পড়ন্ত বিকেলে

‘এত দেরি হলো আসতে?’
আমি ইমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু বলছি না।
‘কী হলো, কথা বলছ না কেন?’
‘কী বলব, আজকে তোমাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়ানোর কথা ছিল।’
‘তো কী হয়েছে...?’

এটুকুতেই থেমে যায় ইমা। হয়তো বুঝতে পারে আমার পকেটে টাকা নেই। সেটা না বোঝার কিছু নেই। কেননা, আমি ইমাকে নিয়ে দু–তিনবার বোধ হয় ট্রিট দিয়েছে। আর ইমা যে কতবার ট্রিট দিয়েছে, তার হিসাব অগুনতি। তারপরও সে আমাকে পছন্দ করে। তার মনের মণিকোঠায় আমার জন্য ঘর বানায়। সেখানে অতি যত্নের সঙ্গে স্বপ্ন বোনে। সে কথা বহুবার বলেছে ইমা। তার ধারণা, আমার সময় একদিন খুব ভালো হবে। আমি চাকরি পাব। আমাদের সুন্দর একটা সংসার হবে। সংসার জীবনের সূচনা হবে, তার মনের মণিকোঠায় বানানো ঘরের মতো। সপ্তাহে একটা দিন সে ফ্রি থাকে। সেই দিনের অর্ধেকটা ইমা আমার জন্য বরাদ্দ রাখে। সেদিন ইমা আমার কাছ থেকে ট্রিট চায়। আমিও ভাবলাম, অনেক দিন হয় ইমাকে কিছু খাওয়াতে পারছি। সম্মতি প্রকাশ করলাম। রেস্টুরেন্টে নিয়ে ওর পছন্দের খাবার খাওয়াব। আজ সেই দিন। কিন্তু আমার পকেট যে একেবারে ফাঁকা।

ইমা চট করে বলে ওঠে, ‘ওকে, নো প্রবলেম। এখন আমার জন্য ১০ টাকার বাদাম নিয়ে আসো।’

আমার মনটাকে ভালো করতে ইমা বাদামের কথা বলে। সেটা বুঝতে পারলাম।
একটু এগিয়ে আমি বাদাম বিক্রেতাকে বললাম, ‘মামা, ১০ টাকার বাদাম দাও তো।’

বাদাম হাতে নিয়ে মানিব্যাগে দেখি পাঁচ টাকার একটা কয়েন ব্যতীত আর কিছুই নেই। বাদামওয়ালাকে বললাম, ‘সরি মামা এটা ধরো, মানিব্যাগে আর কোনো টাকা নেই। কিছু মনে কোরো না, অন্য দিন দিয়ে দেবনে।’
মাঝবয়সী বাদাম বিক্রেতা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘পকেটে টেহা নাই ভালা কথা, পিরিত করতে আইছেন ক্যা?’ এদিক-ওদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘মামা প্লিজ...’

ইমা এসে ১০ টাকার নোটটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘মামা, এই নিন আপনার টাকা। টিটু, তোমার কাছে খুচরা নেই, সেটা আগে বলবা তো।’

বাদাম বিক্রেতা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ইমা বলে, ‘কী হলো, টাকা ধরেন।’

টাকা দিয়ে ইমা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে, কয়েকটা কদম হাঁটল। আমি বুঝতে পারছি তার খুব রাগ হচ্ছে। আমাকে বলল, ‘টিটু, তুমি একটু দাঁড়াও আমি আসছি।’

আমি দাঁড়িয়ে আছি। ইমা বাদাম বিক্রেতার কাছে গিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলে, ‘মামা, আপনি ওকে কী বলেছেন?’

