বন্ধু যখন লোকাল গার্ডিয়ান

সপরিবারে মামুন ভাই। ছবি: সংগৃহীত
সপরিবারে মামুন ভাই। ছবি: সংগৃহীত

অবশেষে বুয়েটে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো। নিয়মানুযায়ী শুরু থেকেই যথারীতি হলে সিটও পেয়ে গেলাম। যে হলে সিট সেই হলেই খুঁজে পেলাম আমাদের কুষ্টিয়ারই এক বড় ভাইকে, মেজবার রহমান। হলে ওঠার আগে সবাই পরিচিত মানুষদের খুঁজে নেয় তাহলে হলের জীবনযাপন সহজ হয়ে যায়। যেই রুমে সিট পড়েছে সেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার পর উনি বললেন কয়েক দিন সময় লাগবে। মেজবার ভাইকে সেটা জানানোর পর উনি তাঁর নিজের বিছানা আমাকে ছেড়ে দিলেন। বললেন, যত দিন নিজের বেডে উঠতে না পারো তত দিন আমার বেডে ঘুমাও। এভাবেই শুরু হলো আমার হল জীবন।

কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এসে সেই প্রথম পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়া। বিকেল হলেই বুকের বা পাশে একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়। বারবার মনে পড়ে ছোটবেলার বন্ধু সালাম, বিদ্যুৎ, শংকর, জাহিদের কথা। প্রতিদিন বিকেলে একেবারে রুটিন করে আমাদের গ্রামের পেছনের মাঠে হাটতে যাওয়া। ঢাকা শহরের এই বদ্ধ পরিবেশে মনটা তাই খুঁজে ফিরে মাঠের নির্মল বাতাস আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবুজ শস্যের নেচে যাওয়া। তাই প্রতিদিন বিকেল হলেই হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতটুকু পারা যায় আকাশ দেখি। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলের পরিবেশে এখনো যথেষ্ট গ্রামের ছোঁয়া আছে তাই বিকেল থেকেই নানা ধরনের পাখি ডাকতে শুরু করে, তবে তার মধ্যে কাকের সংখ্যায় বেশি। আমি হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের পাশাপাশি হলের গাছগুলোকেও দেখি। কিছু স্থায়ী গাছের পাশাপাশি মৌসুমি অনেক গাছ লাগানো হয়। সেগুলো হলের পরিবেশটাই বদলে দেয় মৌসুম অনুযায়ী। আর বুকের মধ্যে থেকে একটা করে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে যায়।

আমাকে এখানেই কাটাতে হবে ভবিষ্যৎ জীবনের অনেকগুলো বছর। কুষ্টিয়া থাকতে আমার আব্বা-মা কখনই পড়াশোনার জন্য চাপাচাপি করে নাই। নিজের ইচ্ছেমতো পড়াশোনা করেছি এবং তার ফলাফলও পেয়েছি হাতেনাতে আর শেখাটাও হয়েছে অনেক পাকাপোক্তভাবে। কুষ্টিয়ার মতো মফস্বল শহর থেকে সেইবারই প্রথম ছয়জন বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল তার মধ্যে একজন ছিলাম আমি। ঢাকা শহরে কুষ্টিয়ার প্রকৃতি এবং বন্ধুদের পাশাপাশি সেই প্রথম আব্বা মাকে মিস করতে শুরু করলাম। আমি এর আগে ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি তাঁদের জন্য মনের মধ্যে এতটা ভালোবাসা জমা করে রেখেছিলাম। তখন মোবাইলের চল সবে শুরু হয়েছে অবশ্য আমার জন্য সেটা ছিল আকাশকুসুম কল্পনা আর আমাদের গ্রামে তখন পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটি গেলেও টেলিফোনের লাইন যায়নি। যোগাযোগের একমাত্র উপায় চিঠি। আমি প্রায় প্রতি মাসেই বাড়িতে একটা করে চিঠি লিখি। আব্বাও একেবারে নিয়ম করে প্রত্যেকটা চিঠির উত্তর দেন। আমার আর বন্ধু সাজ্জাদের সিট পড়েছিল একই হলে। আমি আর সাজ্জাদ তাই প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর সপ্তাহের শেষের দিনে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিই। কুষ্টিয়াতে দুই দিন ছুটি কাটিয়ে আবার হলে ফিরে আসি। মোটামুটি এভাবেই শুরু হলো আমাদের হল জীবন। আমি শুধু ভাবছিলাম এই স্বজনহীন পরিবেশে থাকব কীভাবে?

