ভালোবাসা স্থান, কাল, পাত্রহীন

প্রথম আলো ফাইল ছবি

মা–বাবা, তিন বোন আর দাদাকে নিয়ে আমাদের পরিবার। দাদার সঙ্গে আমার বয়সের তফাত প্রায়ই আট বছর। দাদার খুব আদরের ছোট বোন ছিলাম। আদর বেশি পেলে যা হয়। সারাক্ষণ দাদার পিছু পিছু হাঁটতাম–চলতাম। এর জন্য দাদা মাঝেমধ্যে বিরক্তও হতেন। দাদা যখন সবে কলেজে গিয়েছেন, তখন আমি মাত্র ঢুকেছি স্কুলে। জানুয়ারি মাস শীতের সকাল সবাই একটু বেলা করেই ঘুম থেকে জাগে। কেউ আবার তাড়াতাড়ি জেগে গেলেও বিছানায় ওম–ধরা লেপের নিচে অলসভাবে আরও কিছুটা সময় কাটায়। জীবন–জীবিকার জন্য একমাত্র বাবা নিরলসভাবে প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে রেডি হয়ে স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হন। সরকারি চাকরিজীবী বাবা প্রতিদিন ট্রেনে চেপে বগুড়া থেকে সান্তাহারে যান নিজ কর্মস্থলে। প্রতিদিন সূর্যের মুখ দেখে বিছানা ছাড়তাম। এরপর খোলা রোদ পড়া উঠানে বসে খেতাম মুড়ি দিয়ে খেজুরের রস, অথবা শীতের নতুন সবজি আর বাসি মাষকলাইয়ের ডাল দিয়ে গরম ভাত। নেহাত এসব না মিললে খেতাম শুকনো মরিচ পোড়া, রসুনপাতা ও রাঁধুনিপাতা দিয়ে মাখানো আগের রাতের ভাত। আহা কী অমৃত ছিল সেই স্বাদ! এখনো মনে পড়লে মনের ভেতরে জাগে একটা তীব্র অনুভূতি।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল দাদার চুক চুক করা শব্দে। আরও একটা কিসের যেন ডাক শোনা যাচ্ছে। এক লাফে বিছানা ছেড়ে দেখতে গেলাম দাদা কী করছেন। দেখলাম, দাদা পুরো উঠোন চক্রাকারে দৌড়াচ্ছেন আর মুখ দিয়ে শব্দ করে ডাকছেন। দাদার ডাকে সাড়া দিয়ে ছোট্ট একটি কুকুরছানাও তার নিজস্ব ভাষায় শব্দ করছে আর দাদাকে অনুসরণ করে তাঁর পেছনে ছুটছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তা দেখছি।

হঠাৎ মায়ের বকুনিতে টের পেলাম গায়ে শীতের বস্ত্র নেই, এমনকি পায়ে স্যান্ডেলও নেই। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, পড়াশোনা নেই, সারা দিন কুকুরছানার পিছেই লেগে থাকতাম। কুকুরছানার বয়স তখন ছিল হয়তো এক অথবা দেড় মাস। দাদা কুকুরের নাম দিলেন লাইকা। দাদা কীভাবে লাইকাকে ডাকেন, আদর করেন, কোলে তোলেন, খেতে দেন—একে একে সবই নকল করতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য লাইকা যেন আমার সঙ্গেও তেমনই আচরণ করে, যেমন দাদার সঙ্গে করে। কিন্তু না, প্রভুভক্ত লাইকা শাহজাদা দাদাকে যেমন আঁকড়ে থাকে, আমাদের কাছে তার সিকি পরিমাণও ঘেঁষে না। লাইকা কালক্রমেই বাড়ির সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে লাগল। একমাত্র মা লাইকাকে একদমই দেখতে পারতেন না। কারণ, মা ছিলেন শুচিবায়ুগ্রস্ত রোগী। এ কারণে লাইকা মায়ের একরকম মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেখানে–সেখানে মলত্যাগ করা আর সবার গায়ে গায়ে ঘেঁষাই ছিল লাইকার স্বভাব। এটাই ছিল লাইকাকে অপছন্দ করার মায়ের একমাত্র কারণ।

উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর দাদা পড়াশোনার জন্য ঢাকায় চলে গেলেন। দাদা চলে যাওয়ার পর লাইকা দাদার শূন্যতায় বেশ বিষণ্নতায় ভুগত। বাবা সেই সময় দাদার ভূমিকা পালন করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে লাইকা দাদার স্থানে বাবার বশ্যতা শিকার করল এবং বাবাকেই তার প্রভু হিসেবে মানল। বাবা লাইকার জন্য আলাদাভাবে বাজার থেকে কিনতেন ছাঁট মাংস। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচানোর জন্য ছালা কিনে তার ওপর ঘুমানোর ব্যবস্থা করলেন, মুরগি পালার খোপের মতো করে লাইকার জন্য ঘর তৈরি করলেন। ইতিমধ্যে মায়ের কাছেও বেশ সহনীয় হয়ে উঠেছে লাইকা। এভাবে কেটে গেল কয়েক বছর।

