বাংলিশ

প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি, তা হচ্ছে ছেলেমেয়েদের ভালো বাংলা বলতে শেখানো! তিন বছর পর্যন্ত তারা খাঁটি বাঙালি ছিল। আমার ছেলে তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীর পুরুষ’ কবিতাটি অর্ধেক আবৃত্তি করতে পারত। গাড়ি নিয়ে খেলার সময় নজরুলসংগীত ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়’ গুনগুন করত!
নার্সারি শুরু করার পর প্রথম দিনই শিক্ষকের অভিযোগ—    
- তোমার ছেলে কথা শোনে না!
আমি বললাম,
- ব্যাপারটা তা নয়। ও ইংলিশ ভালো বুঝতে পারে না। আমরা বাসায় বাংলা বেশি বলি, ইংলিশ কম। তাই হয় তো!
জাঁদরেল মিস দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন,
- ওকে ইংলিশ বলতে আর বুঝতে হবে!
কী যন্ত্রণা!
কী আর করা, বাসায় ইংলিশ শেখানো শুরু করলাম।
টেলিটাবি, টুইনি আর বব দ্য বিল্ডার হলো ছেলের ইংলিশের গুরু!
কিছুদিন পর আবার কমপ্লেইন!
- তোমার ছেলে ইনস্ট্রাকশন শোনে না!

আমি বললাম,
- কেন, এখন তো কিছু ইংলিশ সে বলতে আর বুঝতে পারে!
উনি ভুরু কুঁচকে বললেন,
- তাহলে তো আরও খারাপ। সে আমার কথা ইচ্ছা করে শোনে না।
আমি বললাম,
- ম্যাম, আমার ছেলের অপরাধ?
উনি বললেন, ক্লাসের বাচ্চাদের বাড়ি আঁকতে বলেছিলাম। ছাদ হবে ব্রাউন কালারের। তোমার ছেলের বাড়ির ছাদ সবুজ!
আমি বললাম,
- ওর স্বপ্নের বাড়ির রং হয়তোবা সবুজ!
উনি খুবই বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে বললেন,
- আমি যা বলব ক্লাসে, তা-ই ওকে শুনতে হবে!
নতুন মা, নতুন অভিজ্ঞতা। তাই ভাবলাম শিক্ষক যা বলেন, তা-ই বোধ হয় ঠিক!
ছেলেকে বললাম,
- এখন থেকে মিস যে রং দিতে বলবেন, তা-ই দেবেন। নিজের মনমতো নয়।
পরের সপ্তাহে আবার জরুরি তলব!

উফ্‌, আবার কী করল আমার ছেলে?
শিক্ষক কঠিন ইংলিশে বললেন,
- your son has caught red handed with some other boys while destroying school property.’
‘Caught red handed’ কথাটা দেশে ছোটবেলায় ট্রান্সলেশন করার সময় পড়েছিলাম
- ‘পুলিশ চোরকে হাতেনাতে পাকড়াও করিল’!
আমার চার বছরের ছেলে কী অপরাধ করে ‘red hand’-এ ধরা পড়ল, কিছুতেই বুঝতে পারলাম না! ভয়ে আর চিন্তায় ঠান্ডা হাত পা নিয়ে আসামির কাঠগড়াতে দাঁড়ালাম!
পঞ্চাশোর্ধ্ব বিরক্ত মুখে শিক্ষক যা বললেন, তা হচ্ছে, আমার ছেলে আরও দু-একজন শাগরেদ নিয়ে নার্সারির বাগানে লাগানো পেঁয়াজ উঠিয়ে ফেলেছে। এ ধরনের অপরাধ গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেন ছেলেকে বোঝাই!
কিন্তু ‘পেঁয়াজ’ কী করে ‘school property’ হলো, আমি নিজেই তা বুঝতে পারলাম না!
যা-ই হোক, বাসায় গিয়ে খুব বকাবকি করে ছেলেকে বললাম,
- কেন তুমি পেঁয়াজ উঠিয়ে ফেলেছ? এত কিছু খেলা থাকতে এটা কেন করতে গেলে?
মিস কত রাগ করেছে তুমি জানো?
উত্তরে সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

- মিস সায়েন্স ক্লাসে তো বলেছে পেঁয়াজ একটা বাল্ব। আমি দেখতে চাইছিলাম মাটির নিচে কীভাবে পেঁয়াজে আলো জ্বলে!
শুনে আমি হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম না।
প্যারেন্টস ইভিনিংয়ে ব্যাপারটা উল্লেখ করতেই মিস ভুরু কুঁচকে বললেন,
- He is very intelligent but still he needs to abide by the rules!
কারে কী বোঝাই!
ক্লাসের অন্য সব বাচ্চার মায়েরা আমাকে বেশ ভালোভাবে চিনে গেল। এই সেই মা, যার ছেলে প্রতিদিন আজব কাণ্ডকারখানা করে বেড়ায়। আমার প্রতিবেশী ভাবির মেয়ে একই ক্লাসে পড়ে। আমরা একসঙ্গেই যেতাম ওদের স্কুল থেকে আনতে। ভাবি আমার থেকে বেশ লম্বা। আমি জ্যাকেটে মুখ ঢেকে ওনার পেছনে লুকানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মিস ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করতেন আর অদ্ভুত সব অভিযোগ করতেন!
একদিন স্কুল থেকে এসে সে সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। বললাম,
- কাপড় চেঞ্জ করে খেতে আসো।
সে বলল,
- কিছু খাব না!
আমি বললাম,
- কেন বাবা? শরীর খারাপ লাগছে?
ছেলে বলল,
- না মা! I am in love!

