ভাষা দিবসের কিছু ভাবনা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা পৃথিবীর সব বাংলা ভাষাভাষী বন্ধুদের। হাসপাতালে কাজ করছিলাম গতকাল রাতে। যেকোনো একটা রাতের মতোই ব্যস্ত রাত। রোগীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখি তিনি স্প্যানিশ ভাষী। একে রাত বাজে প্রায় ১২টা। তারপর মাস্কের মধ্য দিয়ে কথা, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে বেশি সময় পার করতে হলে একই রুমে। আইপ্যাডে ইন্টার প্রিটারের সাহায্যে তাঁর সঙ্গে কথা বললাম।

শারীরিক পরীক্ষা শেষে বাই বলে বের হওয়ায়  জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন দেশি তুমি?’ বললাম বাংলাদেশ। পরিষ্কার বাংলায় তিনি বললেন, ‘আগে বলেননি কেন?’ ঢাকায় আমি বহুদিন ছিলাম। স্মিত হেসে তারপর বললেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে।’ মধ্যরাতে খুশিতে মনে হলো অনেক কিছু বলি। কত কথা মনের মাঝে সাজানো আছে। ভাষার জন্য জীবন দেওয়া গর্বিত দেশের মানুষ আমি। ভালো এবং সুস্থ হয়ে যান, এই কামনা করে বের হলাম রুম থেকে। ১২টা বেজে গেছে। অমর একুশের প্রহর শুরু। খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে যেতে মন চাইছে খুব।

’৫২–এর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সেই দিন যেন চোখের সামনে দেখছি, যেন রাতের প্রথম প্রহরে। সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক ওনারা মিছিলে; জীবন দিয়ে গেলেন, তবু আমাদের বাংলা ভাষাতে কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার শুরুটা করে গেলেন তাঁরা।

২১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা শহীদ হলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে বিক্ষুব্ধ জনতা মিলিত হলেন পরদিন, ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে তৈরি হয়েছিল প্রথম স্মৃতিসৌধ, যা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে। ১৯৫৪ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং ১৯৫৬ সালে ২য় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ভালোবাসা থাকলে কী না হয়। গর্ব এবং আনন্দ নিয়ে কাজ করে চলেছি বাকি ৪ ঘণ্টা, রাত চারটায় কাজ শেষ হয়েছে। হাসপাতালের নিয়ম অনুয়ায়ী ঘুমাতে হবে সকাল ৮টা পর্যন্ত, বহু কারণে। অন্যতম বিশেষ কারণ রাতে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে যেতে গিয়ে কেউ যেন অ্যাকসিডেন্ট না করে, বেশি ক্লান্ত হয়ে যায় তো। ডাক্তারদের নির্ধারিত রুমে গিয়ে দেখি, কেউ একজন শেষ খালি রুমটাতে ঘুমাচ্ছে। বিগ বস কাজ করছেন নিচে, গিয়ে বললাম, এখানে বসে থাকি সকাল ৮টা পর্যন্ত, তারপর বাসায় যাব। তিনি বলেন, ‘গাড়ি চালানোর মতো ফিট থাকলে চলে যাও বাসায়।’ আমাকে আর পায় কে? গাড়ি চালিয়ে রওনা হলাম শহীদ মিনারের পথে। হাতে প্রিয়জনের ভালোবাসা দিবসে দেওয়া একগুচ্ছ টিউলিপ, ফোনে বাজালাম গানটা

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি’।

ভাগ্যিস ভাষাটার জন্ম হয়েছিল। নয়তো নিজের ভাব প্রকাশের কোনো উপায় আমার আর জানা থাকত না। তোমাদের সবাইকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং জাতীয় শহীদ দিবসের শুভেচ্ছা। শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।