বিলেতের জীবন: অন্তরে, অন্তরালে

ব্রিটেনে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের অভিভাবকেরা যখন বাংলাদেশে নিয়ে বিয়ে দেন, তখন তাঁরা কি জানেন, কী পরিমাণ অবিচার করেন তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের প্রতি? না ছেলেটি সুখী হতে পারেন, না মেয়েটি। দুজন মানুষ একই ঘরে বসবাস করেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে যোজন যোজন দূরত্ব। এই দূরত্ব সাংস্কৃতিক, এই দূরত্ব মানসিক, এই দূরত্ব চিন্তাভাবনা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, এই দূরত্ব সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনায়, এই দূরত্ব ভাষায়, এই দূরত্ব জীবনধারায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক চেষ্টা করেও তাঁদের কেউই এই দূরত্ব অতিক্রম করতে পারেন না। ফলে যা হয়, দুজন মানুষ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একই ছাদের তলায় বসবাস করেন ঠিকই, কিন্তু কেউই সুখী হন না। দাম্পত্যজীবনের কিছু নিয়মমাফিক দায়িত্ব পালন ছাড়া তাঁদের মধ্যে অন্য কোনো বন্ধন তৈরি হয় না। সুগ্রন্থিত বন্ধনের আকাঙ্ক্ষায় নিয়ত চেষ্টা করে যাওয়া মানুষ দুটি একসময় হাঁপিয়ে ওঠেন ক্রমাগত ব্যর্থতায়। বিয়েটা তখন তাঁদের কাছে হয়ে ওঠে এক দুর্বিষহ সম্পর্কের নাম। ফলে যা হয়, একপর্যায়ে সম্পর্কটি ভেঙে যায়।
মা–বাবা, আত্মীয়স্বজনের চাপে ইচ্ছার বিরুদ্ধে একদিন বাংলাদেশের কোনো জেলা শহর বা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উন্নত জীবনের আশায় বিলেতি পাত্রকে বিয়ে করে আসা মেয়েটির জীবনে সুখের স্বপ্ন তখন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। দুঃখের সাগরে ভাসতে থাকেন তিনি। তাঁর বুকফাটা কান্না ভেসে বেড়াতে থাকে টাওয়ার হ্যামলেটসের অলিগলিতে, হোয়াইট চ্যাপলের কোলাহলে, ওল্ডহাম, সাউথ হল কিংবা বার্মিংহামের আকাশে-বাতাসে, লিডস, কার্ডিফ, ম্যানচেস্টার কিংবা অরপিংটনের সহস্র ব্যস্ততার ভিড়ে।

শুরু হয় অবর্ণনীয়, যন্ত্রণাদগ্ধ, বিষাদময় জীবন তাঁর। যে জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র অর্থ দাঁড়ায় কোনোভাবে জীবনকে শুধু টেনে নিয়ে যাওয়া, উদযাপন করা নয়। অথচ এ রকম গ্লানিকর জীবনের জন্য না ছেলেটি, না মেয়েটি দায়ী থাকেন! এর জন্য দায়ী থাকেন কিছু অবিবেচক অভিভাবক, যাঁরা কিছু গৎবাঁধা ভাবনা ও বিশ্বাস থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারেন না। তাঁরা বোঝেন না, জন্মসূত্রে পিতামাতা হলেই সন্তানের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যায় না। শুধু তাঁদের ইচ্ছার মূল্য দিতে গিয়ে কিছু ছেলেমেয়ের জীবন একেবারে তছনছ হয়ে যায়। এই ছেলেমেয়েগুলোর কিছু কিছু হয়তো নানা রকম কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন, কিন্তু অনেকেই জীবনের বাকি দিনগুলো বেঁচে থাকেন একধরনের ট্রমা বা বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা নিয়ে। অথচ এই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার জন্য তাঁদের কোনো দায়ই থাকে না।
তাহলে কেন মানুষের জীবন নিয়ে আমরা অভিভাবকেরা এভাবে ছিনিমিনি খেলব? এই অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? কেন বাংলাদেশে বসবাস করা ভাইয়ের বা বোনের ছেলেটির সঙ্গে বিলেতি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তাঁকে বিলেতে আনার ব্যবস্থা করতে হবে? কেন আমরা আমাদের বিলেতে পড়ুয়া মেয়েটাকে ব্যবহার করব ভাগিনা-ভাতিজার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে? কেন তাঁদের আমরা ইমিগ্রেশনের বলির পাঁঠা বানাব?
একটি নয়, দুটি নয়, বেশ কিছু জীবনের করুণ গল্প শুনে এই কথাগুলো লিখছি। একেকটি জীবনের গল্প শুনেছি আর নীরবে অশ্রুসিক্ত হয়েছি। আশ্চর্য ব্যাপার কী জানেন, সব কটি জীবনের গল্পই প্রায় একরকম। সব কটির কাহিনি প্রায় অভিন্ন। কোথাও বোনের ছেলে বা মেয়েকে বিলেতে নিয়ে আসতে হবে, কোথাও ভাইয়ের ছেলে বা মেয়েকে।
কিছু কিছু গল্প আছে খানিকটা ভিন্ন। সেখানে ভাগিনা-ভাতিজার ব্যাপার নয়, সেখানে হলো আজ্ঞাবহতার ব্যাপার। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অনেক অভিভাবক চান বাংলাদেশ থেকে সহজ–সরল এমন একটি মেয়েকে তাঁদের ছেলের বউ করে আনতে, যিনি ঘরকন্নার সব কাজ করে যাবেন নীরবে, নির্বিবাদে কোনো রকম প্রতিবাদ ছাড়া। ফজরের নামাজের আগে গরম পানি দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির অজুর আয়োজন করে দেবেন। বাড়িশুদ্ধ মানুষের নাশতার আয়োজন করবেন একা। বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাবেন। ছুটতে ছুটতে বাসায় ফিরে ভর্তা-ভাজিসহ তিন-চার পদ দিয়ে আয়োজন করবেন দুপুরের খাবারের। বিকেল হলেই চা-নাশতার আয়োজন করবেন সবার জন্য। রাতে আবার সবার প্লেটে প্লেটে তুলে দেবেন গরম–গরম ভাত। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে সব থালাবাসন ধুয়েমুছে রান্নাঘর গোছাবেন তিনি। এসব করতে করতেই প্রায় মধ্যরাত। মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে শরীরটা যখন আর চলে না, তখন ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁকে পালন করতে হবে আরও কিছু দাম্পত্য দায়িত্ব। সেখানেও পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে হবে তাঁকে। অসংখ্য মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়ে যেতে হবে তাঁকে।