মেজবার ভাই তখন হাজির হলেন আমার লোকাল গার্ডিয়ানের ভূমিকায়। অবশ্য উনি এর আগেই নিজের বিছানা ছেড়ে দিয়ে আমার প্রাথমিক উদ্বেগ দূর করে দিয়েছিলেন। আমি সত্যিই অনেক ভাগ্যবান। জীবনটা যখনই কঠিন হতে গিয়েছে তখনই সৃষ্টিকর্তা কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে দেন আমাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। বুয়েটে ভর্তির প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর চোথা কিনতে হয়। নোটকে বুয়েটের ভাষায় চোথা বলা হয়। আগের বছরের নোট কিনতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। আমার রুমমেট তার এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে নোট কিনেছিল বাকিতে। তখন আমাদের সবারই হাতের অবস্থা বেশ খারাপ। বাড়ি থেকে আনা টাকা পয়সা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আমরা সবাই হন্যে হয়ে টিউশনি খুঁজে বেড়াচ্ছি। একদিন সন্ধ্যায় তৌহিদের সেই বড় ভাই ওকে শাসাতে শুরু করল চোথার টাকা পরিশোধ করার জন্য। আমি জানি তৌহিদের কাছে টাকা নেই। সেই বড় ভাইকে বসিয়ে রেখে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ম্যানেজ করে সেযাত্রা তৌহিদকে রক্ষা করা গেল। আমাকে কিন্তু চোথা কেনার ঝামেলা পোহাতে হলো না। মেজবার ভাই তার চোথাসহ বইগুলোও দিয়ে দিলেন। এ ছাড়াও সময়ে সময়ে পড়াশোনার খোঁজ নিতে থাকলেন। কুষ্টিয়া থাকতে আমার মা এই কাজটা করতেন। পড়াশোনা নিয়ে তেমন কিছুই বলতেন না শুধু দিনে অন্ততপক্ষে একটা বার খোঁজ নিতেন। আর সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। ঢাকায় আসার পর সেই অভাবটা পূরণ করলেন মেজবার ভাই। মেজবার ভাইয়ের জীবনের গল্প সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। আমি জীবনে অনেক জীবনযোদ্ধার গল্প শুনেছি কিন্তু মেজবার ভাইয়ের জীবনের গল্প একেবারে আলাদা। সেদিকে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।

সপরিবারে মোস্তফা ভাই। ছবি: সংগৃহীত
সপরিবারে মোস্তফা ভাই। ছবি: সংগৃহীত

নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছিলেন মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার পর আর বোর্ড পরীক্ষার আগেই। আমাদের এলাকায় অবশ্য এমন ঘটনা হরহামেশায় ঘটে। এরপর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার পাততাড়ি গুটিয়ে সংসারে মন দেয় কিন্তু মেজবার ভাইয়ের ক্ষেত্রে ঘটল উল্টো ঘটনা। উনি শুধু ভালোভাবে মাধ্যমিকই পাশ করলেন না বরং উচ্চমাধ্যমিকের জন্য ঢাকায় এসে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হলেন। অবশ্য পরে আবার কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ফিরে গেলেন। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হলেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে। উনি ছিলেন আমার এক ব্যাচ সিনিয়র। বুয়েটে ভর্তির পর তাকে সবাই জামাই বলে ডাকত। ৯৭ ব্যাচের জামাই বলে সবাই একনামে চিনে। উনি সংসার এবং বুয়েটের পড়াশোনা সামলেছেন এক সাথে। আমি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে এমন দ্বিতীয় উদাহরণ দেখি নাই যেখানে এত ছোট বয়সে সংসার শুরু করে পড়াশোনাটাকে এত দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছেন।

