বগি ঘর: সভ্য দেশের এক অসভ্য সংস্কৃতি

১৯৯১ সালে আমি দেশ ছাড়ি। ইংল্যান্ডে এসে অবৈধ অভিবাসী ছিলাম দীর্ঘ সময়। কাজ করেছি রেস্তোরাঁয়। ওই সময়ে বিপথে বা বখে যাওয়া কোনো লোক সম্পর্কে অন্যদের প্রায়ই একটা কথা বলতে শুনতাম, ‘আরে ওই লোক বগি ঘরে যায়, ঘোড়া-কুত্তা খেলে’। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, বগি ঘর কী, ঘোড়া-কুত্তা খেলাটাই–বা কী? একদিন এক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ভাই, বগি ঘর কী?’  কড়া ভাষায় জবাব,
‘ভুলেও ওই পথে পা বাড়াবেন না।’
‘তা না হয় বাড়ালাম না, কিন্তু বিষয়টি কী?’
‘বললাম না, এসব শিখবেন না।’

পা বাড়ানোর নিষেধাজ্ঞার কারণে বগি ঘর কী জিনিস, তা শেখা হলো না, জানা হলো না অনেক দিন। এর বছর দেড়েক পর পশ্চিম ইংল্যান্ডের বাথ শহরে কাজ করতে যাই। সেখানে রোজ দুপুরে দেখি, খাওয়াটাও ভালো করে শেষ না করেই হুড়মুড় করে কিছু সহকর্মী বেরিয়ে যান। তাঁরা কোথায় যান, অন্যদের জিজ্ঞেস করলে সেই পুরোনো উত্তর, ‘বগি ঘরে, ঘোড়া–কুত্তা খেলতে।’

ওই পথ মাড়ানো নিষেধ সত্ত্বেও একদিন তাঁদের অনুসরণ করে বগি ঘরে পৌঁছে যাই। ঘরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে কিছু টেবিল–চেয়ার, তিন দিকের দেয়ালে আটকানো অনেকগুলো টিভি স্ক্রিন, একটি কাউন্টারে দুজন বসে টাকাপয়সা দিচ্ছেন, নিচ্ছেন। ১৫–২০ জন লোকময়লা কাপড় পরে, ধূমপান করতে করতে অস্থির, উৎকণ্ঠা নিয়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে ঘোড়া ও কুকুরের দৌড় প্রতিযোগিতা দেখছেন। কেউ কেউ আবার চিৎকার করছেন, ‘come on, come on busterd, come on...।’ দৌড় শেষ হলে কারও মন খারাপ, কেউবা খুশি হয়ে কাউন্টারে গিয়ে টাকা নিয়ে আসছেন। প্রথম দিন কিছু না বুঝলেও অল্প দিনের মধ্যেই এ সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পেতে সক্ষম হই।

দেশে থাকতেই জানা ছিল, ফিল্মেও দেখেছি, ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান বড় শহরগুলোতে জুয়া খেলার ক্যাসিনো আছে। বাজি ধরারও যে বৈধ ও প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আছে, তা জানা ছিল না। ইংল্যান্ডের সব পাড়া-মহল্লায় আমাদের দেশের মুদিদোকানের মতো বাজি ধরার দোকান আছে, যাকে Batting shop বলা হয়। বাজির অন্য পক্ষ, অর্থাৎ এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় বুকি (bookie), তারাই বাজির মূল্য নির্ধারণ করে, তাদের সঙ্গেই মূলত বাজিটা ধরা হয়। বোঝা গেল, এ bookie শব্দের উচ্চারণ বাঙালি কমিউনিটিতে এসে রূপান্তরিত হয়ে বগি হয়ে গেছে। এ বেটিং শপগুলোতে প্রধানত ঘোড়ার দৌড়, কুকুরের দৌড় প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ের ওপর বাজি ধরা হয়। তবে সব প্রকার খেলাধুলার হার-জিতের ওপর বাজি ধরা একটি স্বাভাবিক, সাধারণ ব্যাপার। এ ছাড়া নির্বাচনে জয়–পরাজয়, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ওপরও বাজি ধরা যায়। নির্বাচনে লেবার, নাকি কনজারভেটিভ জিতবে, এ বছর ক্রিস্টমাসে স্নো পড়বে কি না, এমন বিষয়সহ অনেক বিচিত্র বিষয় নিয়েও অনেকেই বাজি ধরেন। ’৯৪ সালে পশ্চিম লন্ডনের হ্যারো এলাকায় এক ভদ্রলোক এক পাউন্ডের বাজি ধরলেন, তার ৩ বছর বয়সী ছেলে ২১ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে ফুটবল খেলবে। যদি সে জাতীয় দলে খেলে, তিনি এই এক পাউন্ডে বিশাল একটি অঙ্ক জিতবেন। অনেক দিন আগে স্থানীয় পত্রিকায় পড়েছিলাম, তাই প্রকৃত অঙ্কটা এখন মনে করতে পারছি না, তবে মিলিয়ন পাউন্ডের ওপর ছিল।

