ফলস প্রেম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি আপনার সঙ্গে প্রেম করতে চাই। চমকে জবা দেখে সুমন্তর বাবা! ছেলেটা তার মেয়ে মাটির সঙ্গে পড়ে। এ রকম অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে জবা বেকুব হয়ে তাকিয়ে রইল। মুখে কথা সরছে না। ভদ্রলোক আস্তে করে বললেন, সত্যি প্রেম না। মিথ্যা প্রেম...মুখ ফসকে বের হয়ে গেল, সেটা আবার কী রকম? বলেই জবা অবাক! তার তো আসলে এমন কথা শুনে হেঁটে অন্যদিকে সরে যাওয়ার কথা ছিল। এ বয়সে কেউ এমন বলে নাকি? আপনাকে দেখার পর থেকে আমার মাথায় ফলস প্রেম ঘুরছে!

জীবনের এ পর্যায়ে এসে সত্যি প্রেম সম্ভব না। না আমার না আপনার...! কিন্তু আপনাকে ভালো আমার বাসতেই হবে। এর থেকে আমার মুক্তি নেই। কেন আমার সময়ে জন্মালেন না? কেন আমার হাত ধরে শর্ষেখেতে হাঁটতে গেলেন না...এ আমি মানতে পারছি না। আবার আমরা স্বাভাবিক সিভিল মানুষ, ফালতু পরকীয়াতে আমি বিশ্বাস করি না। কারও পরিবার কষ্ট পাক, সেটা আমি চাচ্ছি না। তাই প্রতিদিন পাঁচবার করে বলব আপনাকে ভালোবাসি। আপনি কিছু বলবেন না...ওই পাঁচবারই আমার চোখে একবার করে তাকাবেন। আর কিছু করতে হবে না। এর বেশি আমার কোনো অ্যাকটিভিটিস থাকবে না। আপনি বড়জোর ভাবতে পারেন লোকটা পাঁচবার মিথ্যা করে ভালোবাসল! আর কিছু না। এর বাইরে আমি আপনার ওপর বাড়তি একটা পলক ও ফেলব না!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এ রকম পাগলামি উদ্ভট ধরনের কথা শুনে জবা হতভম্ব! এ লোকের তো মনে হয় চিকিৎসা দরকার। অবশ্য দেখে খুব চোস্ত ভদ্রলোক মনে হয়। সুমন্তর মায়ের সঙ্গে জবার পরিচয় আছে। ভদ্রমহিলা চাকরি করেন বলে বাবা ছেলেকে স্কুলে দিতে আসেন। উনি বোধ হয় কোনো কিছুর ব্যবসা করেন। প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই জবার মনে হলো মাটির বাবা তাকে কবর দিয়ে দেবে! এ কেমন ধরনের কথা? সে হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে সরে গেল।

মহসিন অফিসে এসে চুপ করে বসে রইল। আয়নায় একবার বোকা বোকা চেহারাটা দেখল সে। একজনকে মনে মনে ভালোবেসে যাওয়া এক কথা, আর ফট করে তাকে তা বলে দেওয়া আরেক কথা! বল মারা হয়ে গেছে! কেন সে এটা করল? দুই বাচ্চার বাবা মধ্যবয়সী একজন গৃহী মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আরেকজন এক বাচ্চার মা তরুণী মেয়েকে ভালোবাসার কথা শোনাচ্ছে? সে এমন নয়। যথেষ্ট চাপা মানুষ সে। মনে মনে প্রেম তো আমাদের কতই হয়। বাসে, মাঠে, ঘাটে কত মেয়েকেই তো ভালো লাগে! তাতে কী হয়েছে? তার স্ত্রী যথেষ্ট সুন্দরী। দুহিতা শুনলে খুব কষ্ট পাবে। দুজনেই শালীন মানুষ, যথেষ্ট সুখী বলা চলে।

দুই মাস ধরে সুমন্তকে স্কুলে দিতে এসে এই নারীকে দেখে সে বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে! অত সুন্দর চোখ মানুষের হয়? হবে কেন? আর হলোই যদি তবে মেয়েটি তার বউ কেন হলো না? বউ, বাচ্চা কারও কথা মনে রইল না। হঠাৎ একা নিজের ওপর তীব্র রাগ হলো! কেন ওই চোখ এখন আমার সামনে আসবে? পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেওয়া গেল। আরে আরে এসব কী হচ্ছে?

