বিশ্ব নারী দিবসের ভাবনা

প্রতীকি ছবি

প্রতিবছরের মতো এবারও এসে গেল বিশ্ব নারী দিবস, ৮ মার্চ। সুদীর্ঘ ইতিহাস দিনটির, কত কত অবদান দেখছি প্রতিভাময়ী নারীদের। আনন্দ এবং আগ্রহ নিয়ে কাজ শেষ করছি, বাসায় গিয়ে পড়ব কী কী করেছেন প্রথিতযশা নারীরা গত বছর।

রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। কাজ করছি হাসপাতালে। বন্ধু নার্স পাশে এসে বসলেন। বললেন, ‘অমুক রোগী তোমার আন্ডারে না?’ বললাম হ্যাঁ, কেন? উত্তরে বললেন, ‘তোমার হাতে সময় আছে? একটু সময় লাগবে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে।’ আগ্রহ আকাশ ছুঁয়েছে তখন, ‘বললাম, বলুন।’

রোগী আইসিইউতে, মাত্র মেশিন খুলে ফেলা হয়েছে। এখনো অনেক অক্সিজেন লাগছে তাঁর। কোভিড–১৯–এর রোগী। ভালো বা মন্দ যেকোনো দিকে তাঁর অবস্থা মোড় নিতে পারে। নার্স বন্ধু বললেন, রোগী, ধরে নিলাম নাম তাঁর সিলভিয়া, তাঁর যখন ১৯-২০ বছর বয়স, তখন তিনি বেছে নিয়েছিলেন উচ্ছৃঙ্খল জীবন। নেশা দ্রব্য, সিগারেট থেকে শুরু করে যাবতীয় অপকর্ম তাঁর জীবনের সঙ্গী। বাসা থেকে পালিয়েছিলেন, কারণ ওনার বাবা–মা অতিষ্ঠ হয়ে কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর। এর মাঝে জীবনে এসেছিল প্রেম। বছর দুই যেতেই দুই বাচ্চার মা হয়ে গেলেন তিনি। নিজের সন্তানকে অতিষ্ঠ লাগত তাঁর। বেপরোয়া জীবনে বাঁধা। পড়াশোনা হয়েছে হাইস্কুল পর্যন্ত। একটা দোকানে কাজ করে জীবন চলে। সিগারেট আর মদের পয়সায় কম পড়ে বাচ্চাদের ডায়াপার আর খাবার কিনতে। অবহেলায় বাচ্চাগুলো শুকিয়ে কাঠ হলো। মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এক রাত জেলে থাকলেন তিনি। এ পর্যায়ে সরকার নিয়ে নিলেন তাঁর দুই সন্তান তাঁর কাছে থেকে, বাচ্চাদের বাবা নতুন জীবনে চলে গেল। তিনি বাসায় ফিরলেন একদিন কমিউনিটি সার্ভিস সেরে। কোর্ট শাস্তি দিয়েছেন তাঁকে, পূর্ণ করতে হবে বহুদিন কমিউনিটি সার্ভিস। ছোট্ট কোনো রকম একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই, কিন্তু একদম ফাঁকা। ছোট্ট দুজন বাচ্চার আধো আধো মা ডাক নেই। বাসায় এলেই শত অবহেলাতেও তাদের কোনো বিরক্তি ছিল না। কী যে খুশি হতো তাঁকে দেখলে। ছোট্ট দুহাতে পৃথিবীর সব ভালোবাসা দিয়ে তাকে ঘিরে ফেলতে চাইত। তারা নেই। সস্তা কিছু খেলনা পড়ে আছে। ছবি বের করে দেখে বাচ্চাদের জন্য অনেক কাঁদলেন তিনি। অনেকবার দুর্ব্যবহার করে বের করে দিয়েছেন দুই আর তিন বছরের শিশুদের। এখন অনেক ডাকলেন, এরিন, মার্ক, কেউ ছুটে এল না। কেউ না। সারা ঘরে মিষ্টি কিছু গন্ধ, যা শুধু ছোট্ট বাচ্চাদের গায়ে থাকে। সারা রাত নির্ঘুম কাটল তাঁর।
পরদিন সোশ্যাল সার্ভিস অফিসে ছুটে গেলেন বাচ্চাদের ফিরে পেতে। তারপর বহুদিন বসে থাকলেন সিলভিয়া সে অফিসে। দত্তক দেওয়া হয়েছে বাচ্চাদের। কেউ খোঁজ দিলেন না ওদের। মা হিসেবে ওদের দেখাশোনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। তারপর তিনি পড়াশোনা শুরু করলেন চাইল্ড ডেভেলপমেন্টের ওপর। দিনে মানুষের বাসা পরিষ্কার থেকে শুরু করে যেকোনো কাজ করেন জীবিকার তাগিদে। রাতে পড়েন। কোনো নেশা দ্রব্য ছুঁয়ে দেখেননি তিনি আর কোনো দিন। পড়াশোনা শেষ করলেন ডিসটিংশান নিয়ে বছর কয়েক পর। নিজের বাচ্চা না পেলে অন্য বাচ্চার সেবা করার আশায়। সরকারি ভালো একটা চাকরির আশায় অনেক ঘুরলেন তিনি। কিন্তু অতীত জেনে কেউ নিচ্ছেন না তাঁকে কোনো চাকরিতে। হাল ছাড়লেন না সিলভিয়া। তারপর একদিন....