আমি বসে পড়লাম! চার বছরের ছেলে প্রেমে পড়ে গেছে! কী ভয়ংকর কথা! ও এসব কেমন করে শিখল?
আমি হাসি চেপে বললাম, মেয়েটা কে?
সে বলল, it’s a secret!
আমার খুব জানতে ইচ্ছা হলো চার বছর বয়সে প্রেমে পড়লে কেমন লাগে? অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পর বলল, সবাইকে ঘুষি মারতে ইচ্ছা করে!
সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র প্রেম!
সারা দিন ধরে অনেক চেষ্টার পর জানা গেল মেয়েটির পরিচয়। সে আমার খুব কাছের বন্ধুর মেয়ে! পরির মতো সুন্দর আর মিষ্টি! রোজ সকালে ওরা একসঙ্গে স্কুলে যায়, একই ক্লাসে পড়ে।
শিশুপ্রেম!
খুবই চিন্তার বিষয়!
কী করে ব্যাপারটা ওর মাথা থেকে বের করব ভাবতে লাগলাম। পরদিন স্কুল থেকে আসার পর বললাম,
- বাবা, সব বন্ধুকেই আমরা ভালোবাসি। কাউকে একটু বেশি, কাউকে কম। যাকে বেশি ভালোবাসি, সে হচ্ছে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’!
This is called ‘friendship’, not ‘love’!
মনে হয় বোঝাতে একটু দেরি হয়ে গেল। ছেলে ভুরু কুঁচকে বলল,
- I am not friend with her anymore. We had a fight!
আমি বললাম, কেন ফাইট করলে?
সে বলল,
- ও আমাকে ওর শার্পনার দেয়নি।
I don’t like her anymore!

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রেমকাহিনি!
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম!
সবকিছু নিয়ে আমার ছেলের এক্সপেরিমেন্ট করতে খুব ভালো লাগে। ডিপ ফ্রিজের ভেতর মুরগি কিংবা মাছের সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট গাড়ি, প্লেন আর লেগোর পিস পাওয়া খুব স্বাভাবিক হয়ে গেল আমার কাছে।
তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের খেলা হলো বড় তেলের বোতলের ভেতর ওর গেঞ্জি ঢোকানো! সেসব বোতল থেকে বের করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। হয় বোতল কাটতে হতো, নয়তো গেঞ্জিসহ বোতল ফেলে দিতে হতো!
একবার সে নাকে ঘড়ির ছোট ব্যাটারি ঢুকিয়ে ফেলল। ওটা আটকে গেল তার নাকের একপাশে। পরে প্রায় এক ঘণ্টা সার্জারি করে সেটা বের করা হলো। সে এক বিরাট ইতিহাস!
সিনিয়র বয়স্ক ডাক্তার ব্যাটারি বের করে একটা বোতলে ভরে হাসিমুখে বললেন, তার দীর্ঘ ‘professional life’-এ এ রকম কেস খুব কম দেখেছেন।

আমার মা মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, তোর ছেলের নাক-কানের সব ছিদ্র বন্ধ করে দে! বিচ্ছুটা আমার মেয়েটাকে জ্বালিয়ে খেল!
যখন কাজে যেতাম, আমার বন্ধুর কাছে ওকে রেখে যেতাম। আমার বন্ধুরও দুই মেয়ে। বড়জন আমার ছেলের বয়সী, ছোটজনের দু-তিন বছর বয়স তখন! ওই বাসায় খেলা করে, টিভি দেখে ওর বেশ ভালোই সময় কাটত!
একদিন বাসায় দেখি সে সিবিবিসি চ্যানেলে একটা টিনএজারদের সিরিজ দেখছে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
- তোমাকে না বলেছি বড়দের প্রোগ্রাম দেখবে না?
সে রেগে উত্তর দিল,
- আন্টির বাসায় ‘ছোটলোকেরা’ তো দেখে। আন্টি তো ‘বড়লোক’, কিন্তু তোমার মতো বকা দেয় না!
আমি ছোটলোক আর বড়লোক ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম! তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
- বাবা, ছোটলোক আর বড়লোক না!
ছোট মানুষ আর বড় মানুষ!
হায়রে বাংলা ভাষা!