বাদাম বিক্রেতা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না।

ইমা আঙুল তুলে বলে, ‘বলবেন না তো, শুনুন তাহলে ওর পকেটে টাকা নাই। ও গরিব একটা ছেলে। সেটা জেনেই ওর সঙ্গে আমি প্রেম করি। পিরিত শুধু ও একা করে না, পিরিত আমিও করি।’

একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ইমার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আমি জানি, ইমা এমনই। আমাকে সেই প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাই আমাকে কেউ কিছু বললে সে মেনে নিতে পারে না। আমার মতো একটা অকর্মার ঢেঁকির প্রতি এত প্রেম! আচ্ছা, ইমা আমাকে এত ভালোবাসে কেন? আমি কি ইমাকে এতটা ভালোবাসি! কে দেবে এর জবাব? যদি এই কথা ইমাকে জিজ্ঞেস করি, কেঁদে বুক ভাসাবে। তবে ইমা খুব লক্ষ্মী মেয়ে। বাবা নেই। মা ও ছোট দুটি বোনকে নিয়ে দুঃখ–কষ্ট ভুলে হাসিমুখে বেঁচে আছে। সকালে টিউশনি, বিকেলে টিউশনি করে বোন দুটির পড়াশোনা ও বৃদ্ধ মায়ের ওষুধসহ সবকিছুই করছে। ওর মতো রূপবতী মেয়ে সমাজে খুব কম আছে।

নদীর তীরে বসে আছি। সামনে পানির ঢেউ আর ঢেউ। ইমা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে আমার হাতে দিচ্ছে। আমি বাদাম খাচ্ছি আর ডেউ দেখছি। ইমা বলে, টিটু, দেখো নদী কত সুন্দর।’

আমি বললাম, ‘হুম্‌ অনেক সুন্দর। তোমার চেয়ে বেশি সুন্দর নদী!’

ইমা আমার দিকে তাকাল। আবার নদীর দিকে। আবার আমার দিকে। তারপর বলল, ‘অবশ্যই নদী আমার চেয়ে সুন্দর। যার কোনো তুলনা হয় না।’
আমি একটু হেসে বললাম, ‘মানছ তাহলে।’

‘কেন মানব না। তুমি তো সত্যিই বলেছ। তা ছাড়া নদী হলো প্রকৃতির অংশ।’
‘ঠিক বলেছ, নদী প্রকৃতির অংশ। কিন্তু মানুষও তো প্রকৃতির অংশ। কেননা, প্রকৃতিই মানুষকে সৃষ্টি করেছে।’

এবার ইমা আকাশে দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানি না। তবে আমি শুনেছি প্রেমিকের দৃষ্টিতে নাকি প্রেমিকাই বেশি সুন্দর হয়।’
ইমা ওপরে তাকিয়ে আছে। আমাকে আর বাদাম দিচ্ছে না। আমি বললাম, ‘কী হলো, বাদাম দাও।’

ইমা আবার বাদামের খোসা ছাড়াতে শুরু করল। আমি ইমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি বোধ হয় নদীকে সুন্দর বলে ভুলই করেছি। যার জন্য প্রেমিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হওয়ার আগে আমাকে একটা কিছু করতে হবে। যে মেয়ে আমাকে এতটা ভালোবাসে, তার চোখের পানি অন্তত পক্ষে এই মুহূর্তে দেখতে চাই না। আমি নদীর পানিতে ঝাঁপ দিলাম। ইমা ভুরু কুঁচকে গেল। সে দাঁড়িয়ে বলে, ‘টিটু উঠে আসো।’

‘আমি আমি মিথ্যা বলেছি, ইমা। নদী সুন্দর। তবে তোমার মতো সুন্দর নয়। আরে, তোমাকে দেখলে তো চাঁদ লুকাবে, তোমার রূপের ঝলকের কাছে হেরে যাবে বলে। ফুলেরা ঝরে যাবে, তোমার সুন্দরের সঙ্গে পারবে না বলে। তুমি হাসলে ফুলেরা প্রাণ ফিরে পায়। তুমি কাঁদলে বৃষ্টিরা হয় অবাক! ওদের সঙ্গে মিলে যায় বলে।’

ইমা হেসে ফেলে। এই পড়ন্ত বিকেলে কী চমৎকার হাসি, যা এক জীবনে ভোলা যাবে না। আমি উঠে এসে ইমার মুখের নিচে দুই হাত পেতে ধরি। ইমা বলে, ‘কী করছ?’

আমি বললাম, ‘এত সুন্দর হাসি, যেন মাটিতে না পড়ে।’

ইমা আবার হাসল। যে হাসি পৃথিবী থেকেও সুন্দর।

লেখক: গল্পকার। [email protected]