পুরো বুয়েট জীবনটা আমার জন্য অনেক সহজ হয়ে গেল মেজবার ভাইয়ের ছায়ায়। বছরের শুরুতে সবাই যখন চোথা খুঁজে বেড়ায় তখন আমার পড়ার টেবিলের নিচে অন্ততপক্ষে তিন সেট চোথা হাজির হয়ে যায়। মেজবার ভাই, ওনার রুমমেট মামুন ভাই, নজরুল ভাই, শাহিদ ভাই সবাই আমাকে তাঁদের পুরোনো চোথাগুলো দিয়ে দিতেন। বুয়েটে সিনিয়র জুনিয়রের মধ্যে এমনিতেই অনেক ভালো বোঝাপড়া ছিল একসময়। আর পিঠাপিঠি ব্যাচগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ছিল আরও গভীর। মেজবার ভাইয়ের অছিলায় পুরো ৯৭ ব্যাচের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। তাঁদের রুমে পিএল (প্রিপারেটরি লিভ) ফাইট দিতে আসতেন বখতিয়ার ভাই, পারভেজ ভাই, সুমন ভাই। সেই সুবাদে তাঁদের সঙ্গেও অনেক ভালো সম্পর্ক তৈরি হলো। বুয়েটের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ভাবছি চাকরিতে যোগ দেব কি দেব না। কারণ তখন টিউশনি থেকেই আমার আয় ২৩ হাজার টাকার ওপরে। মেজবার ভাই বললেন: শোন, টিউশনি পার্টটাইম জীবিকা হিসেবে ভালো কিন্তু পুরো জীবন টিউশনি করে চলতে পারবা না তাই চাকরি করতে হবে।

আমার জীবনের প্রথম চাকরি মেজবার ভাইয়ের দেওয়া। মেজবার ভাই তখন একটা সব কন্ট্রাক্টর ফার্মের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সবে এরিকসন বাংলাদেশ লিমিটেডে যোগ দিয়েছেন। আমাকে বললেন: তুমি সিভি নিয়ে অমুক অফিসে গিয়ে আমার নাম বলো তোমার চাকরি হয়ে যাবে। আমি সেই চাকরি দুদিনের বেশি করিনি। তখন কেবল বুয়েট থেকে পাশ করে বেরিয়েছি। বুয়েটের লোগো তখনো গায়ে লেগে আছে তাই অত খাটুনির চাকরি আমার পোষালো না। পরবর্তীতে বুঝেছি তুমি সেখানকার গ্র্যাজুয়েট হও না কেন কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলবে না। এরপরের চাকরি মেজবার ভাইয়ের রুমমেট এবং আমার আরও একজন অভিভাবক মামুন ভাইয়ের দেওয়া। একদিন মামুন ভাই ফোন দিয়ে বললেন: ওই মিঞা টিউশনি ছাড়ো, টিউশনি দিয়ে আপাতত জীবন চললেও পরে পস্তাতে হবে। তুমি সিভি নিয়ে অমুক অফিসে গিয়ে আমার নাম বলো তাহলেই হবে। আমি যথারীতি সিভি নিয়ে দেখা করলাম। চাকরিও হয়ে গেল। আমি শর্ত দিলাম যে আমি আমার টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে এই চাকরিটা করব। আমি সারা দিন টিউশনি শেষ করে রাত্রে গিয়ে তাঁদের বিল বা ড্রয়িংগুলো করে দিতাম। এরপর একসময় ড. এম এ রশীদ হলের পাশের রুমের বন্ধু রাসেল আর পোমেলের সহযোগিতায় সিমেন্স বাংলাদেশ লিমিটেড যোগদান করলাম এবং এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

