বাইসাইকেল দুর্ঘটনার কিছু স্মৃতি

ছবি: সংগৃহীত

এক্কেবারে ছোট আমি। হাঁটা শিখছি কি শিখেছি। নিয়ন্ত্রণহীন ধপাস ধপাস করে পা ফেলা। পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চলে গেছি উঠানে রাখা একটা বাইসাইকেলের নিকট। মামা সবেমাত্র এসেছেন বাইসাইকেলের পেছনে মাথা ভাঙা গাছের একটা কাঁঠাল বেঁধে। সবাই কাঁঠাল নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি দলছুট হয়ে সাইকেলের সঙ্গী।
বাইসাইকেলের সঙ্গে খেলা করতে করতে সাইকেলটি আমার গায়ের ওপর পড়েছে। ব্যথা পেয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিয়েছি আমি। সাইকেলের পেছনের চাকা ঘুরছে। আমি তার নিচে। আমার একক শক্তি এখনো এতটুকু হয়নি যে চাকার নিচ থেকে একা একা বের হয়ে আসব। আমার কান্না শুনে সবাই দৌড়ে আমাকে উদ্ধার করল।

হ্যাঁ, এটা আমার জীবনের প্রথম সাইকেল দুর্ঘটনা। সবার জীবনেই হয়তো বাইসাইকেল দুর্ঘটনা আছে। কারও হয়তো মনে আছে, কারও হয়তোবা মনে নেই। আমার সাইকেল দুর্ঘটনার গল্প পড়ে হয়তো অনেকের আবার নতুন করে মনে হবে। আর সেই দুর্ঘটনা নিয়ে পাশে থাকা মানুষের সঙ্গে আলোচনা জমতে পারে।

ছবি: এএফপি

তখন প্রাইমারির ছাত্র। মাঝে মাঝে স্কুলে যেতাম আব্বার বাইসাইকেলে চড়ে। তো একদিন স্কুল থেকে ফিরছি। আব্বা চালাচ্ছেন, আমি সাইকেলের পেছনে বসে আছি। আমাদের গ্রামে প্রধান রাস্তাসংলগ্ন এক‌টি স্কুল আছে। সারা বছরই রাস্তার ওপর একটা ড্রেন কাটা থাকত পানিনিষ্কাশন করার জন্য। যখন সাইকেলটি ওই ড্রেনের ওপর দিয়ে যায় তখন সাইকেল একটা ঝাঁকুনি খেল। ঝাঁকুনি লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান পা চাকার ভেতরে চলে যায় এবং ঘ্র্যাং একটা শব্দ করে উঠল। তার মানে স্পোকের মধ্যে একটা পা চলে গেছে। পায়ের গোড়ালি কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। আব্বা সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেন আমাকে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বাসায় পৌঁছালাম।

একবার এক বড় ভাই পাখি মারতে যাচ্ছেন এয়ারগান নিয়ে। আমাকে এই খবর দিল চেন্টু। তখন বয়স হবে ১০ কি ১২। বাড়িতে সাইকেল ছিল। পাখি মারা দেখতে যাব, আনন্দই ছিল আলাদা। সাইকেল নিয়ে ছুটছি, ফুল গতিতে চালাচ্ছি। একটা সময় ডান দিক থেকে একটা মোরগ কক কক করতে করতে উড়ে সামনের চাকার ভেতরে চলে গেল। সাইকেল অজান্তে সামনের চাকা ব্রেক হয়ে গেল। মোরগের গলা কেটে দেহ থেকে আলাদা হয়ে ছটফট করছে। আর আমি ছুটে পড়লাম তরমুজের মতো।
আমার দোষ ছিল, নাকি মোরগের দোষ ছিল জানি না। তবে মোরগের মালিকের দাবির কারণে শান্তিপ্রিয়ভাবে জরিমানা দিয়েছিলাম।

প্রাইমারির ছাত্র। মাঝে মাঝে সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হতো। স্কুলে যেতে একটা বাগান পার হতে হতো। বোধ হয় এখন সেই বাগান আর নেই। বড় বাগান, অনেক এলাকাজুড়ে, ঘন গাছ, সূর্যের আলো বাগানের ভেতরে প্রবেশ করা কঠিন ছিল, সব সময় অন্ধকার অন্ধকার ভাব, নাম ছিল নারাণ শাহ-র বাগান। সেই বাগানের পাশ দিয়ে ছিল মাটির রাস্তা। বাগানের শুরুতেই দেখা যেত একটা বড় বয়স্ক বটগাছ।
বটগাছ অতিক্রম করে কিছুদূর এলে রাস্তার একটা জায়গা ছিল খুব উঁচু। আমি যখন হেঁটে স্কুলে যেতাম তখন একা যেতে পারতাম না ভয়ে। কেউ একজন না আসা পর্যন্ত বাগানের আগে কারোর জন্য অপেক্ষা করতাম। আর সাইকেলে গেলে ওই উঁচু জায়গাটা পার হতে পারতাম না সাইকেলের প্যাডেল মেরে। তখন সে পরিমাণ শক্তি আমার ছিল না।

যান্ত্রিকতার যুগে গ্রামীণ মানুষের কাছে বাইসাইকেল এখন গুরুত্বপূর্ণ বাহন। ছবিটি সম্প্রতি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কাশিমপুর গ্রাম থেকে তোলা
ছবি: মাসুদার রহমান

