প্রেয়সী সিডনি

ছবিটি প্রতীকী
ছবি: কবির হোসেন

দূরের সুনিবিড় শান্ত সমুদ্র হাতছানি দিয়ে ডাকে আর বলে, ‘দেখো, আমার ঢেউখেলানো হাসিতে কোনো ক্লান্তি নেই! হে শ্রান্ত পথিক, এসো, আমার তটে তোমার সকল ক্লান্তি কেটে যাক!’

বিকেলবেলার এ সময়ে ডাউন টাউন সিডনির আটলান্টিক সমুদ্রপাড়ের এই পার্কে বসে সূর্যাস্তের ছবি দেখাটা বেশ প্রশান্তি এনে দেয়। কাজ শেষে খাওয়াদাওয়া সেরে মনে হতো কোথাও গিয়ে হেঁটে আসি। কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আর কোথায় গিয়ে শেষ করব ওই দিনের পথচলা, তা ঠিক করাটাই বেশ কঠিন হয়ে যেত। পুরো শহরই ছবির মতো লাগে! মনে হয় প্রতিটি গলিতে কোনো এক শিল্পী দাঁড়িয়ে তাঁর তুলির আঁচড়ে এমন এক দৃশ্যপট এঁকে গেছেন, যা কস্মিনকালেও পুরোনো হবে না। এ যেন সবসময়ই চিরহরিৎ! হ্যাঁ, শীতের সময় চিরশুভ্রতার নির্মল চাদর মুড়ি দেয় সিডনি। কিন্তু তার সৌন্দর্যের পালক খসে পড়ে না কখনোই। বরং বলা যায়, সে নিজেকে ভিন্ন রঙে সাজিয়ে হাজির হয় নতুনভাবে, যে সিডনিকে আগে কখনো দেখিনি, আর দেখবও না!
প্রতিদিনই আমার কাছে নতুন থেকে নতুনতর হয়ে হাজির হয় সিডনি। কথা বলে না, ইশারায় কাছে আসে, কানে কানে বলে যায়, শুনিয়ে যায় নিজের বুলি, ‘আগন্তুক, আমার সৌন্দর্যের কাননে তোমায় স্বাগতম! অবিরাম পথচলায় ক্লান্ত হলে বেঞ্চে বসো আর গরম কফিতে চুমুক দাও ঠান্ডায় জমে যাওয়ার আগে! আর গ্রীষ্মে? ওই যে এখন বরফ দেখছ, ওটা কফির সাথে মিশিয়ে দাও, ব্যাস! হয়ে গেল আইস কফি! গরমে ঠান্ডা পরশ পেয়ে যাবে।’

এক বিকেলে জাসলিনের সঙ্গে ওয়েন্টওর্থ পার্কে বসে গল্প করছিলাম। কথার একপর্যায়ে ও বলে বসল, ‘এ শহরকে আমি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। চার বান্ধবী ছিলাম, সবাই একে একে চলে গেছে, হয়তো আমাকেও কাজের জন্য চলে যেতে হবে। কিন্তু এ শহরকে ছেড়ে যেতে মন খুব কাঁদবে! ছোট কিন্তু ছিমছাম সুন্দর করে সাজানো আর চারপাশে তাকিয়ে দেখলেই সবুজের ছায়া, দূরের ওই পাহাড়, আর আরও কিছুটা দূরে তাকালেই সমুদ্র! এর রঙের কোনো অন্ত নেই আর সব সময়ই মায়ায় জড়িয়ে রাখবে আমাকে!’

ডেভেনপোর্ট রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে টাউনসেন্ট রোডে গিয়ে সোজা যাওয়ার পথে এক বাড়ির সামনে তিন বয়স্কাকে বসে আড্ডা দিতে দেখতাম আর প্রতিদিন হাত দিয়ে ইশারা করতাম। ওনারাও সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা ইশারায় স্মিত হেসে জবাব দিতেন। এমন কখনো হয়নি যে ওনাদের কাউকে দেখিনি। সবুজ রঙের ওই বাড়ির ঝুলবারান্দায় ওনাদের হাসি আর আড্ডার আসর স্মৃতিতে অমলিন! হলদে রঙের ওই সব ফুলের খুব কাছে গিয়ে ছবি তুলে নিলাম। বাড়ির সামনে অসংখ্য ডেইজি ফুল। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, নীলচে আকাশি রঙের গ্র্যান্ড হাউন্দস টাং। এটাকে ওয়েস্টার্ন হাউন্দস টাংও বলে। ডাউন টাউনের দিকে গেলে ড্যাফোডিলের দেখা পাব। রাস্তার পাশে সিলভার চাইমসও দেখতে পাচ্ছি। এখান থেকে মিনিট পনেরো হাঁটার রাস্তা; পৌঁছে যাব সিডনি রিভার। ওখানে দেখা মিলবে শুভ্রতায় ছেয়ে যাওয়া ফ্লাওয়ারিং ডগউডের। ফুলের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে পুরো একটা ফটো অ্যালবাম বানিয়ে নিয়েছি এর মধ্যেই!

