আবার এটাও ভাবতাম, মেয়েটি যে লাজুক, ফোন না-ও দিতে পারে। ভাবনাতে সাতপাঁচ প্রতিনিয়ত ছিল। অপেক্ষা নামের শব্দটা সত্যি অতি যাতনার। ফলে মেয়েটির ফোন না পেয়ে তাকে ভুলতে চেষ্টারত থাকলাম। অল্প কয়েক মাসের জন্য দেশে এসে মায়াবতীর জালে ফেঁসে যাচ্ছি না তো? দেখতে দেখতে ছুটির শেষ প্রান্তে চলে আসি। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর আবার প্রবাসে পাড়ি জমাতে হবে।

অনেক দিন হয় মেয়েটিকে দেখছি না। আগে তো পথে দেখা হতো। নম্বরটা দেওয়ার পরও মেয়েটিকে দেখেছি বেশ কয়েক দিন। কিন্তু ইদানীং যে দেখছিই না! মেয়েটির কোনো সমস্যা হলো না তো। মেয়েটিকে ঘিরে মাথায় একটা নতুন চিন্তার আবির্ভাব হয়। তবে চিন্তাটা খুব বেশি সময় মাথাতে থাকতে পারেনি। ঘুম ভাঙতেই মোবাইলে ইনবক্সে একটা লাল রঙের চিহ্ন দেখতে পাই। তার মানে নতুন কোনো মেসেজ। বুঝতে পারছি একটা অপরিচিত নম্বর থেকে মেসেজটি এসেছে। মেসেজে লেখা, কেমন আছেন? আমি সেই মেয়েটি, যাকে আপনি নম্বরটি দিয়ে ছিলেন। আমাকে চিনতে পেরেছেন? ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখা, যাকে বাংলিশ বলা হয়। তবে মেয়েটির মেসেজ পেয়ে আমার মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। রীতিমতো নাচতে ইচ্ছা হচ্ছে। যা-ই হোক, মেয়েটি যে আমাকে ভুল বোঝেনি, সেটাই বড় কথা। মনে মনে মেয়েটিকে বলতে লাগলাম, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই মেসেজটি দেওয়ার জন্য। কেননা, আমার নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম, তুমি বোধ হয় আমাকে খারাপ ছেলে ভেবেছ। সেটা ভেবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরেক দিন আরেকটা মেসেজ পেলাম। সেখানে লেখা, ভুলেও যেন কল না করি! কারণ, মোবাইলটা তার মায়ের। মা যদি জানতে পারে, তাহলে তাকে মেরে ফেলবে। আমি আর কল দিলাম না। দু-চারটা কথা হতো, তাও মেসেজের মাধ্যমে। মেসেজে মেয়েটির সঙ্গে একটু একটু করে প্রেম হয়। হঠাৎ রিপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। এক দিন, দুই দিন, দিনের পর দিন গত হচ্ছে আর কোনো রিপ্লাই আসছে না। এদিকে আমার টিকিট কনফার্ম। বিমানে ওঠার পূর্বমুহূর্তেও মেয়েটির মেসেজের রিপ্লাইয়ের অপেক্ষাতে ছিলাম। কিন্তু কোনো রিপ্লাই মেসেজ পেলাম না।

আমি বুঝতে পেরেছি মোবাইলে মেসেজ আদান-প্রদানের বিষয়টা বোধ হয় মেয়েটির মা জানতে পেরেছে। ফলে মেয়েটির হাতে মোবাইল দেওয়া একেবারে নিষেধ করেছে। আর তাই মেয়েটি আমাকে কোনো মেসেজ দিতে পারছে না। ভাবতে অবাক লাগে, এই যুগে এমন মেয়েও আছে? বর্তমান সময়ে স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা কত চতুর থাকে। আর এই মেয়েটি কি না...!

মনে পড়ে কলেজে যাওয়ার পথে মেয়েটিকে দেখতাম। মেয়েটির মুখটা দেখা হয়নি। সেটাই ছিল একটা রহস্য। ভাবতাম এই বুঝি মুখের ওপর থেকে মুখোশটা সরাল। এই বুঝি একটা সুন্দর একটা মুখ দেখতে পাব, যা দেখে আমি জ্ঞান হারাব! না দেখেও মনে হয় কতবার তাকে দেখেছি তার হিসাব নেই। মেয়েটি আমার মনের ভেতর প্রতিনিয়ত হেঁটে বেড়ায়। আর আমার অন্তর চোখ দুটো অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কী আছে এই মেয়েটির মাঝে। কেন সে আমার সামনে আসে? জীবনে প্রেম কী, সেটা বুঝি নাটক-সিনেমায় দেখে। এখন মনে হচ্ছে, এই বোরকা পরা মেয়েটিকে দেখে আমার মনে প্রেম উঁকি দিয়েছে। কিন্তু সেই প্রেম তো উঁকি দিয়েই সারা হয়ে গেল। চলেই যদি যাবে, তবে কেন এসেছিলে। হায় রে প্রেম! এখন কেন জানি নিজেকে বড্ড একা একা লাগে।

যে আলো হয়ে এসেছিল কাছে মোর
তারে আজ আলেয়া যে মনে হয়
এ আঁধারে একাকী এ মন আজ
আঁধারেরই সাথে শুধু কথা কয়;
প্রেম একবার এসেছিল নীরবে...
লতা মঙ্গেশকরের এই গানটি জীবনের সঙ্গে মিলে গেল। জীবনের রং বোঝা সত্যি কঠিন। তবু মানুষ প্রেমে পড়ে, ভালোবাসে। প্রিয়জনের কাছে ছোটে।
লেখক: এম হৃদয়, সিঙ্গাপুর।