একদিন চিন্তা করলাম আজ সকালে দুটো সেদ্ধ ডিম খেয়েছি, মুরগির মাংস দিয়ে গরম ভাত খেয়ে এসেছি, গায়ে–পায়ে নিশ্চয়ই শক্তি আছে। সেই চিন্তা করে শক্তি খাটিয়ে সাইকেলে প্যাডেল মেরে উঠতে গেছি ওপরে। উঁচুর শেষ পর্যায়ে এসে সাইকেল দাঁড়িয়ে গেল। দুই তিন সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর সাইকেলসহ আমি কাত হয়ে ডান দিকে পড়ে গেলাম।

পড়েছি তো পড়েছি, তাতে কী হয়েছে! কিন্তু পড়তে পড়তে পড়েছি এক দুধ চাচার গায়ের ওপর। যার হাতে ছিল দুধের কাড়ে বা পাত্র, যাচ্ছে বাজারে বিক্রি করতে। দুধের পাত্র ভেঙে দুধ শেষ, আমার জামাকাপড় ভিজে গেল। দুধ চাচা রেগে তো মেলেটারি, হাতে থাকা দুধের পাত্রের ছিঁকে দ্বারা আমাকে বাঁধবে, এমনই ভাব। আমি ভয়ে তো প্যাঁচা হয়ে গেছি, শরীর ঢুকে গেছে শরীরের মধ্যে।

তখন আকাশে মেঘ, জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার আরও বেশি হয়েছে। শেষমেশ আমি সাইকেল, বই–খাতা ফেলে রেখে দৌড়ে দুধ চাচার হাত থেকে রক্ষা পাই। কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে গেলাম।

পরে জানতে পারলাম, ওই দুধ চাচা আমার সাইকেল ও খাতাপত্র নিয়ে স্কুলে হেডমাস্টারের নিকট দুধ ও পাত্রের ক্ষতিপূরণ চেয়ে নালিশ দিয়ে এসেছে। তা–ও আমি যে স্কুলের ছাত্র ছিলাম সেখানে না গিয়ে উনি ভুলভাবে অন্য স্কুলে নালিশ দিয়েছে। কারণ, দুধ চাচার ধারণা ছিল আমি নালিশ করা স্কুলের ছাত্র।

বাইসাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয় থেকে ফিরছে শিক্ষার্থীরা। বোয়ালখালী নতুন বাজার, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি, ৩০ এপ্রিল
ছবি: পলাশ বড়ুয়া

দুধ চাচা ভুল করলেও ভুল করেনি পণ্ডিত শিয়াল। সে একটা আছাড় মেরেই দিল আমাকে। বয়স পঁচিশের ঊর্ধ্বে। রাত এগারোটার বেশি। খুব হালকা জ্যোৎস্না। সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। মনের মধ্যে ভূত–পেতনির ভয় কাজ করছিল। হঠাৎ একটা কুকুর একটা শিয়ালকে তাড়া করেছে। জীবন বাঁচাতে চোখ–মুখ বন্ধ করে দৌড় শুরু করে শিয়াল। এ পাশ থেকে দৌড়ে ও পাশ যেতে শিয়ালটা আমার সাইকেলে এসে খুব জোরেশোরে ধাক্কা লাগায়। আর তাতেই আমি ছিটকে পড়ি জঙ্গলের মধ্যে। সাইকেলের সামনের ফর্ক বা গার্ড ভেঙে যায়, আমি হেঁটে হেঁটে বাড়ি গেলাম।

একবার এক স্কুলে নেমেছিলাম দ্রুত সাইকেল প্রতিযোগিতায়। স্কুলে চলছিল বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান। ২৫-৩০ জন প্রতিযোগী। পরিচালক স্যার বাঁশিতে হুইসেল দিয়েছেন। সাইকেল ছুটছে ঝড়ের গতিতে। কাসেম ভাই সবার সামনে, তারপর তসলিম, এরপরই দোস্ত ফয়জুর রহমান। আমি মাঝামাঝির ওপরে না। বত্রিশ পাকের খেলা। আট পাকের সময় আমি আছাড় খেলাম। সাইকেল শক্ত করে ধরে রাখার কারণে আমি সাইকেলের নিচে। আছাড় খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ সাতখানা সাইকেল আমার গায়ের ওপর হুড়মুড় করে এসে পড়ল।

কেপটাউনে এসেও সাইকেল নিয়ে এক মহাবিপদে পড়েছিলেন। একদিন বিকেলে গ্রাসি পার্ক থেকে ঈগল পার্ক যাচ্ছি। একটা মাঠ অতিক্রম করামাত্র দুজন কালো ব্যক্তি, ইয়া উঁচু লম্বা গান নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সামনে। আমি দ্রুত সাইকেল ঘুরিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। একে তো আমি হোঁদল কুতকুত তারপর ভীষণ ভয়। প্যাডেল চলে না। অবশেষে তারা দৌড়ায়ে আমাকে ধরে ফেলে। আমার শরীর তল্লাশি করে ফোন আর বাইসাইকেল কেড়ে নিল। আমি কাঁপতে কাঁপতে ঈগল পার্ক পৌঁছালাম।

*লেখক: মাহফুজার রহমান, কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা।