বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান নাকি বিশ্বনেতাদের জনসংযোগ

ইউরোপীয় পার্লামেন্ট

আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলো কি বিশ্বনেতাদের জনসংযোগের হাতিয়ার নাকি বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অঞ্চলভিত্তিক এবং বৈশ্বিক অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। এসব সংস্থার সফলতা ও ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করতে গেলে হয়তো এই ছোট কলামে হবে না। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাগুলোর সফলতা যেমন অনেক ঠিক, তেমনি অনেক ব্যর্থতাও আছে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রাখতে না পারা তার মাঝে অন্যতম। অনেক সময় সেই প্রতিশ্রুতি সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

এই তো প্রায় এক মাস আগে জুনের ১১ থেকে ১৩ তারিখ যুক্তরাজ্যের কর্নওয়ালে অনুষ্ঠিত হলো জি-৭ সামিট। এই সামিটের গুরুত্ব ছিল অনেক। এই সাত ধনী দেশ পৃথিবীর জিডিপির প্রায় সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও জি-৭ কোনো আইন পাস করতে পারে না, কিন্তু তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রভাব সারা পৃথিবীর ওপর প্রভাব ফেলে।

এ বছরের এই সামিটের সভাপতিত্ব করে যুক্তরাজ্য। আবার এই বছরের অক্টোবরে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে। করোনাভাইরাস মহামারি, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, জলবায়ু পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারণা, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণসহ আরও অনেক বিষয়ে আলাপ হয়েছে এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না বা সমস্যা সমাধানে সিদ্ধান্তগুলোর কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।

জি-৭–এর নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে আগামী ১২ মাসের মধ্যে তারা প্রায় ১ বিলিয়ন করোনা টিকার ডোজ গরিব দেশগুলোকে দান করবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা যথেষ্ট নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা জি-৭ সামিটে এক প্রস্তাবনা রাখে, যাতে হয়তো ধনী এই সাত দেশের টাকা বেশি খরচ হতো কিন্তু টিকার সুষম বণ্টন হতো। স্বল্প আয়ের প্রায় ১০০ দেশের সামগ্রিকভাবে জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন। জাতিসংঘের এপ্রিল পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধনী দেশগুলো সার্বিক উৎপাদিত টিকার প্রায় ৮৭ শতাংশ নিজেদের জন্য ব্যবহার করেছে বা রেখে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাধা থাকার কারণে স্থানীয়ভাবে এই টিকা প্রস্তুত করাও সম্ভব নয়। এক বিলিয়ন টিকা গরিব দেশগুলোকে দেওয়া অবশ্যই ভালো সংবাদ, কিন্তু এই সমস্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়েও জি-৭ নেতাদের প্রতিশ্রুতির মধ্যে অনেক বৈষম্য। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সমগ্র পৃথিবী যে ক্রান্তিকাল পার করছে বা অদূর ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের কোনো রূপরেখা নেই বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। জি-৭ এর নেতারা বলছেন, কয়লাশক্তি থেকে তাঁরা সম্পূর্ণ বের হয়ে আসবেন, কিন্তু সময়সীমার কথা উল্লেখ করেননি। বড় বড় আন্তর্জাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন কর ফাঁকি দিতে না পারে, সে ব্যাপারেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থা ওইসিডির মতো এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রতিবছর প্রায় অতিরিক্ত ৮১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কর আদায় করা যাবে, কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় অনেক দেশের মধ্যে বেশ কিছু রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে। বাইডেন আদৌ কংগ্রেসে এই প্রস্তাব পাস করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেরও নিন্দা জানানো হয়। কিন্তু চীনের ব্যাপারে ব্রিটেন ও আমেরিকার নীতির অনেক মিল থাকলেও অন্য সদস্যদের নীতির যথেষ্ট পার্থক্য আছে। সর্বোপরি যত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাইডেনের কারণে হয়তো আমরা বলতে পারব ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’ কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক মহামারি এবং অস্থিতিশীল অর্থনীতির এই বেহাল পরিস্থিতিতে ধনী দেশগুলোর আরও সক্রিয় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত ছিল।

আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে অনেক অর্জন আছে, কিন্তু সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারা এবং প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না করাসহ অনেক অভিযোগও আছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো পর্যায়ক্রমে বিশ্বনেতা এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোর প্রতি আস্থা হারাবে, যদি এইভাবে চলতে থাকে।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, সরকার ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগ, দ্য ইউনিভার্সিটি অব এসেক্স, যুক্তরাজ্য