বাবার মেরুদণ্ডের ব্যথার জন্য প্রতিদিন জার্নি করা নিষেধ করলেন ডাক্তার। বাবা তখন সান্তাহারে একটি ব্যাচেলর মেসে নিজের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সপ্তাহে একবার আসতেন বগুড়ায়। ডিউটি শেষে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে আসতেন আবার শনিবার ভোরের ট্রেনে চলে যেতেন। সেই সময়ের কথা, কী যে হৃদয়বিদারক ঘটনা। কাকডাকা ভোরে বাবা রিকশাযোগে চলছেন রেলস্টেশনের উদ্দেশে, লাইকা রিকশা লক্ষ্য করে ছুটছে বাবার পেছনে পেছনে। যতক্ষণ ট্রেন না আসে বাবার পাশেই বসে থাকে। বাবা ট্রেনে উঠলে সেও উঠতে চায়। যাত্রীদের চেঁচামেচির কারণে বাবা ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন যতক্ষণ ট্রেন না ছাড়ে। ট্রেন ছাড়লেই ট্রেনের পিছু পিছু লাইকাও ছুটতে থাকে। প্রায়ই এক স্টেশনের কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসত বাসায়। এমন কাজ শুধু এক–দুবার নয়, কয়েক বছর টানা করে চলেছিল। বাবা অনেক রকমভাবে চেয়েছেন তাকে পিছু ছুটাতে, তার অগোচরে চুপ করে লুকিয়ে পালিয়ে স্টেশনে যেতে, তাও পারেননি। সপ্তাহ শেষে যখন বাবা বাসায় ফিরতেন, দেখতাম লাইকার উচ্ছ্বাস। বাবার বুক অবধি সামনের দুই পা উঠিয়ে দিত। লেজ নাড়িয়ে অনেকক্ষণ বাবার আশপাশে আনন্দসূচক শব্দ করে ঘেঁষাঘেঁষি করত।

১০ বছর পর দাদা বিয়ে করে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। পরিবারে এখন তিনজন সদস্য—আমি, বাবা আর মা। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাবা এখন বাড়িতেই সময় কাটাচ্ছেন। বাবার বগুড়া থেকে সান্তাহারে ছোটাছুটি শেষ হওয়ার পর লাইকারও ছোটাছুটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

বাসায় এখন বেশ শান্ত পরিবেশ। মনে হয় সবাই একরকম প্রয়োজনহীন অলস সময় কাটাচ্ছেন। বাবা যখন অবসরপ্রাপ্ত হলেন, তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। সেদিন ছিল শুক্রবার, আমাদের স্কুলের বার্ষিক পিকনিক ছিল। আমি ১০টার মধ্যেই বেরিয়ে যাই স্কুলের উদ্দেশে। পিকনিকের রিজার্ভ বাসযোগে স্কুলের সবাই গেলাম ঐতিহাসিক স্থান মহাস্থানগড়ে। পিকনিক শেষে সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরলাম। খেয়ালই করলাম না, আজ বাসায় ফেরার পরেও কাছে এল না লাইকা। ঘরে ঢুকতেই দেখলাম মা কাঁদছেন। বাবাও মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছেন। মা কেন কাঁদছেন, বারবার জিজ্ঞাসা করেও তার উত্তর মায়ের কাছে পেলাম না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম অবশেষে। বাবা জানালেন, লাইকাকে মেরে ফেলেছে। মুহূর্তের মধ্যে শরীর গরম হয়ে উঠল। চোখ চলে গেল দরজার দিকে, যেখানে লাইকা সব সময় বসে থাকত। জিজ্ঞাসা করলাম কে মেরে ফেলেছে, কেন মেরেছে? বাবা বললেন, পাশের পাড়ার কুকুর এপাড়ায় এসেছিল। লাইকা তাদের ধাওয়া করতে করতে ওপাড়ায় গিয়েছিল। ওপাড়ার এক লোক লাইকার মাথায় বাঁশ দিয়ে বাড়ি দিয়েছিল। মাথা ফেটে লাইকা ওখানেই মারা গেছে। বাবা কথাগুলো বলেই চোখ মুছতে লাগলেন। লাইকার না থাকার শোক কেটে উঠতে আমাদের বেশ কয়েক দিন লেগেছিল। মা এতটাই শোকে কাতর হয়েছিলেন যে কাজকর্ম এবং নাওয়া–খাওয়া ঠিকমতো করতে পারতেন না।

একটা গৃহপালিত পশুর প্রতি ভালোবাসা কেমন হয়, সেটা নিজ চোখে দেখছি। ৩৫ বছর হয়ে গিয়েছে, আজও ভুলতে পারি না লাইকাকে। লাইকার কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা হাহাকার করে ওঠে। লাইকার প্রভুভক্তি আর ভালোবাসা অম্লান হয়ে আছে। এই জীবনে কত মানুষের আনাগোনা ছিল, পারাপার হয়েছে আরও কত মানুষ, অথচ হৃদয়ে অনেকেই স্থান পায়নি।

*ফৌজিয়া খাতুন, লিসবন, পর্তুগাল