এরপর জীবনের বহমানতায় একসময় অস্ট্রেলিয়া আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সিডিআর (কম্পিটেন্সি ডেমোন্সট্রেশন রিপোর্ট) লিখতে হবে। সেখানেও এগিয়ে আসলেন মেজবার ভাই এবং মামুন ভাই। দুজনের কাছ থেকেই একগাদা করে সিডিআর পেয়ে গেলাম। আর শেষে বন্ধু জামিলের সহযোগিতায় সিডিআর তৈরি করলাম। জীবনে কখনো কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হইনি কোনো প্রকার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য কিন্তু আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়ার আগে কোচিংয়ে ভর্তি হলাম আমি আর মামুন ভাই এক সাথে। আমার সবগুলোতেই নম্বর আসে সন্তোষজনক কিন্তু স্পিকিংয়ে আর আসে না। বারংবার কোচিংয়ে স্পিকিং টেস্ট দিয়ে সেটার উন্নতি করলাম এবং একেবারেই আমার নির্ধারিত স্কোর তুলতে সক্ষম হলাম। এই সময়টাতেও মামুন ভাই আমাকে সারাক্ষণ সাহস জুগিয়ে গেছে।

এরপর ভিসার আবেদনের টাকা জমা দিতে হবে অস্ট্রেলিয়ার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। তখন আবারও মেজবার ভাইয়ের শরণাপন্ন হলাম এবং যথারীতি সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। একসময় ভিসা হাতে পেলাম। অস্ট্রেলিয়া আসার পরিকল্পনা করছি। মেজবার ভাই বললেন: এসে পড়ো সমস্যা নেই। আর মেজবার ভাইয়ের গিন্নি রিনা ভাবি আমার গিন্নিকে বুঝিয়ে দিলেন কী কী নিয়ে আসতে হবে। এরপর এক শনিবার বিকেলে সিডনির কিংসফোর্ড এয়ারপোর্টে এসে নামলাম আমরা পুরো পরিবার। সেখানে নেমে আমরা মেজবার ভাইয়ের অপেক্ষায় আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি উপস্থিত হলেন। তারপর ওনার গাড়িতে করে আমরা ওনার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথে এম ৫ মোটরওয়ের টানেলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আমি বিস্ময় প্রকাশ করাতে উনি বললেন: পারবা তো এর মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাতে। সত্যি কথা বলতে আমি তখন মোটেও নিশ্চিত ছিলাম না। এখন বিভিন্ন ভ্রমণের সময় যতবারই টানেলটা পার হই ততবারই মেজবার ভাইয়ের সেই কথাটা মনে হয়। এরপর একটা সপ্তাহ ওনার বাসায় থাকলাম। বিদেশে আসার পর প্রথম বাসাটা খুঁজে পাওয়া অনেক ঝক্কির কাজ। কোনো রিয়েল এস্টেট কোম্পানিই বাসা দিতে চায় না কারণ তখন পূর্বের বাসা ভাড়ার কোনো রেকর্ড থাকে না। উনিই মিন্টোতে আমাদের প্রথম বাসাটা খুঁজে দিলেন গ্যারান্টার হয়ে। তারপর আর আমাদের পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

সপরিবারে মেজবার রহমান ভাই। ছবি: সংগৃহীত
সপরিবারে মেজবার রহমান ভাই। ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়া আসার পর সবকিছুই মোটামুটি রুটিন মাফিক চলতে থাকে। আপনি যদি একেবারেই আট কুঁড়ে না হন তাহলে আপনার জীবন মোটামুটি সহজ। টাকার ফ্লো টা রাখা দরকার কারণ পরিবার নিয়ে এসেছি তাই মামুন ভাই একটা কাজ খুঁজে দিলেন। আমি সারা দিন কাজ করি আর দিন শেষে চাকরির জন্য আবেদন করি। এরপর একসময় মোস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো উনিও বুয়েটে আমাদের হলেই থাকতেন। তখন হালকা পাতলা পরিচয় ছিল এখানে এসে সেটা পাকাপোক্ত হলো। মোস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর আমরা পুরোপুরি ফিরে গেলাম বুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলের জীবনযাত্রায়। সপ্তাতে পাঁচ দিন কাজ করি আর বাকি দুদিন মোস্তফা ভাইয়ের বাসায় তাস খেলি আর খাওয়া দাওয়া করি। মোস্তফা ভাইয়ের স্ত্রী তানজিনা ভাবি আমাদের এসব বাঁদরামি মেনে নেন অবলীলায়। নিজের সংসারের হাজারো ব্যস্ততার ভিড়েও আমাদের সময়ে সময়ে নাশতা বানিয়ে দিতেন।

