ফ্রন্টলাইনার: প্রাপ্তির চেয়ে মানবতা যেখানে মুখ্য

ফ্রন্টলাইনার বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মানবতার সেবায় নিয়োজিত মানব। করোনাকালো স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কয়েক মিলিয়ন ফ্রন্টলাইন কর্মী তাঁদের কাজ চালিয়ে গেছেন। এ পরিশ্রমী নায়কেরা জনগণের খাদ্য সরবরাহ, তাদের আবর্জনা পরিষ্কার করা, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, মুদি ও প্যাকেজ সরবরাহে নিয়োজিত থেকেছেন। অন্যদিকে হাসপাতালে অসুস্থ মানুষের সেবায় নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে নিয়োজিত থেকেছেন কর্তব্যরত নার্স, ডাক্তার, রেডিওলজিস্টসহ সব স্তরের কর্মীরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পেশার স্বার্থে এ মানবতা সম্পর্কিত হলেও, দায়িত্বপালনরত ফ্রন্টলাইনাররা তাঁদের প্রাপ্তির চেয়ে সেবাদানের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন বেশি। তাই সাধারণ মানুষের কাছে ফ্রন্টলাইনাররা পান বীরের মর্যাদা। আর আমি হেলথকেয়ার পেশায় প্রবেশের পর খুব কাছ থেকে দেখেছি, কীভাবে একজন রোগীর সেবায় নিয়োজিত প্রতিটি প্রশিক্ষিত সেবক সদা সচেতন, ঠিক যেমন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত অতন্দ্র সৈনিক। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যকর্মীরা একেকজন বীর সৈনিক।

হেলথকেয়ার পেশায় যুক্ত হওয়ার আগে ঠিক যথাযথ উপলব্ধি করতে পারিনি সত্যিই এ পেশা কত মহান। এ পেশায় নিয়োজিত হতে হলে শুদ্ধ মানুষ হতে হয়। আর শুদ্ধ মানুষ হওয়া বড়ই কঠিন! যতই প্রকাশ করি, আমি মানুষের সেবা করি, আসলেই কি সবটুকু সত্যি? না, সত্য হয়তো নয়! আমি টাকার জন্য করি...সেই সঙ্গে অসুস্থ মানুষ দেখলে মনটা মোমের মতো গলে যায়! কিন্তু একজন নার্স যেভাবে রোগীর শরীরনিঃসৃত পুঁজ -রক্ত পরম যত্নে পরিষ্কার করেন, তার মূল্য নিশ্চয় টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না। নিজের দুটো সিজারিয়ান ডেলিভারির অভিজ্ঞতায়, নার্সদের পরিচর্যায় আমি শ্রদ্ধায় বিস্মিত! আমি আজন্ম কৃতজ্ঞ তাঁদের কাছে। কিন্তু সেই মহান কাজটি করার দুঃসাহস আমার নেই! তাই তো প্রবাসে খুব ভেবেচিন্তে প্রফেশনাল জীবন বেছে নিয়েছিলাম একজন সনোগ্রাফার হিসেবে। কিন্তু কাজ যখন রোগী নিয়ে, তখন রোগীদের সেবা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আজ যে অভিজ্ঞতা হলো, সেটা পুরোটাই অনভিপ্রেত, যা আজ সারাটা দিন আমাকেই অসুস্থ বানিয়ে রাখল।

ভোর হতেই আলট্রাসাউন্ডের মেশিন নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুম থেকে আইসিইউ, কখনো আইসোলেশন রুমে করোনা রোগীর কাছে, তারপর আবার এলিভেটর ধরে ফ্লোর থেকে ফ্লোরে ছুটে বেড়াই। একজন ৩০০ পাউন্ড ওজনের অনবরত তরল কফে কাশিরত আফ্রিকান-আমেরিকান যুবককে একোকার্ডিওগ্রাম করতে গলদঘর্ম হয়ে যখন তাকে সঠিক পজিশনে আনলাম এবং স্ক্যান করার কিছুক্ষণ পর যখন ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল, তখন সে আর আমাকে স্ক্যান করতে দিতে রাজি নয়, খাবে বলে। অগত্যা ইলেকট্রোডগুলো খুলে তাকে খেতে দিয়ে আমি অন্য পেশেন্টের কাছে গেলাম। ফিরে এসে আবার সবকিছু সেট করে তার হার্টের ছবি নিতে লাগলাম। আর সে বুকের শ্লেষ্মা আলোড়িত করে অনবরত কেশেই যাচ্ছে ঘড়ঘড় করে আর কখনো গিলে খাচ্ছে উঠে আসা মিউকাস। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল আমার...তবু দম বন্ধ করে নির্ভুলভাবে তার ভাল্‌ভ হতে লিক হওয়া ব্লাডের ভেলোসিটি নির্ণয় করছিলাম মনোযোগের সঙ্গে।

হঠাৎ সে প্রচণ্ড শব্দ করে শোয়া থেকে বসে গেল তার উঠে আসা মিউকাস ফেলতে...আমি তড়িঘড়ি কিছু না পেয়ে পুরো গার্বেজ ক্যানটা উঠিয়ে নিয়ে এসে ধরলাম তার মুখের সামনে। তার ছুড়ে দেওয়া গলিত মিউকাসের নহর গার্বেজে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়ে আমার গ্লাভস পরা হাতেও। সে অসহ্যকর দৃশ্যে ঝটপট হাত থেকে গ্লাভস খুলে ফেলে রোগীদের অবাক করে দিয়ে এবার আমিও শুরু করলাম কয়েকবার ইয়াক্— ইয়াক্ উদ্‌গিরণ! রোজায় পেট থেকে কেবল বেশ পানি বের হলো!
নার্স- ডাক্তাররা ছুটে এলেন আমায় সামাল দিতে; আমার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে ছুটে এলেন অন্য এক সনোগ্রাফার। কিন্তু আমি যেহেতু বাম হাতে কাজ করি, আর সে ডানহাতি হওয়ায়, বাম সাইডে পজিশনরত মেশিনের কাছে আবার আমি ফিরে গেলাম চোখমুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে। তারপর সারাটা দিন কিছুক্ষণ পর পর গা গুলিয়ে উঠেছে সে শব্দময় দৃশ্যের স্মৃতিচারণে...আর প্রতিবারই ওয়াক ওয়াক অনুভূতির সঙ্গে শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয়েছি আমি একজন স্বাস্থ্যকর্মীর ভূমিকায়।