ভাস্কর্য

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দিয়া গতকাল থেকে একটা ডায়েরি বাড়িময় এমনভাবে খুঁজছে যে কেউ তাকে দেখলে ভাববে মেয়েটা বুঝি পাগল হয়ে গেছে।

বেশ শৌখিন বাড়িখানা। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। বাড়িটি দেয়ালঘেরা নয়। উন্মুক্ত চারদিক। মুক্ত বাতাস। পূর্ব দিকে একখানা ছোট্ট পুকুর। এর ঠিক মাঝখানে নিপুণ শিল্পময় একটি ভাস্কর্য। এ যেন কোনো এক জীবন্ত বাঙালি নারী। সদ্য অবসরে আসা ফয়েজুর রহমান নিজের তত্ত্বাবধানে বেশ যত্ন নিয়ে এ ভাস্কর্য গড়িয়েছেন। দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি ব্যয় করেন এই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে বসে। রহস্যজনকভাবে তিনি চেয়ে থাকেন ওই নারীমূর্তির দিকে।

প্রথম দিকে এ দৃশ্য কারও নজর না কাড়লেও দিনে দিনে খবরটি ছড়িয়ে পড়ায় বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। গ্রামের মানুষের কৌতূহল একটু বেশিই থাকে। বাজারে, মোড়ে চা–দোকানে, পরিবার-পরিজন, কাছের-দূরের আত্মীয়স্বজন সবার মাতামাতি যখন তুঙ্গে, তখন একদিন বিকেলে ঘাটে এসে রহমানের স্ত্রী জয়া তাঁর পাশে এসে বসেন। রহমান আরামকেদারায় হেলান দিয়ে শৌখিন চোখে চেয়ে আছেন ভাস্কর্যের দিকে। কেউ যে পাশে এসে বসেছেন, সেদিকে তাঁর খেয়ালই নেই। জয়া বলেন—
আচ্ছা, ‘তুমি এসব কী শুরু করেছ?’
খুব গম্ভীরভাবে তিনি জবাব দেন—
‘কিছুই তো শুরু করিনি।’
‘হ্যাঁ করেছ। তুমি এভাবে ওই নারীমূর্তির দিকে চেয়ে থাকো। লোকে এদিকে কত বিশ্রী কথাবার্তা শুরু করেছে, তা কি জানো?’
‘না, জানি না তো। জানার দরকারও নেই। আমি তো কাউরে নিয়া কোনো কথা বলি না। কারও পাকা ধানে মই দিই না। বাড়া ভাতে ছাইও দিই না।’
‘এটা ঢাকা শহর না। এটা গ্রাম। বোঝো কিছু?’
‘হ্যাঁ বুঝি। এখন আমাকে কী করতে হবে?’
‘গ্রামের মানুষ যা যা পছন্দ করে, তুমি তাই করবা।’
‘আচ্ছা বেশ। গ্রামের মানুষ কী পছন্দ করে?’
‘এইটা একেক এলাকায় একেক রকম। তবে এই এলাকার লোকজন আশা করে তুমি মসজিদ, ঈদগাহ, গোরস্তান—এসব নিয়া থাকো।’
‘আচ্ছা, আর কী?’
আর এই যেমন সারা দিন গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা। লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ। এলাকার গণ্যমান্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা, ওয়াজ মাহফিল—এসবের জন্য চাঁদা তোলা। এসব নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখবা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রহমান ভাবতে লাগলেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলার হিসাব-নিকাশ তিনি কখনোই ভালো বুঝতেন না। এ নিয়ে প্রায়ই ঝামেলায় পড়তেন। অতি সাবধানে তিনি জয়াকে বললেন-
‘আমি যদি মানুষের উপকার করি, কারও ক্ষতির চিন্তা না করি, আজীবন সৎ থাকি—জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এভাবেই চলেছি এবং বাকি জীবন এভাবেই চলব আশা করি। কেন আমাকে তিরস্কার সইতে হবে?’

