বন্ধুয়ার পিরিতে কত জ্বালা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আগামীকাল যা দেখতে চেয়েছিলাম, দীনবন্ধু তা আজকেই উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। আমি যাতে অমঙ্গল পোষণ করি, অবধারিত আগামীর মঙ্গল সেখানেই নিহিত থাকে। বুঝতে না পারা আড়াআড়ির জন্ম দিলেও বেঁচে আছি, থাকি। যিনি চাইলে এক্ষুনি সবকিছু ম্লান করে দিতে পারতেন, তিনি তা করেননি। পরম বন্ধুর রহমত আর দয়ার বেষ্টনে এভাবেই আগামীর স্বপ্ন দেখি, দেখতে হয়।

বাদলার হাওয়া বইছে। সন্ধ্যাতারাগুলো মিটিমিটি জ্বলছে। উদাস মনের উন্মাদনা নিরলের বন্ধুকে চাইছে...। বন্ধু আমায় ভালোবাসে, নির্জনেও পাশে থাকে, এ আনন্দ মনে জাগলে সুখের গহিনে ডুবে থাকি আপনার তরে। আপনার আড়াল থেকে ভেসে আসা মোহিতের শব্দ বলছে, ‘কী লাভ হইল পিরিত কইরা যে প্রেমের নাই সীমানা’। অন্ধকার যে কেন্দ্রবিন্ধুর নিচে সীমাহীন প্রণয়ের খেলায় মেতে ওঠে, পিরিতের জ্বালা বুকে ধরে সেই আকাশকে জিজ্ঞেস করলাম, আকাশ তুমি বলে দাও না, প্রিয়তমার সঙ্গে তোমার কিসের মিল? সে কোন রং পছন্দ করে? তার গভীর সম্পর্কের অন্তরায় তোমার আদান-প্রদান কোথায়?

আকাশের প্রাণপণ চেষ্টার সফলতাই যেন হৃদয় আকাশকে ছুঁয়ে দিয়ে বলল, আমি জন্মান্তরের রং ধারণ করে আছি। আমাকে যে রঙেই সাজাতে চাও কোনো আপত্তি নেই। তোমার প্রিয়তমা কোনো রং পছন্দ করে কিংবা করে না, আমি তা বলার ক্ষমতা রাখি না। তুমি যাকে আজ প্রিয়তমা বলে দাবি করেছ, সেও যদি কাল এসে একইভাবে কারও পছন্দের রং জানতে চায়, আমি কী পুনঃপুন আলাদা রং খুঁজে বেড়াব? তার চেয়ে ভালো আমি সব সময় উদার। প্রয়োজনে সব রঙেই সাজি, সাজাই। কাউকেই নির্ধারণ করে বেছে নিই না, নিতে চাই না। আমি রোদ হয়ে জ্বলি, বৃষ্টি হয়ে ভেজাই, কুয়াশার বরফ আর অগ্নিময় লালার তীব্র আঘাত সয়েও বন্ধুকে আমার ছায়াতলে রাখি। রাখব চিরকাল...।

আকাশ চিরন্তন জীবনের মতোই প্রতিনিয়ত আঁকে এবং মোছে। প্রিয়তম বা প্রিয়তমার আপত্তি থাকতে পারে বলে সে কাউকে কোনো নির্দিষ্ট রঙে সাজাতে চায়নি। আকাশ জানে, রসিক বন্ধু যথার্থ রঙিন। আমার চেয়েও স্বাধীন এবং শ্রেষ্ঠ। কখনো–বা ভবঘুরে। রসিক বন্ধু আকাশের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তে যতটুকু সুখ নেয়, বেরসিক তা সারা জীবনেও নিতে পারেনি, নেওয়ার কৌশলটাই বেরসিকের জানা নেই।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আকাশ সকালের বিত্তবান আর ক্ষমতাধরকে বিকেলের কয়েদি হতে দেখে বহুবার তাজ্জব হয়েছে। উপন্যাসের নায়কও বলেছিলেন, ভালো না বাসা কখনো ভালোবাসার বড় কারণ হয়ে ওঠে বলেই জিয়ররা কোনো দিন কারও পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। পিরিত করা এ যেন এক প্রাণে মরা, বন্ধুর এ স্বাধীনতাকে জিয়র নিজের সম্বল হিসেবে নিতে পারেনি।