গল্পের শুরুতে ফিরে যাই, যখন আমি সিডনির বিগ ফিডেল থেকে কিছুটা দূরের ওই পার্কে বসে আছি। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় গরম লাগলেও এখানে বাতাসে একটা শীতলতার পরশ অনুভব করতে লাগলাম।

হঠাৎ চোখের পলকেই দেখি, বিশাল এক হাস্কি কুকুর আমার বেঞ্চের খুব কাছে চলে এল। মোটামুটি বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ার আগেই দেখলাম ওটার প্রভু ভালোই সামলে নিলেন। আমাকে সরি বলে চলে গেলেন। সব বয়সের মানুষই দেখতে পাচ্ছি, বেশির ভাগই হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাটির পরই এখানটায় বসলাম। সিডনির কিছু টুকরো স্মৃতি, যা সারা জীবনের পাথেয় হয়ে রইবে। প্রেয়সী সিডনি হরেক সময় ভিন্ন ভিন্ন সুরে কথা বলে আর আমি তার মনভোলানো রূপে মুগ্ধ হয়ে হারিয়ে যাই কোনো এক সুন্দরের অতল তলে! এখানে গ্রীষ্মের সময় গাছের পাতাগুলো যেমন চিরসবুজ রূপে নিজেদের পসরা সাজিয়ে নিয়ে দেখা দেয়, তেমনি কনকনে শীতের আগে শরৎকালে হাজির হয় তিন রকম রঙের বৈচিত্র্য নিয়ে। সবুজাভ পাতায় প্রথমে হলদে প্রলেপ পড়ে, তারপর হয়ে যায় লাল। অর্থাৎ তখন তিন রকম রঙের বাহার দেখা দেয় গাছে গাছে! মনে হয় কোনো রঙের কারিগর তাঁর তুলি দিয়ে রং করে যাচ্ছেন নিরন্তর!

এখন ইতিহাসের পাতায় একটু ঘুরে আসি। বিংশ শতাব্দীতে যখন সিডনিতে উত্তর আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ স্টিল কারখানাগুলোর একটা (ডেসকো) ছিল, তখন সেখানে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে ডেসকোতে শ্রমিক সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকে। কানাডিয়ান সরকার নোভা স্কসিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ কর্মসংস্থান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার কথা ভেবে এটিকে সরকারীকরণ করে। তখন এর নাম হয় ‘সিডকো’ (সিডনি স্টিল করপোরেশন)। কিন্তু ১৯৭০ সালের পর থেকে প্ল্যান্টের উৎপাদনক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে এবং কর্মসংস্থানের নিমিত্তে শ্রমিকেরা স্থানান্তরিত হয়ে যান। অবশেষে ২০০১ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০০ সালে যে ইস্পাত কারখানা শুধু কানাডায়ই নয়, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কারখানা ছিল, এক শতাব্দীর ব্যবধানে তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেল। এর জন্য আন্দোলনও হয়েছিল। একসময়ের কর্মচঞ্চল শহরের সঙ্গে আজকের সিডনিকে মেলানো যাবে না। এখন তেমন কোনো চাকরি এখানে নেই বললেই চলে। তাই অধিকাংশ ছেলেপেলেরা গ্র্যাজুয়েশনের পর রাজধানী হ্যালিফ্যাক্সের দিকে চলে যায়। প্রিয়তমা সিডনিকে ছেড়ে যেতে কারও মন কাঁদে আর কারও হয়তো... না।