আমার ছেলে-মেয়ের বয়সের ব্যবধান সাত বছর! তাতে কী! মারামারিতে কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। একদিন মারামারির পর যথারীতি মেয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করল। আমি রেগে বড়টাকে বললাম,
- নিজের ছোট বোনকে মারতে হয়?
ছোটটা আরও জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
- I am not Vaiya’s skeleton! no no!
আরে বোন মানে যে হাড্ডি না, বোন...sister!
কে বোঝাবে এদের!
ছেলেকে বললাম, বাসায় বেশি করে বাংলায় কথা বলবে, তাহলে বাংলা আরও সহজ হবে তোমার কাছে। সে চেষ্টা করা শুরু করল।
যেকোনো কিছু যদি একবারের বেশি জিজ্ঞাসা করি, সে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘ভুলে যাও! ভুলে যাও!’
প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝলাম, ‘forget it’!
মেয়েটা কথায় কথায় অভিমান করে কাঁদতে শুরু করলে যখন থামাতে যাই, সে বড় ভাই হিসেবে মাথা ঝাঁকিয়ে আমাকে উপদেশ দেয়,
‘ওকে একা ছেড়ে দাও। সে আবার তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।’
মানে, ‘leave her alone! she will be ok soon!’
আমার বাসার মোবাইল-ল্যাপটপ রোজ ‘মরে যায়’! আবার চার্জ দিলে ‘বেঁচে যায়’!

মার্চ-এপ্রিলের লকডাউনের সময় ভাবলাম, এদের দুজনের বাংলার যা অবস্থা, এই সময়টাকে কাজে লাগালে কেমন হয়! ওদের বাংলা পড়তে আর লিখতে শিখাই! মহা উৎসাহের সঙ্গে দুজনই দুই সপ্তাহের মধ্যে যদিও খুব ধীরে, বাংলা পড়তে আর সহজ বাক্য লিখতে শিখে গেল। যদিও ‘ত’ আর ‘ট’-এর মাঝে পার্থক্য বোঝাতে আমার ঘাম বের হয়ে গেল।
ওদের বললাম,
- তোমরা দুজন সুন্দর দুটি বাংলা বাক্য লেখো! দেখি কেমন শিখলে!
আমার মেয়ে লিখল,
‘বাবা, আমি তমাকে ওনেক আডর করি!’
হায়রে কপাল!
বাংলা শেখালাম আমি!
‘আডর’ করে বাবাকে!
বাবাও সুযোগ পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
- সারা দিন বকাবকি করলে ওরা তোমাকে কেন পছন্দ করবে?
তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে ছেলের খাতা দেখলাম।
সে লিখেছে,
‘আমার দৃষ্টি খুব খারাপ।’
আমি রেগে বললাম, এটা কোনো ধরনের কথা?
ছেলে বলল,
- আমার চশমার একটা গ্লাস ‘broken’! তুমি এই লেখা দেখে যেন আরেকটা কিনে দাও।
এই লকডাউনে চশমা অর্ডার করা চাট্টিখানি কথা! বদ ছেলের এখনই চশমা ভাঙতে হলো?
বাংলা শেখানোর পাশাপাশি চেষ্টা করলাম খাঁটি বাংলা কিছু খাবার খাওয়ানো শেখাতে।

একদিন লাউ, মিষ্টিকুমড়াসহ আরও বাংলাদেশি সবজি দিয়ে মজা করে ‘লাবড়া’ রান্না করতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেল।
মেয়ে এসে বলল,
- মা, আমার ‘ভীষন্ড’ ক্ষুধা লেগেছে।
প্রচণ্ড আর ভীষণ মিলে নতুন শব্দ ‘ভীষন্ড’!
রান্না থামিয়ে রাগী গলায় বললাম,
- প্রচণ্ড ক্ষুধা, নাহলে ভীষণ ক্ষুধা, ‘ভীষন্ড’ নয়।
মেয়ের বাবা খাবার টেবিলে বসে মিনমিন করে বলল,
- সব সময় বাচ্চাদের বাংলা কথায় ভুল ধরো। ওরা তোমার কাছে শিখতে চাইবে না।
একটু থেমে বলল,
- তুমি আমার কথারও ভুল ধরো।
এসব ঠিক না।

অনেক কিছু বলতে পারতাম! কিন্তু বললাম না। আসলেই অনেক বেলা হয়ে গেছে আজকে।
ওরা ক্ষুধার্ত।
টেবিলে লাবড়ার বাটি রাখার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে নাক কুঁচকে বলল,
- What is this orange thing?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই ছেলে বলে উঠল,
- Some unidentifiable floating objects mixed with ‘daal’!
ও খোদা!
যিনি লাবড়া প্রথম বানিয়েছিলেন, এই বিবরণ শুনলে আর দ্বিতীয়বার বানাতেন না!
মেয়ে যথারীতি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
- আমি খাব না।
ছেলেও বলল,
- আমিও চাই না।
ক্লান্ত আমি রেগে চিৎকার দিয়ে বললাম,
- খাবি না মানে?
ওরা দুজন একসঙ্গে হাসিমুখে বলল,
- ‘টোর বাপ খাবে!’