মোস্তফা ভাইয়ের বুদ্ধিতে একটা চাকরিও জোগাড় করে ফেললাম। সত্যি কথা বলতে অস্ট্রেলিয়া আসার পর সবচেয়ে দরকারি এবং যুগোপযোগী সাহায্য এবং বুদ্ধিগুলো পেয়েছি মোস্তফা ভাই আর তানজু ভাবির কাছ থেকে। তাঁরা সব সময় একটাই কথা বলেন, দেখো ইয়াকুব আমাদের সময় বুদ্ধি দেওয়ার কেউ ছিল না। আমরা ঠেকে ঠেকে শিখেছি কিন্তু তোমাদের বেলায় অন্ততপক্ষে আমরা আছি তাই যেকোনো বিপদে সব সময় স্মরণ করো। আমি তখনো জানতাম যে গামট্রি নামক পুরোনো জিনিসপত্র বেচার অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ওয়েবসাইটে চাকরির বিজ্ঞাপনও থাকে বিশেষ করে যেকোনো লাইনের কাজ শুরু করার জন্য গামট্রির বিকল্প নেই। ছোটখাটো কোম্পানিগুলোর অত টাকা নেয় যে হিউম্যান রিসোর্সের মাধ্যমে বা কোনো কনসালটিং এজেন্সির নিয়োগ দেবে তাই তারা ছোট করে গামট্রিতে একটা বিজ্ঞাপন দেয় কাজের। আর তাদের লোক লাগবে বলেই বিজ্ঞাপন দেয় তাই আপনি যদি উপযুক্ত প্রার্থী হন কাজটা পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।

মোস্তফা ভাইয়ের কাছেই আরও জানলাম চাকরির জন্য শুধু আবেদন করে বসে থাকলেই চলবে না। আবেদন করেই সেই কোম্পানিকে ফোন দিয়ে নিজের আগ্রহের কথা জানাতে হবে। কারণ তারা সব সিভি খুলে দেখেন না শুধু যারা সিভি পাঠানোর পাশাপাশি ফোন দিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন সেই সিভিটা বের করে দেখেন এবং পছন্দ হলে তখনই ইন্টারভিউয়ে ডাকেন। এরপর ইন্টারভিউ কীভাবে ফেস করতে হবে সেই বুদ্ধিও মোস্তফা ভাই দিয়ে দিলেন। উনি বললেন, দেখো ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা না তাই আমাদের উচ্চারণ শুদ্ধ হবে না আর ওরাও সেটা জানে তোমাকে দেখাতে হবে যে তুমি কাজটা পারো আর সেটা করার মোক্ষম উপায় হচ্ছে ওদের আগে বাড়িয়ে বলা যে আমাকে একটা টেস্ট কাজ দেন। আমি যদি সেটা ভালোভাবে করতে পারি তাহলে আমাকে নিয়োগ দেবেন অন্যথায় না। এই বুদ্ধিটাতেই আমি আমার প্রথম লাইনের কাজটা পেয়েছিলাম তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