আর সিডনির কথা বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হবে এর প্রাণকেন্দ্র কেপ ব্রেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। ছোট্ট এই দ্বীপে যে পৃথিবীর আনাচকানাচের এত মানুষের আনাগোনা, তার কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়। সবাই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এসে একসঙ্গে এক সুতায় মিলিত হয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বদৌলতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথ রয়েছে চারটি। বাসস্টেশন থেকে যে গেট কাছে, ওটার ডান দিকের দেয়ালজুড়ে গোলাপি রঙের পাতাবাহারে ছেয়ে যায় গ্রীষ্মকালে আর উদ্যানে হরেক রকম হলদে লাল ফুল। ঠায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখার মতো দৃশ্য! আর শীতকালে সাদা বরফতুলার চাদরে ঢাকা পড়ে যায় পুরো আঙিনা। নিজের ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখে সব সময়ই মনে হয়েছে প্রকৃতির মতো এত সুন্দর, সাজানো, সুশৃঙ্খল শিল্পী পাওয়া ভার! সিডনির অপার সৌন্দর্যের মহিমায় হারিয়ে গেছি বারবার আর কখনো নিরাশ হইনি।

স্মৃতির পাতা উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে এক রাতের কথা। আমি কাজ করে ফিরছি। বাস ডাউন টাউনে কানাডা পোস্টের সামনে নামিয়ে দিল। চালক জানালেন পরবর্তী বাস এদিক দিয়েই যাবে। বরফ কিছুটা গলে গেছে আর বাকি যা আছে তাতে অনায়াসেই হাঁটা যায়। আমার সঙ্গে আরেকটি ছেলে বাস থেকে নামল। ওর কথার টান শুনে বুঝতে কোনো অসুবিধাই হয়নি যে ও বাংলাদেশের ছেলে। ও ইংরেজিতে কথা বলে যাচ্ছিল। আমি একপর্যায়ে বলে বসলাম, ‘আমরা তো বাংলায় কথা বললেই পারি।’ সে কিছুটা হতবাক হয়ে বলল, ‘আরে, তুমি বাংলাদেশি?’ তবে ওর নামে কিন্তু একটা ভারতীয় আমেজ রয়েছে, শাহরুখ! তাবৎ পৃথিবী যাকে এস আর কে নামেই জানে। দেখা যাক, এ ছেলেকে সিডনি কোন নামে চেনে? নিজের ফোন নম্বর দিয়ে ও মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেল।

এই স্মৃতিময় শহর আমাকে যেমন দিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বন্ধুবান্ধব, আবার কাটিয়েছি অসাধারণ কিছু মুহূর্তও। সিডনির পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে মাটির একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে আসে, যেটা এখানেই পাওয়া যাবে হয়তো, অন্য কোথাও পাব না। মনে পড়ে যাচ্ছে, যখন বাড়িতে বেড়াতে গেলে পূজার ঘরে প্রণাম করতাম, তখন একটা মেটে গন্ধ নাকে আসত। আবার যখন পূজার মণ্ডপঘরে যেতাম, তখন ওই ঘরে ঢুকতেই আরেক রকম গন্ধ নাকে আসত। জায়গাভেদে আঘ্রাণের আমেজ বদলে যাচ্ছে। জানি না সকলের এমন হয় কি না!

শীতকালে যখন প্রথম চাকরি খোঁজা শুরু করি, তখন বেশ উঁচু একটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম কেন্টে। সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত পূরণ করে ফ্রন্ট ডেস্কে জমা দিয়ে ফিরছি; তুলার মতো স্বচ্ছ বরফ পড়ছে, যখন এসেছিলাম, এর কোনো ইঙ্গিত পাইনি!
আর যখন গ্রীষ্মকাল দেখছি প্রথমবারের মতো, তখন সারা দিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে আবার চলে যেতাম আড্ডা দিতে টিম হর্টনসে। ওখানে আগে থেকেই গ্র্যান্ড উপস্থিত থাকত আমার অপেক্ষায়। ও তখন চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরো নাম গ্র্যান্ড জোসেফ। দক্ষিণ ভারতের ছেলে। যে জায়গায় বসে আমরা কথা বলতাম, সেই রাস্তার ঠিক বিপরীত দিকেই ছিল ম্যাকডোনাল্ডস। কথার ফাঁকে আমি ওকে বলে বসেছিলাম, ‘দেখবে, ওখানেই তোমার চাকরি হবে।’ আর হলোও তাই!
তখনকার কথা পড়লেও কিছুটা হতবাক হই। সটান হেঁটেই চলে যেতাম সারা দিন কাজের পরও। আবার নয়টা–সাড়ে নয়টা নাগাদ বাসায় ফিরে আসতাম, কখনো ক্লান্তির ‘ক’ও বোধ করি মনে আসেনি। এখন মনে হয়, কোনো বিষয় যদি কোনো ব্যক্তির মনে সাড়া জাগায় এমনভাবে যাতে তা জীবনের সঙ্গে জুড়ে যায় অজান্তেই। তাতে কখনো অবসাদ বোধ হয় না। বড় দেশে সব আছে, কিন্তু সামাজিকভাবে যুক্ত হওয়ার সময় নেই বললেই চলে। মানুষ এখানে ঠিক মনুষ্যজীবের মতো বিচরণ করে না। সবাই কেমন যেন যান্ত্রিক। একটা সময় ছিল, যখন সবাই এক জায়গায় এলে আড্ডা হতো। আর এখন সবাই বসে এক জায়গায় কিন্তু যার যার দৃষ্টি তাক করা আছে স্মার্টফোনের দিকে! এটা আসলে স্মার্ট ফোন নয়, স্মার্টলি আনসোশ্যাল ফোন। একদিকে সবাই যতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, ততই এই জগতের বাইরে গিয়ে বাস্তবে তার সঙ্গে যোগাযোগের আগ্রহ কমছে! আমরা যখন কথা বলতাম, তখন ফোন পকেটে রেখেই কথোপকথন চলত। অজান্তেই একে অপরকে বাধা দিতাম ফোন ব্যবহার করা থেকে।