এসব করতে করতে ফজরের নামাজের আর খুব একটা বাকি থাকে না। মাঝখানে ঘুমের জন্য পাবেন তিনি মাত্র চার কি পাঁচ ঘণ্টা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই সময়টুকুই শুধু পাবেন নারী তাঁর ব্রিটিশ নাগরিকত্বের বিনিময়ে। তাঁকে আবার কমপক্ষে এক হালি সন্তানধারণের সক্ষমতার পরীক্ষায়ও কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে হবে। এভাবে জীবনটা যে তাঁর কাছে কতটা ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে; স্বামী, অভিভাবকেরা তার কোনো খবরই রাখেন না বা রাখার দরকার মনে করেন না। ভেতরে–ভেতরে ফুরিয়ে যেতেন নারী। ফুরিয়ে যাওয়া এই নারী যখন একান্নবর্তী পরিবারকে পারদর্শিতার সঙ্গে আগের মতো সেবা দিতে না পারেন, তখনই তাঁর ওপর নেমে আসে খড়্গহস্ত, নানা রকম গঞ্জনা, অভিযোগ ও অবহেলা। দায়িত্ব পালনে তাঁর ব্যর্থতার ফিরিস্তি ক্রমে দীর্ঘ হতে থাকে। নেমে আসে মানসিক নিপীড়ন। ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিক নির্যাতনও। এভাবে আর বেশি দূর এগোতে পারেন না নারীটি। একপর্যায়ে ভেঙে পড়েন। কখনো হয়তো হয়ে ওঠেন প্রতিবাদী। ব্যস, আর যায় কোথায়! অভিভাবক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান, ‘এই অসভ্য, বেয়াদব’কে দিয়ে আর চলবে না, ছেলেকে আবার বিয়ে দিতে হবে।
নির্মম বাস্তবতা হলো, আবার গন্তব্য বাংলাদেশ। পাত্রীকে, তাঁর অভিভাবককে দেখানো হয় বিলেতের উন্নত জীবনের লোভ, লাল পাসপোর্টের স্বপ্ন। মুগ্ধ হয়ে যান তাঁরা। ফাঁদে পা দেন। বিদায়বেলায় মেয়ের কানে কানে মা সুখী হওয়ার মন্ত্র বলে দেন—‘মারুক কাটুক সব সহ্য করে চোখ বুজে পড়ে থাকিস, শ্বশুর-শাশুড়ির কথা শুনিস, আমাদের মুখ রাখিস। তাদের কাছ থেকে আমাদেরকে যেন কোনো অভিযোগ শুনতে না হয়।’ শুরু হয়ে যায় আরেকটি জীবন ভাঙার খেলা।
এভাবে একের পর এক জীবন ভাঙার অধিকার কোথায় পেয়েছি আমরা? এই জঘন্য চর্চা বন্ধ হবে কবে? কবে আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে? কবে আমরা অনুধাবন করব যে বিয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ছেলেমেয়ের ওপর অভিভাবকের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া রীতিমতো অন্যায়? কবে আমরা বুঝব যে ছেলেমেয়েকে পছন্দমতো জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার অধিকার দেওয়াটা সুখী দাম্পত্যজীবন গড়ার অন্যতম পূর্বশর্ত?

লেখক: লন্ডনপ্রবাসী কবি