অস্ট্রেলিয়া আসার পর বাসা পাওয়া, কাজ পাওয়ার চেয়েও কঠিন কাজ হলো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া। বলা হয় অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট হয়তোবা একসময় পাওয়া যাবে কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া অত সহজ না। আমি ইতিমধ্যেই তিনবার ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় ফেল করে হতোদ্যম হয়ে গেছি। তখন মামুন ভাই বুদ্ধি দিলেন, শোন ড্রাইভিং টেস্টের তারিখ বড়দিনের ছুটির কাছাকাছি আগেই ফেলো তাহলে দেখবে পাশ করার সুযোগ অনেক বেশি কারণ ওই সময় ওরা ফুরফুরে মেজাজে থাকে এবং সামান্য ভুলগুলো দেখে না। ওনার বুদ্ধি মতো কাজ করে অবশেষে চার বারের বার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলাম। অস্ট্রেলিয়াতে যেহেতু বাংলাদেশের মতো রিকশা বা ভ্যান নেই তাই গাড়ি করেই সবখানে যেতে হয়। এতে একদিকে যেমন সময় বাঁচে অন্যদিকে বাঁচে শ্রম কিন্তু আমাদের তখনো গাড়ি কেনার মতো সামর্থ্য নেই। তখন আবারও এগিয়ে এল আমার বন্ধু জামিল। জামিল তখন গোল বার্ন সিটি কাউন্সিলে চাকরি করে। অফিস থেকে ওকে একটা গাড়ি দেওয়া হয়েছে তাই ওর গাড়িটার আর দরকার নেই। আমাকে বলল, মামা তুমি আমার গাড়িটা নিয়ে নাও আর পয়সা তোমার সুবিধামতো দিয়ো। এখন মুশকিল হলো আমি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলেও তখন পর্যন্ত একা একা আমার গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা নেই বা সাহস হয়নি। তখন আবার মামুন ভাই হাজির দৃশ্যপটে। আমরা দুজন বাসের টিকিট করে ক্যানবেরা গেলাম। সেখানে বন্ধু সুমনের বাসায় নাশতা সেরে জামিলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। জামিল কিছু কাজে গোলবার্ন থেকে ক্যানবেরা আসবে, ফেরার পথে আমাদের উঠিয়ে নেবে। এরপর জামিলের গোলবার্নের বাসা থেকে মিন্টোতে আমাদের বাসা পর্যন্ত গড়িয়ে চালিয়ে এনে দিলেন মামুন ভাই। সিডনিতে এসে এভাবেই আমাদের জীবনটা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে গিয়েছিল।

মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার সবচেয়ে বড় সার্থকতা হচ্ছে অন্য মানুষদের ভালোবাসা পাওয়া এবং তখনই কেবল মানুষের জীবন পূর্ণতা পায়। এর চেয়ে সুন্দর অনুভব আর কিছুতেই হয় না। সেদিক দিয়ে বিচার করলে আমি সত্যিই অনেক ভাগ্যবান। আমাদের পরিবারের বড় ছেলে হওয়াতে বড় ভাইদের শাসন বা আদর দুটোই খুব মিস করতাম বিশেষকরে ঢাকায় এবং অস্ট্রেলিয়া আসার পর কারণ আমিই আমাদের পরিবারের প্রথম ব্যক্তি যে এত দূর এসেছে। মেজবার ভাই, মামুন ভাই, মোস্তফা ভাই, জামিল আমার সেই অভাব কোনো দিনও বুঝতে দেয়নি। আমার কোনো বড় ভাই নেই বলে আমি এখন আর দুঃখ করি না। এই মানুষগুলোই আমার বাস্তব জীবনের বড় ভাই যদিও তাঁদের সঙ্গে আমার কোনো আত্মিক সম্পর্ক নেই কিন্তু আছে আত্মার সম্পর্ক। আমি বাইরের কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলি বলি তাঁরা হচ্ছেন আমার লোকাল গার্ডিয়ান বা স্থানীয় অভিভাবক। আর ভিনদেশি কারও কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে বলি তাঁরা আমার সিনিয়র ফ্রেন্ড। চলে যাওয়া বিশ্ব বন্ধু দিবস উপলক্ষে সিনিয়র, জুনিয়র এবং সমবয়সী সকল বন্ধুদের শুভেচ্ছা।