আকাশও আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিল, পিরিতের ছলে সে বন্ধুর বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, দাঁড়াতে চায়নি। আকাশ উদারনীতিতে বিশ্বস্ত, অভ্যস্ত এবং অব্যাহত। সে বন্ধুকে সীমাহীন পিরিতে জড়িয়ে নিজে পর হয়ে গেছে। বন্ধুয়ার পিরিতে জ্বলেপুড়েও সে বন্ধুর দায় নেয়নি, নিতে চায়নি। অথচ বন্ধুর জন্যই তার জন্ম। আকাশ অতি ভালোবাসার দায়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেও বেজায় খুশি। বন্ধুয়ার পিরিতের জ্বালা আকাশকেই বুঝতে দেওয়া উচিত। যার আছে লেনাদেনা...।

আকাশের কথা শেষ না হতেই আয়েশি শব্দ কানে এসে লাগল। নিগূঢ় অন্ধকার থেকে কে যেন বলল, ‘আমি জানিগো বন্ধুয়ার পিরিতে কত জ্বালা।’ সে কে? কোথায় থাকে? বন্ধুয়ার পিরিতের জ্বালা সে কী জানে? বিশাল আকাশ কিছুই জানার দায় নেয়নি। সে কেন এ দায় নিল? বন্ধুয়ার সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক? বন্ধুর পিরিতের সব জ্বালা বোঝার দাবি সে কেন করল? সে কি আমার মনের জ্বালাও জানে, বোঝে? তাকে আরও কাছে আসতে দাও। চিরদুঃখী এ মনে বন্ধুর জন্য কিসের জ্বালা বুঝিয়ে দিয়ে যাক।

গহিনের বেদনা বলেছে, ‘পিরিত সহজ হতে অতি সহজ, তবু তারে সহজ জ্ঞানে কেউ পায় না। পিরিতি সকলে জানে না সোনা বন্ধুরে, পিরিতি সকলে জানে না।’ অদৃশ্য বেদনা বলেছে, ‘দক্ষিণ হাওয়ারে, তরে চোখে নাহি দেখা যায়। দ্বিগুণ জ্বালা বাড়ে আমার লাগলে হাওয়া গায়...।’

দেখা যায় না। দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে এবং জ্বালায়। আমি এ জ্বালাকেই বন্ধুর পিরিতের জ্বালায় চিহ্নিত করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম...। সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। রাগ করলেও দেখা দেয় না। এ কথা আগে জানলে তার প্রেম থেকে দূরে থাকতাম। তাকে পাওয়ার উপায় জানা নেই। কেমনে পাই? কোথায় গেলে পাই? ভেতরে–বাইরে নিজেকে যতই গোছগাছ রাখতে চাই, তার পিরিতের জ্বালা এসে সবকিছুই এলোমেলো করে দেয়। মায়া লাগানো আর পিরিতি শেখানো বন্ধু আমারে কান্দাইয়া কী সুখ পায়? বিষণ্নতাগুলো জড়ো হয়ে বলেছিল, আমারে দিয়া বন্ধুর পিরিতি কিছুই হয়নি। আমাকে সবাই ভুলে যায়, ছেড়ে চলে যায়। এ যাওয়ার শেষ নেই...। আমিও একদিন প্রাণবন্ধুর লাগি সবাইকে ভুলে যাব, ছেড়ে চলে যাব।

আমি মুখোমুখি দাঁড়াতে শিখেছি, দাঁড়াই। বিসর্জনেই সুখ নিই, নিতে চাই। প্রয়োজনে মৃত্যু দিয়েই বন্ধুর সুখ লিখি, লিখে যাই। বন্ধু অফুরন্ত সুখে থাকলেও হঠাৎ আমার কথা স্মরণ করে। বেদনার রোষানলে পড়ে আমায় খুঁজে, খুঁজে বেড়ায়...। আমি রহস্য কারণেই অচেনা থাকি, থাকতে চাই। আমার অত সুখের ভাবনার খবর এ জগতের কেউ রাখে না, রাখতে পারে না। আমি আত্মার আলিঙ্গনে ডাকি। অর্পিত সুখ-দুঃখের পানে তাকাই। চোখ বন্ধ করে তাকাই। তাকিয়ে দেখি, না পাওয়ার যাতনা আর পাওয়ার সান্ত্বনা, দুটোতেই বন্ধুর সঙ্গে কারও তুলনা নেই, তুলনা হয় না। অতুলনীয় অর্থেই বলি, যে মুখের হাসি দেখতে বেদনার সবটুকুই নিজের করেছিলাম, সেই চোখের দৃষ্টিতেই আমার কান্না দেখে গেল হাসিতে হাসিতে।