ওনার গল্পটা শুনলেন মন দিয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে কিছু নারী এবং এ রকম একজন নারীর চোখে ভালো থাকার প্রত্যয় তাঁরা দেখলেন। বাচ্চা এডপশান দেওয়ার সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সেকশানে চাকরি হলো তাঁর। বয়স ৩০–এর কোঠায়। কাজে সততা আর একনিষ্ঠতার পুরস্কার হিসেবে নিজের বাচ্চাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে এডপটেড পরিবারের কাছ থেকে। নতুন জীবন পেলেন তিনি। নিজ হাতে মানুষ করলেন দুজন লইয়ার বাচ্চাকে, যাঁরা এখন ন্যায়ের পথে লড়ে চলেছে। ধীরে উন্নতি হতে লাগল তাঁর কাজে অবশ্যই। এখন তাঁর বয়স ৫৫। বিপথগামী বাচ্চারা যারা ফস্টার কেয়ারে বড় হয়, তাদের আইডল তিনি এখন। কতজনকে পথে এনেছেন সিলভিয়া, তার নাকি কোনো হিসাব নেই। নার্স বন্ধু চোখ মুছলেন তারপর। বললেন, ওঁর নিজের ছেলেও সৎ পথে ফিরে এসেছে সিলভিয়ার তত্ত্বাবধানে। রোগীকে যেন আমি অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করি।

লেখক

চুপি চুপি দেখতে গেলাম সেদিন মিস সিলভিয়াকে। পুরো রুমভর্তি কত রকম বাচ্চাদের ছবি আর চিঠি, ভালো হয়ে উঠুন, আমরা আপনাকে মিস করছি মিস সিলভিয়া—এ জাতীয় কথা লেখা। তাঁর হাত ধরে বললাম, ‘বিশ্ব নারী দিবস আসছে, তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন, প্লিজ। নিজের বাচ্চার জন্য যেমন সৎ পথে ফিরে এসেছেন এবং এত বছর কোমল এবং কঠোর শাসনে অনেক বাচ্চার জীবন গড়েছেন, সে কাজ কিন্তু শেষ হয়নি, ঝাপসা চোখে প্লাস্টিকের চশমার মধ্য দিয়ে খেয়াল করিনি কখন বড় বড় চোখ করে সিলভিয়া শুনছেন আমার কথা। কথা থামতে হাতটা ধরলেন আমার, বললেন ডক, ‘আমি চেষ্টা করছি। আপনি কাঁদবেন না।’

কত শত অবদান পড়ছি–দেখছি বাসায় এসে পুরো পৃথিবীর নারীদের। কিন্তু মনের কোণে সিলভিয়ার চেহারা ভাসছে। কী না পারেন আপনারা। এগিয়ে চলুন আমাদের সন্তানদের একটা সুন্দর পৃথিবী দিতে।

**(স্থান কাল পাত্র বদলে দেওয়া ঘটনাটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা, সংশ্লিষ্ট নারীদের অনুমতি নিয়ে। তাঁরা অনুরোধ করেছেন নারীদের হতাশ না হতে। তাঁরা বলেছেন, ছাই থেকেও নতুন জীবনের সূচনা হয়। নিজের ওপর বিশ্বাস না হারাতে।)