এলাকার পরিবেশ মেনে নিয়ে চলতে না পারলে মানুষ টিকতে পারে না। এটাই নিয়ম।
তার মানে এখন আমাকে টিকে থাকার স্বার্থে মগজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মৃত্যুর গল্প বুনে দিতে হবে?

জয়া এবার রেগে গেলেও প্রকাশ করেন না।
দেখো, যা বলছি তা করো।
আচ্ছা করব। আর কোনো জনকল্যাণকর কাজ কি আছে?
আছে, এই যেমন মানুষের সামাজিক-পারিবারিক সমস্যা সমাধান করা, ছেলেমেয়েরা প্রেম-পিরিতি করলে তাদের ধরে বিয়ে দেওয়া। বিয়েতে রাজি না হলে এসব অনাচার করে সমাজ নষ্ট করার অপরাধে জনসমক্ষে বিচার করা। গ্রামে ঢুকে বিদেশির বউয়ের সঙ্গে কেউ পরকীয়া করছে কি না, চোখ রাখা। নষ্টামি–দুষ্টামি বন্ধ করতে লোকজনকে সতর্ক করা। এসব যত বেশি করবা, এই এলাকায় তোমার ইজ্জত তত বাড়বে।

রহমান একটু নড়েচড়ে বসে বললেন—
অন্যদের নিয়ে এভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি নিজেকে সময় দেব কখন? কখন নেব আমার মনের যত্ন। আমার মনটা তো অন্য সবার মতো না।
জয়া ভরসা দিয়ে বলেন—
সারা জীবন একা একা বসে থাকতে থাকতে তুমি অন্য রকম হয়ে গেছ। তাই মানুষের সঙ্গে মিশতে পারো না। সমাজের সবার সঙ্গে মিশে যাও, দেখবে ভালো লাগবে।
আচ্ছা বেশ। তাই হবে। সন্ধ্যার আগে শুধু দশটা মিনিটের জন্য কি এখানে বসতে পারব?

না, এখানে কখনো বসা যাবে না। তুমি এ ভাস্কর্য সরাও। গ্রামে মুখ দেখাতে পারছি না। লোকে বলে, এটা নাকি আমার সতিন। এখন তুমিই বলো, এই মেয়ে কে?
রহমান বোবা চোখে স্ত্রীর প্রতি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার ভাস্কর্যের দিকে তাকালেন। তারপর আরও নীরব হয়ে গেলেন।

স্বামীর এ অবস্থা দেখে কিছুক্ষণের জন্য জয়ার খুব মায়া হলো। আরও একটু কাছে এসে বলেন—
আচ্ছা, তোমার এ ভাস্কর্য তো কারও সঙ্গে মিলছে না। এটা কার? কে এই মেয়েটা?
রহমান নীরব।
সত্যি করে বলছি কারও কাছে বলব না। ওটা কে?
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। তুমি সত্যটা বলো।
আমি যদি সত্যিটা বলি, তুমি মানতে পারবে না।
পারব। বিশ্বাস করো, অবশ্যই পারব। জীবনটাই কেটে গেল তোমার সঙ্গে। এ জীবনে কোনো দিন কি তোমায় অবিশ্বাস করেছি?
না, করোনি।
তবে বলো।
না, বলব না। আমার ইচ্ছে নেই আমি বেঁচে থাকতে কেউ এটা জানুক। কারণ, আমার খুব ভয় করে।
জয়া এবার কিছুটা ক্ষুব্ধ হন।
আরে কী সব হেঁয়ালি করছ, তুমি মরে গেলে বলবে কী করে? আর এখানে ভয়ের কী আছে?
ভয়ের অনেক কারণই আছে। তুমি ওসব বুঝবে না।
তার মানে, তুমি বলবে না?
এত অস্থির হচ্ছ কেন। একটা ডায়েরিতে পাঁচটি পাতা আছে। ওটায় লিখে রেখেছি।
ডায়েরিটা কোথায়?