বাজি ধরা এ দেশের একটি স্বাভাবিক খেলা। এটা সমাজে স্বীকৃত, রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধ এবং এটা তাদের ঐতিহ্যেরও অংশ। ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করেই এ বাজি ধরার সংস্কৃতি এবং ঘোড়দৌড় শুধু তাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অংশই নয়, এটাকে কেন্দ্র করে নাকি তিন-চার বিলিয়নের অর্থনীতিও জড়িত।

এ দেশে বাঙালি অভিবাসীরা ব্যাপকভাবে পরিবার আনতে শুরু করেন আশির দশকের প্রথম দিকে। তার অনেক আগে থেকে পুরুষপ্রধান বিশাল একটি বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী এ দেশে বসবাস করে আসছিল। অনেক দিন থেকে বসবাস করলেও তখনো এখানে দেশীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে একটি বাংলাদেশি সমাজ প্রতিষ্ঠা বা বিকাশ লাভ করেনি, তাই অভিবাসীদের সামাজিকতার বা পারিবারিকভাবে মেলামেশার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার কারণে মূলধারায়ও তাঁরা মিশতে পারতেন না, তাই কাজের বাইরের অবসর সময়টুকু গৃহে নিজেদের মধ্যে তাস খেলে বা সিনেমা দেখে কাটাতেন। ওই সময় যেখানে–সেখানে বেটিং শপ থাকার কারণে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নিঃসঙ্গ বাংলাদেশি অভিবাসী বাজিতে আসক্ত হয়ে পড়েন। আশির দশক থেকে পরিবার-পরিজন আসার কারণে এ দেশে একটি বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। সামাজিকতা, ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ফলে বাজিতে আসক্ত লোকের সংখ্যা কমতে থাকে। কমতে থাকলেও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, তাই নব্বইয়ের দশকে এসেও অনেককেই এই সুস্থ জীবন ও কষ্টার্জিত অর্থ বিনাশী নেশায় আসক্ত দেখেছি। এ আসক্তি মাদকাসক্তির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং অনেক বিবেচনায় আরও ভয়াবহ। এর প্রতিক্রিয়া অনেক গভীর ও সুদূরপ্রসারী। মাদকের নেশা একজনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে, বাজিতে আসক্ত ব্যক্তির অর্থনৈতিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় দ্রুত। সংগত কারণেই তখন সুস্থ মানসিকতা ও বুদ্ধি-বিবেচনা লোপ পেতে থাকে, সেই সঙ্গে তাঁর ওপর নির্ভরশীল পরিবারটিও সীমাহীন অর্থনৈতিক দুর্যোগে পড়ে যায়।

দুই–তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাজিতে আসক্ত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়, যিনি ২০–২৫ বছর আগে দেশে গিয়ে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ফিরে এসে বাজিতে আসক্ত হয়ে পড়েন, এ মারণাসক্তির কারণে আর দেশে যেতে পারেননি, স্ত্রীকেও আনতে পারেননি। ভদ্রলোক একটি কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছিলেন এবং তাঁকে দেখেছেন ৩০ বছর পর, যখন মেয়েটি লন্ডনপ্রবাসী একজনকে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে এ দেশে এসেছিলেন!
’৯৮ সালে সাউথ-ইস্ট লন্ডনে এক ভদ্রলোককে দেখেছি মাত্র পাঁচ মাসে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও একটি বাড়ি খুইয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে। আক্সব্রিজ এলাকায় এক ভদ্রলোককে জানি, ষাট দশকে কিশোর বয়সে এ দেশে এসেছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এ শতাব্দীর শুরুতে এখানে মৃত্যুবরণ করেছেন, কোনো দিন আর দেশে যেতে পারেননি, সংসার করার তো প্রশ্নই আসে না।

উল্লিখিত তিনটি ঘটনা বাজিতে আসক্ত ব্যক্তির খুবই স্বাভাবিক ও অবধারিত পরিণতির উদাহরণমাত্র। এ ছাড়া কিছু বাজিতে আসক্ত ব্যক্তির পরিণতির কথা শুনেছি, যা আরও ভয়াবহ আর করুণই শুধু নয়, খুব বীভৎস ও ভয়ানক কুৎসিত। এসব পরিণতির বিস্তারিত বর্ণনা ক্ষেত্রবিশেষে ছাপারও অযোগ্য।

ভাগ্য ফেরাতে আসা এমনই অনেক ভাগ্যাহত বাঙালি ব্রিটিশ সমাজের বাজি ধরার সংস্কৃতির মোহজালে আবদ্ধ হয়ে নিঃস্ব-রিক্ত হয়েছেন, পেয়েছেন সমাজ ও প্রিয়জনের ঘৃণা আর উপেক্ষা, তার সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। তাঁদের খবর কেউ রাখেনি। নিঃসঙ্গ, সরলপ্রাণ এ অভিবাসীদের এমন ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করার পর সভ্য দেশের এ অসভ্য রীতি, এ অসভ্য সংস্কৃতির বৈধতা কতটুকু যৌক্তিক, এ প্রশ্ন তো করতেই পারি?