ফোনরঙ্গ

গত রোববার দুপুরবেলা অবসরে একা বসে আছি। মনে হলো কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলি। কয়েকজনকে ফোন দিলাম, কেউ ফোন ধরছে না। আবার আপনি কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুরু করেছেন, দেখবেন রাজ্যের সব ফোন এই সময়টাতেই আসছে। যে বছরে একবার ফোন দেয় না, তারও জরুরি আলাপ। তেমনটাই হয়েছিল আমার। সমস্যা আর তার সমাধানের উপায় যে বাতলে দিতে হবে আমায়। সমস্যার রকমফের।

ফোনকল–১
ভাই, ছোটখাটো একটা বিপদের মধ্যে আছি, আমাকে একটু সাহায্য করেন। আমি বলি, বিষয় বলেন। তিনি বললেন, বউয়ের যন্ত্রণায় আর এখন সেলফোন ধরতে পারছি না। আমি বলি, কেন ধরতে পারছেন না, সেটা আগে বলেন। তিনি আমতা–আমতা করে বললেন, ইদানীং ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই শুধু মোটা নারীদের বিজ্ঞাপনের ছবি আসছে, যা তার স্ত্রীর সন্দেহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি মাঝেমধ্যে ওসব ওয়েবসাইটে বিচরণ করেন। তিনি আমতা–আমতা করে বললেন, হ্যাঁ। ‘হ্যাঁ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমি শুনতে পেলাম দাঁড়াশ সাপের ফোঁসফাঁস আওয়াজ। কী করতে হবে বাতলে দিলাম। ভদ্রলোক ধন্যবাদ বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি ‘ধন্য’ পর্যন্ত শোনার পরই লাইনটা কেটে গেল বা কেটে দেওয়া হলো। ভদ্রলোকের ভাগ্যে এরপর কী ঘটেছিল জানি না।

ফোনকল–২
চাচার ফোন। বয়সে প্রবীণ। বয়স বাড়লে মনে হয় মানুষের অর্থের প্রতি মমতা জন্মায়—আরও চাই, আরও চাই একটা খাই খাই ভাব জাগে। চাচার ছোট একটা ব্যবসা আছে। কয়েক মাস আগে চাচার ঘনঘন ফোন। প্রণোদনার টাকা কখন দেবে, কত দেবে, কোথায় দেবে, কীভাবে দেবে, ফেরত দিতে হবে কি না, নানা প্রশ্ন। যতটুক জানি বলেছিলাম। এরপর আর চাচার খোঁজখবর নেই। পরে জেনেছিলাম, চাচা ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার সাহায্য, অর্থাৎ খুব সহজ শর্তের ঋণ পেয়েছিলেন। চাচাকে জিজ্ঞাসা করি, এত দিন পর আবার কী মনে করে, খবর কী? না মানে দ্বিতীয় প্রণোদনা নাকি আসছে। আমি বলি, এটা তো এখনো গলফের মাঠে। চাচা বললেন, হেঁয়ালি কোরো না। আমি বলি, আগেরবারের চেয়ে এবার আরও বেশি পেতে পারেন, চাচা। জিজ্ঞাসা করি, গতবার কত পেয়েছিলেন। চাচা এই সামান্য বলে ফোনটা রেখে দিলেন।

ফোনকল–৩

ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করার আগেই বললেন, ভাই, হালকা গান আর ভারী গান বলতে আপনি কী বোঝেন? আমি বলি, কেন ভাই। আরে ভাই, বউয়ের যন্ত্রণায় এখন তো গানও শুনতে পারছি না, আমি নাকি হালকা গান শুনি। সারা দিন শুধু গুজুরগুজুর করে। আমি কেসটা ধরতে পেরেছি। বললাম, ভাবি যে গান পছন্দ করেন, সে রকম গান শোনেন, দেখবেন বাড়িতে শান্তি আর শান্তি। তিনি বললেন, আরে ভাই, নিজের পছন্দের গানও কি শুনতে পারব না, আপনিও তাহলে আপনার ভাবির দলের। গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে আর কিছুই রইল না। ফোনের অপর প্রান্তের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন। পুরুষকণ্ঠ থেকে নারীকণ্ঠ। দাদা, আপনার ভাইরে একটু সামলান, বলছিলেন ভাবী। আমি জিজ্ঞাসা করি, কী হয়েছে? আর বলবেন না, ঘুম থেকে উঠে সারা দিন সোফায়। কাজ নেই, কর্ম নেই, একটু পরপর তারে চা দেন, পান দেন, ফোনে দুনিয়ার উজির–নাজির মারে। মানুষরে উপদেশ দেয়। কী করিতে হইবে, কী করিলে কী হইবে। আমি বলি, এটা ঠিক না, বাড়িতে যখন আছেন, আপনাকে তো একটু সাহায্য–সহযোগিতা করতেই পারেন। আমি অবশ্য আপনার বউদিকে সাহায্য–সহযোগিতা করি। ভাবী বললেন, দেখেন তো বউদির কী ভাগ্য! আমার পোড়া কপাল, তাকে যদি বলেন বাইরে থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসো, বলে বাইরে নাকি করোনা। এদিকে সোফায় বসে বসে তো বছর পার। ভুঁড়ি বেড়েছে, শার্ট–প্যান্ট পরলে বোতাম ছিঁড়ে যায়, দেখেন তো বাচ্চাকাচ্চারা বড় হয়েছে। কী লাড়েলাপ্পা মার্কা হালকা গান ফুল ভলিউম দিয়ে বাজাচ্ছে। শুনুন একটু...ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে, ‘কেইসে বানি, কেইসে বানি...।’

ফোনকল–৪
অপরিচিত নম্বর থেকে কল। ধরে দেখি আমার এক পুরোনো বন্ধু। বন্ধু ডেট্রেয়েট ডাউন টাউনে আটকা পড়েছে। তাকে আনতে হবে। গেলাম তাকে আনতে। ফেরার পথে দেখি হাইওয়ে একেবারে ফাঁকা। নতুন গাড়ি, এসকেলেটারটা চাপিয়ে দিলাম। গাড়ি বাতাসের বেগে ছুটতে লাগল। আমার গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল আরেক সুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনী। একবার আমি আগ বাড়ছি তো একবার ও। এভাবে চলতে চলতে একসময় দ্রোম আওয়াজ। এরপর কী হয়েছিল জানি না। যখন ঘুম ভাঙল দেখি হাসপাতালে। পাশের কেবিনে এক সুন্দরী নারী। বন্ধু মিল্টনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই নারীকে তো খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি। বন্ধু বলল, এর জন্যই তো এখন হাসপাতালে। ভদ্রমহিলা মিল্টনকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কী বিড়বিড় করছ। বন্ধু বাংলায় বলল, বান্দর বুড়া হইলেও তার বাঁদরামিটা ছাড়ে না। সুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বানডর...।

  • লেখক: পার্থ সারথী দেব, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র