পরের বছর ও গাড়ি কিনল। একদিন আমার বাসায় এসে বলে, ওর কার্ড পাচ্ছে না আর এদিকে গ্যাস বাড়ন্ত। এখানে সবাই পেট্রল না বলে গ্যাসই বলে। যেখানে যেমন! আমার কার্ড নিয়ে গেল গ্যাস দিতে। ফিরে এসে দুজন একসঙ্গে বসে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। জানি এমন সময়ের দেখা হয়তো আর কখনও পাব না। কিছু মুহূর্ত কখনো হৃদয়ের অ্যালবাম থেকে মুছে যাবে না!

ডেভেনপোর্ট রোডের বাসা থেকে যেতাম অদূরে নর্থ সিডনিতে। চাকরির সুবাদে। পাক্কা এক ঘণ্টার রাস্তা। প্রাসঙ্গিকতায় বলে রাখা ভালো, এখানে কিন্তু যানজট নেই!
এ রাস্তা শুরু হতো শহরে আর বেশ গহীন রাস্তা পার হয়ে শেষ হতো ছোট্ট আরেকটা উপশহরে গিয়ে। রাস্তার গতিপথ আঁকাবাঁকা! যাত্রাপথের শুরুতে একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে যেতাম, এরপর আরেকটা ব্রিজ পথিমধ্যে আসত, যেটা পার হতে চালককে বেশ কৌশলী হতে হতো। এখনো ভাবি, কীভাবে সরু ওই ব্রিজের ভেতর দিয়ে চলে যায় ওই বাস! সিডনি থেকে শুরু করে সিডনি রিভার পেরিয়ে শেষ প্রান্ত নর্থ সিডনিতে পৌঁছাতে সময় লাগে পাক্কা এক ঘণ্টা। মনে রাখতে হবে, কোনো যানজট ছাড়া। মোট দূরত্ব ২৯ কিলোমিটার। তবে নর্থ সিডনি কিন্তু শেষ নয়, এরপরও আছে সিডনি মাইনস। এটাই শেষ গন্তব্যস্থল।

ফাইল ছবি

ডেভেনপোর্টের বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে কনকনে ঠান্ডায় জমে যেতাম আর বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম। যে জায়গায় দাঁড়াতাম ওটা ছিল ধোপার দোকান, ভগস ক্লিনারস। আমাদের বাসায় ব্যবস্থা ছিল, তাই এমুখো হতে হয়নি কখনো। মাঝেমধ্যে বাতাসের তীব্রতা আর বরফবৃষ্টি এত বেশি থাকত যে দোকানের ভেতর গিয়েই দাঁড়াতে হতো। তারপর বাস আসতে দেখলেই বেরিয়ে এসে বাসে উঠে পড়তাম। ওটার অপর দিকে ছিল একটা ওয়াইন বিক্রির দোকান। এক মেয়ে ওটার মালিক। ওর পোষা কুকুর প্রায়ই বাইরে এসে লাফালাফি করত আর মেয়েটা ছুটত কুকুরটার পেছনে। একদিন বেশ দূরেই চলে গিয়েছিল কুকুরটা। মেয়েটা হয়তো কাজের জন্য ভেতরে আটকে পড়ে গিয়েছিল। যখন বেরিয়ে এল, তখন বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, দেখিয়ে দিলাম। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর হয়তো কুকুরটাকে খুঁজে পেয়েছিল। কারণ, ও ফেরত আসার আগেই বাস চলে এসেছে। রাস্তার ঠিক অপর পাশে ছিল হোম হার্ডওয়্যার, এটা যাবতীয় আসবাব ও যন্ত্রপাতি বিক্রির দোকান। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে পরপর সাতবার এ দোকানের চক্কর কেটেও আমি ম্যানেজারের দেখা পাইনি, যখন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানে এটা আর হোম ডিপো—এ দুটোতেই মানুষ যন্ত্রপাতি কেনার জন্য যায়।