এর পরের দুই মাস মহসিন অনেক ভেবেছে...সেই কলেজে পড়ার সময়ে সে একবার লঞ্চে করে বরিশাল গিয়েছিল। তখন ডেকে এক মেয়ের ঠিক এ রকম চোখে সে আটকে ছিল সারা রাত। কোনো কথা হয়নি, ভাব বিনিময় না। কিছু না...শুধু মেয়েটির চোখে তার চোখ আটকে ছিল। খেতে যেতে পর্যন্ত ইচ্ছা করেনি, যদি ওই চোখ চলে যায়? একদম কিছু ছাড়াই তারা বরিশাল লঞ্চঘাটে সকালে নেমে যায়। সেদিন সারাটা দিন অদ্ভুত বিষণ্ন হয়ে থেকেছে সে। বিকেলে রিকশা নিয়ে বের হয়ে শহর চষে বেড়িয়েছে, কিন্তু সেই চোখ নেই। মেয়েটা খুব সুন্দর ছিল এমন নয়, কিন্তু কোথায় একটা ম্যাজিক ছিল তার! ধরতে পারেনি মহসিন। এ এত বছর পর সে আবার ওই চোখে আটকাল! এমনও হয়? মানুষ দুটো অবশ্যই এক নয়।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এ দুই মাস অফিস সংসার সব ঠিক থেকেছে, শুধু সে ভেঙে গেছে। মাটির মায়ের নাম ও সে জানে না! ভদ্রমহিলা আজ নির্ঘাত তাকে পাগল ভেবেছে। সেটাই ভাবার কথা। তীব্র লজ্জা তাকে গ্রাস করল! কিন্তু মনে মনে একধরনের শান্তিও পাচ্ছে সে। কোথায় একটু সুখের পরশ। ভালোবাসা সামনাসামনি কবুল করতে পারার মধ্যে নিষিদ্ধ আনন্দ আছে! হোক যা খুশি...বিচার করলে করুক। আমি ভালোবাসি তাকে, এর চেয়ে বড় সত্য নেই।

পরের সাত দিন সে মাটির মায়ের সামনে পড়ল না। দূর থেকে দেখল। ভদ্রমহিলা যেন ভাবেন সে ভুল শুনেছে! এটা একটা খেলা...আট দিনের মাথায় জবা সুমন্তর বাবাকে সামনে দেখে কেমন একটা বিট মিস করল খামোখা। করার কথা নয়...সব তো মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু ভদ্রলোক সোজা হেঁটে চলে গেলেন! সে দ্রুত সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে দেখে উনি চলে গেছেন। জবা মাটির বাবাকে কিছু বলেনি। মেয়েদের অনেক বুঝে চলতে শিখতে হয় ছোটবেলা থেকে। কত নিষিদ্ধ অত্যাচারের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়, এটা শুধু মেয়েরাই জানে! এখন পরিণত জীবনে এসে সে ১৮ বছরের ভুল করবে না। কিন্তু সুমন্তর বাবার সোজা তাকিয়ে চলে যাওয়া তাকে একটু মন খারাপ করিয়ে দিয়েছে। কেন হলো তা সে বুঝতে পারছে না। মাটির বাবা, রাজীব, একটু রাগী, মনের বাইরে কিছু দেখলেই চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। হঠাৎ বউকে চড়–থাপ্পড় ও দেয় সে এবং পরিবারের সঙ্গে সে ঘরোয়া আড্ডা দেয় না। অফিস বাসা টিভি এই জীবন। বৃহস্পতিবার কোথায় যেন তাস খেলতে যায়, ফিরতে রাত করে। তবে ঘরের বাইরে থাকে না। সপ্তাহে একবার স্বামী–স্ত্রীর ব্যাপার ঘটে সেটাও অনেকটা অফিস টাইপের। যেন কর্মচারীকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে! কর্মচারী কাজ পেয়ে ভালো বোধ করছে নাকি বিরক্ত, এগুলো তার মাথায়ই নেই।

এ রকম একটা নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ ফলস প্রেম! অজান্তেই সে নিজেকে আয়নায় অনেকক্ষণ দেখেছে। না, সে দেখতে খারাপ নয়। তবে খুব সুন্দরীও নয়। সুমন্তর মায়ের সামনে তো সে কিছুই না! কলেজজীবনে এক ছেলে তাকে বলেছিল জীবনানন্দ স্বপ্নে হলেও তার চোখ দেখেই ‘বনলতা সেন’ কবিতা লিখেছিল! তখন তার বুকের রক্ত ছলকে গিয়েছিল! কিন্তু ভয়ে সে সিঁটিয়ে ছিল। ও রকম কাব্য করে কথা বলা ছেলেটি ছিল গুন্ডা ধরনের...! ঝপ করে সুমন্তর বাবাকে মনে হলো সেই গুন্ডা ছেলেটি!

সাত দিনও যখন কিছু ঘটল না, অষ্টম দিনেও না...জবা ভাবল কোথাও সে ভুল করেছে। নিজের মনে উদ্ভট চিন্তা করেছে! দশম দিন হঠাৎ শুনল আমি আপনাকে ভালোবাসি...চমকে তাকিয়ে জবা অবাক! ভদ্রলোকের চোখে জল টলমল করছে...বলেছিলাম শুধু আমার দিকে তাকালেই চলবে, আপনি কিছু বলবেন না। ঠিক আছে, তা–ই করেছেন। ধন্যবাদ। কিন্তু আমি আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না...বাঁচতে পারব না...এটি একটি মিথ্যা কথা। কিন্তু আমার চোখের জল মিথ্যা নয়। সে আপনার জন্য বইছে...

জবার ক্ষমতা থাকল না কিছু আটকানোর...সেও ভেসে যাবে! অবশ্যই ভেসে যাবে। যা হওয়ার হোক। মিথ্যামিথ্যি ভেসে যাওয়া। যে রোগের যে চিকিৎসা! তবে অদৃষ্ট সেই মিথ্যাকে নিয়ে চলেছে সত্যের কাছে, এটা তাদের জানা রইল না।