মরার আগে আমার নাতনি দিয়াকে বলে যাব সেটা কোথায় আছে। সে-ই তোমাদের পড়ে শোনাবে। তোমরা মনভরে শুনবে, ইচ্ছা করলে সেদিন গ্রামের সব কৌতূহলী লোকজনকে ডাকতেও পারো।

কোনো পরামর্শ, উপদেশ, অনুরোধই কাজে আসছে না। কাউকে তিনি পাত্তা দিচ্ছেন না। সারা দিন চলে ওভাবে ভাস্কর্যের দিকে চেয়ে থাকা।

জয়া সইতে না পেরে একদিন রাতে এলাকার কয়েকটি ছেলেকে দিয়ে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলেন। পরের দিন সকালে চা নিয়ে ঘাটে এসে যখন রহমান ভাস্কর্যবিহীন পুকুরটার দিকে তাকালেন, না, তারপর কী হলো তা আর বলতে চাই না।

কুলখানির পরের দিনের ঘটনা। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী রহমানের নাতনি দিয়া তার দাদু জয়ার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে। হঠাৎ তিনি নানা আলাপ-প্রলাপের মাঝে বলে বসেন ডায়েরির কথাটা। এ কথা শোনামাত্র দিয়া তন্ন তন্ন করে এ বাড়ির গুপ্ত ব্যক্ত সম্ভাব্য সবখানে খুঁজতে লাগল।

হ্যাঁ, তিন দিন খোঁজার পর পুরোনো জীর্ণ কাঠের আলমারির কাঁথার নিচে একটা পুরোনো দলিলপত্রের ফাইলের একেবারে নিচের দিকে পাওয়া গেল একটা ডায়েরি। সেটা পাওয়ামাত্র শোকাচ্ছন্ন এ পরিবারেও দেখা গেল আনন্দের ঝলকানি। হইচই শুনে পাড়াপড়শিদের অনেকেই এসে জড়ো হলো। সবাই উৎসুক চোখে চেয়ে আছে দিয়ার দিকে। বারান্দার সামনে কলাপসিবল গেটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নীরব চোখে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দিয়া ডায়েরিটা পড়ে শেষ করে। সবাই কান খাড়া করে চেয়ে আছে। দিয়ার মা রেবা মেয়েকে তাড়া দিয়ে বলেন, ‘মা, জোরে পড়ো। সবাই অপেক্ষা করছে।’
দিয়া কঠিন গলায় বলে-
পুকুরের ওই ভাস্কর্যটা কোথায়?
পড়শিদের একজন দুলাল, মাথা তুলে বলল-
ওইটা তো সোলেমান আর বশির মিলে ভাঙছে। হ্যামার দিয়ে ভেঙে টুকরা টুকরা করে রেলসড়কের খালে ফেলে দিয়েছে।

দিয়ার ধবধবে চোখ দুটো তখন কারও দিকেই নয়, দক্ষিণের একতলা ভবনটার ওপর দিয়ে দিগন্তের দিকে।
দিয়া আস্তে আস্তে বলে-
আমাদের সমস্যা এটাই যে হৃদয়ে লালন করা শিল্প-সুন্দর শখগুলো পূরণ করার মতো সৎসাহস অনেকেরই নেই। যদি কেউ তা পূরণ করতে চায়, তখন আমরা হিংসায় জ্বলে যাই।
সবাই চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ পর দিয়া বলে-

এই পুকুরে ঠিক এমনই একটা ভাস্কর্য আমি গড়ব। বাড়িতে এসে যতটুকু সময় পাব, দাদার ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ঠিক তাঁরই মতো চেয়ে থাকব ওই ভাস্কর্যের দিকে। আমার মনে হয় এ অঞ্চলের কেউ দাদার জীবনে ঘটে যাওয়া এ কাহিনি শোনার যোগ্যতা রাখে না।
*[email protected]