খুব একটা খাদ্যরসিক ছিলাম না। তবে রেস্টুরেন্টে যাওয়া হয়েছিল একবার। হ্যাঁ, চমকে ওঠার মতোই। আর বাদবাকি বলতে, পিৎজা খেতে দোকানে গিয়েছি। চিকিস পিৎজার ক্রিসপি চিকেন পিৎজাটা বরাবরই ভালো লেগেছে। কফি শপে যাওয়া হয় প্রায়ই। এই ছোট্ট শহরের আঁকাবাঁকা গলিতে আরও অনেক নিজস্ব মালিকানার রেস্তোরাঁ রয়েছে। ভারতীয় ছেলেরাও রেস্টুরেন্ট দিয়েছে আর পসার জমিয়েছে বেশ।
কিছু মুহূর্ত মনের কোণে সারা জীবন পাথেয় হয়ে রইবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হয়েছিল আর্ট গ্যালারিতে। কিন্তু ভাগ্যদেবীর কী মহিমা—দুই দিনের মধ্যে প্রশাসনিক জটিলতায় হারিয়ে বসলাম চাকরি! যেদিন অফারটা পেয়েছিলাম, সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে কেক–টেকও কাটা হয়ে গেছে। তারপর এল একাদশে শনির দশা! সকালে ছিল আমার প্রেজেন্টেশন আর এদিকে শুনলাম এই সংবাদ। ক্লাসের প্রেজেন্টেশনের পাঠ ঠিকঠাকমতোই চুকল। এরপর চাকরিতে ফিরে এসে দুঃসংবাদটা পেলাম। আশপাশের সবকিছুই কেমন যেন অসহ্য লাগছিল, তাই সিডনি রিভারের দিকে চলে গেলাম।

ওখানে গিয়ে ফেরার পথে ভুল বাসে চেপে বসলাম। দেখলাম বাস চলছে উল্টো রাস্তায়। তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে চালককে বললাম। উনি বললেন, কিছু করার নেই। উল্টো রাস্তায় যেতে পারবেন না। আমাকে বসে থাকতে বললেন। বাস ঘুরে ফেরত এলে আমি ইচ্ছে হলে সিডনি রিভারে নেমে যাব আর বসে থাকলে শেষ গন্তব্যে পৌঁছে দেবে বাস। দেখতে লাগলাম আশপাশের পরিবেশ। বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অজানা পথে হারিয়ে যেতে ভালোই লাগছিল। মুহূর্তের মধ্যে যেন ভুলে গেলাম চাকরি চলে গেছে। যা-ই হোক, পুরো রাস্তা ঘুরে বাস আবার আগের জায়গায় এসে পৌঁছালে বাসে উঠে বসল সুপ্রিত। আমার সঙ্গে একই কোর্সে পড়ে। ও আমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারল, কিছু একটা হয়েছে। সবকিছু ওকে বললাম। তখন ও আমাকে একটা কথা বলেছিল, যা মনে গেঁথে আছে, ‘ভালো মানুষের সাথে ভালোই হয়! তুমি দেখো, এখন যা ঘটে গেল, তা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হবে না।’ পরে অবশ্য হলোও তাই। এখন মনে হয়, ও যা বলেছিল, মন থেকেই বলেছিল।

অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই প্রিয়তম শহরে। অনেক স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে গেছে কিছু স্মৃতি। সবকিছু লিখতে গেলে তা হয়তো ছোটখাটো একটা রামায়ণে রূপ নেবে! জীবন গতিময়। সময়ের চাকা কখনো কারও জন্য সমান তালে ঘোরে না। একদিন জীবনের তাগিদে হয়তো ছেড়ে চলে যেতে হবে সিডনিকে। কিন্তু প্রথম থেকে শেষ অবধি সিডনি প্রেয়সী হয়েই রইবে। আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকব, যদি আবার কখনো ফিরে আসা যায় এই ছোট্ট শান্তির শহরে!