বিরহিণীকে বলেছিলাম, তোমাকে হৃদয় আসনে বসিয়ে রানির মতো দেখি, দেখতে চাই…। যদিও আমি একাকী অনন্তের পথে চলি, পিরিতের টানে বন্ধুর কাছে বারবার ফিরে আসি। বন্ধুকে ছাড়া আমার সমুদ্র পার হওয়ার বাসনা একেবারে বৃথা। আমায় ছাড়া বন্ধুরও কূল নেই, কূল হয় না। যদিও বা হয়, সেই কূল বিষাদে পরিপূর্ণ, অভিশপ্ত এবং দণ্ডনীয়। দণ্ড কাম্য নয়, তবে রায় হয়ে গেলে এর জ্বালা বন্ধুর সঙ্গে আমাকেও পোহাতে হয়। যে বন্ধুকে পাওয়ার আশায় এ মনে সুখের চেয়েও সুখ লাগে, সেই বন্ধু আমায় কোন পরানে দূরে রাখে। তার প্রকৃত সুন্দর জীবনের কূলে আমি ছিলাম, আছি এবং থাকব...।

বিরহিণী বুকে হাত রেখে বলতে পারেনি, অনন্ত পথের পাথেয় হয়ে এ জীবনের পাশে কখনো ছিল না। তবুও সে কেন জানি রাজ্য চেয়ে বসে আছে! আমার মাটির ঘর তার চোখে পড়েনি। এত সব রাজপ্রাসাদের আড়ালে সে মাটির ঘরের রানি হতে চায়নি। জুরিদারের রায়ে তালগাছ বিবাদীর পক্ষে চলে গেলেও আকস্মিক ভঙ্গিতে বলেছে, বিচার সবই মানি, তালগাছ আমার! কথা শুনেই আয়ুপ্রদ হৃদয়কে উপলেপ দিয়ে বলল, রাজ্য লিখে দিলে আমি আর রাজা নই। বিরহিণী যদি একবারও বলত, আমাকে রানির মতো করে রাখতে প্রয়োজনে তুমি পুরো পৃথিবী দখল করে নাও। তবেই না তার জ্বালা এ মনে দ্বিগুণ হয়ে জ্বলত।

বন্ধুয়ার পিরিতের জ্বালায় সবকিছুই ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এমনিতেই আমার মাটির ঘর, তার ওপরে পিরিতের জ্বালা। জ্বালার সঙ্গে আছে চুরি। সবকিছুই চুরি হয়ে যাচ্ছে...। তবুও যন্ত্রণার শেষ হয়নি। জীবনান্তের আগে বন্ধুকে পেলে অবশ্যই জিজ্ঞাসিতাম, আমারে এত কেন জ্বালায়? জ্বালা এ মনকে যতই বিদীর্ণ করুক, আমি বেঁচে থাকতে, পরান যাওয়ার আগে, বন্ধুকেই চাই। রুদ্র নামের স্বামী মেঘের আড়ালে অবিরাম লুকোচুরি খেলে, খেলবে...। যে অভিমান ক্ষীণ হলেও বন্ধুকে আমায় ছাড়া করে, অতীতেও করেছিল, অভিমানী সেই ক্ষমতার জয় হোক। বন্ধুর অপার অনলে জ্বালাইয়া–পোড়াইয়া আবারও বুঝাইয়া দিক, পিরিতির নাম বেদনা।

সব ব্যথা নীরবেই সয়ে যাব...। চাই না রাজ্য, চাই না বিরহিণীকে। বিরহিণীরও বোঝার দরকার আছে। না পাওয়ার বেদনা নিয়ে বিদায় হতে গেলেই সে বুঝবে, রাজা ছাড়া রাজ্য তাকে কী দেয়, কতটুকু দেয়। বন্ধুয়ার পিরিতের জ্বালা থেকে তাকে অনন্তকালই শিখতে হবে। আমিও জানি, জ্বালা শেষে কোনো এক নিশি কিংবা ভোরের আলো সুখের বার্তা নিয়ে আসবে। এসে যদি দেখে আমি নেই, খুঁজে পাওয়ার দায় আমাকেই নিতে হবে।
আমি মুক্তিতে বিশ্বাসী। তারা দেখার সাধ মিটে গেলেই দৃষ্টিতে চিড় ধরবে, রাতের আকাশ হবে আরও মুক্ত। আমি বিরহিণীকে আকাশের ন্যায় মুক্তি দিয়ে প্রাণ বন্ধুর তরেও মুক্তির আশীর্বাদ করে গেলাম। জ্বালাও যেন তাকে মুক্তি দেয়...।