ভুলোমনা স্বামী

ফাইল ছবি

সকালে অফিসে বসে কাজ করছি। অফিসের ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে এক মেয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলল,
-এই, কী করো?
-কে আপনি? কাকে চাচ্ছেন?
-মানে কী! তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?
-জি না, আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।
-আচ্ছা বলতে পারো, তুমি এত গাধা কেন?
কথাটি শোনামাত্র মেজাজ গরম হয়ে গেল। রেগে গিয়ে ধমকের সুরে বললাম,
-এই মেয়ে, বেয়াদবি করছ কেন? থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব।
-মাই গড, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? তুমি কি আমার কণ্ঠস্বর শুনেও আমাকে চিনতে পারছ না!
-না, চিনতে পারছি না? কারণ, কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে পারার কৌশল আমার জানা নেই। আর তা ছাড়া এই দুনিয়ার সব মেয়ের কণ্ঠ আমার কাছে একই মনে হয়। সবারই সুরেলা কণ্ঠ।
এবার ওপাশের মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
-শোনেন, এভাবে হেসে কোনো লাভ হবে না। আপনি যতই রং ঢং করেন, আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারবেন না।
মেয়েটি একইভাবে হাসতে হাসতে বলল,
-কী বললা, আমি তোমাকে ফাঁদে ফেলতে চাচ্ছি! আচ্ছা তুমি কি জানো, তুমি দিনে দিনে একজন জোকারে পরিণত হচ্ছ।

-জি জানি। আমার স্ত্রীর ধারণাও তা–ই।
-সিরিয়াসলি তুমি আমাকে চিনতে পারছ না! শোনো, কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে না পারলেও আমার হাসি শুনে তো তোমার চিনতে পারার কথা, তাই না?
-না, পারার কথা না। কারণ, আমার কাছে কণ্ঠস্বরের মতো, সব মেয়ের হাসিও একই রকম লাগে। আচ্ছা এক কাজ করুন, কষ্ট করে আর একবার হাসুন। আমি এবার খেয়াল করে শুনব। দেখি চিনতে পারি কি না?
আমার কথা শোনামাত্র মেয়েটি আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে হাসিটা খেয়াল করলাম। হঠাৎ করেই এবার আমি চিনতে পারলাম। আমি আনন্দে চিৎকার করে বললাম,
-মাই গড, খালা তুমি! এখন কেমন আছ? তোমার চিকিৎসা কি শেষ? খালা শোনো, আমি কিন্তু একবার ভেবেছিলাম তোমাকে হাসপাতালে দেখতে যাব। কিন্তু মা যেতে মানা করল। মা বলল, তুমি নাকি কাছে গেলেই সবার মুখে থুতু দাও। আবার মাঝেমধ্যে নাকি কামড়ও দাও? খালা, কথা কি সত্যি?
-ওই, কে তোমার খালা!
-খালা শোনো, আর মজা নিয়ো না। আমি এত বোকা না। তোমার হাসি শুনেই আমি বুঝে ফেলেছি এটা আমাদের পাগলি খালা।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
-কী বললি! আমার হাসি শুনেই তুই বুঝেছিস আমি তোর পাগলি খালা? তার মানে আমার হাসি পাগলের মতন?
-খালা, তুমি রাগ করছ কেন? খালা শোনো, তোমার হাসি পাগলের মতো হলেও তুমি কিন্তু আমার প্রিয় খালা।
-হে আল্লাহ, এ আমি কারে বিয়ে করছি! এ ব্যাটা তো পুরাই অসুস্থ। না হলে এ পৃথিবীতে এমন কোনো স্বামী আছে, যে তার স্ত্রীর হাসি, কণ্ঠস্বর শুনেও তাকে চিনতে পারে না!
-ও মাই গড, এটা তুমি? আমি তো মনে করলাম...
-না না, তুই ঠিকই ধরেছিস। আমি তোর খালা। আমি তোর পাগলি খালা! যে সবাইকে থুতু দেয় আর কামড় দেয়। তুই আজ বাসায় আয়। তুই শুধু আজ বাসায় আয়। তোরে যদি আমি না কামড়াইছি, আর তোর মুখে যদি থুতু না দিছি, তাহলে আমার নাম তুই বদলায়ে রাখিস।

বলেই নিতু ফোন রেখে দিল। আমি ভয় পেয়ে মনে মনে আল্লাহকে বললাম, হে আল্লাহ, এটা কী হলো? আমি আমার স্ত্রীকে চিনতে পারলাম না!
শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বেশ কিছুদিন থেকে আমি এক জটিল সমস্যায় ভুগছি। মাঝেমধ্যেই অল্প সময়ের জন্য আমি অনেক কিছুই মনে করতে পারি না। আবার এমনও হয়, মাঝেমধ্যে অনেককেই, এমনকি পরিবারের মানুষকেও দেখে চিনতে পারি না। তবে বিয়ের আগে আমার এ ধরনের কোনো সমস্যা ছিল না। এই সমস্যা শুরু হয়েছে বিয়ের কিছুদিন পর থেকে। এত দিন এই সমস্যা একটু একটু করে বাড়ছিল। তবে এবার আমার করোনা হওয়ার পর এই সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। জটিল মানে খুবই জটিল।
আমার স্ত্রী ভুলে যাওয়ার বিষয়টি প্রথম থেকেই বিশ্বাস করে না। তার ধারণা, এটা আমার ফাঁকিবাজির একটা কৌশল। তবে স্ত্রী বিশ্বাস না করলেও ঘটনা সত্য। আমি খেয়াল করে দেখেছি, দিনের বেলায় যেমন–তেমন, সন্ধ্যার পরে এটি বেশি বাড়ে। এই যেমন গতকাল মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অনুভব করলাম প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্ত্রীকে ডেকে বললাম,
-এই শুনছ, খুব খিদে লেগেছে।
স্ত্রী চোখ না খুলেই ঝাড়ি মেরে বলল,
-চুপচাপ ঘুমাও।
-শোনো, রাতে তো আমি ভাত খাইনি, তাই খিদে লেগেছে। প্লিজ, একটু ভাত দাও না খাই।
আমার কথা শেষ হওয়ামাত্রই সে শোয়া থেকে উঠে বসল। কিছুক্ষণ আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ধমক দিয়ে বলল,
-তুমি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করো? এক ঘণ্টা আগে ঠিক এ কথা বলে তুমি আরও একবার ভাত খেয়েছ। আরেকবার যদি তুমি আমার ঘুম ভাঙায়ে ভাত খাওয়ার কথা বলেছ, তো তোমার খবর আছে।
বলেই নিতু আবারও শুয়ে পড়ল। নিতুর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তার মানে আমি এক ঘণ্টা আগে আরও একবার ভাত খেয়েছি। মাই গড, আমার অবস্থা তো আসলেই ভয়াবহ। এভাবে চলতে থাকলে তো আমার অবস্থা ‘গজনি’ সিনেমার আমির খানের মতো হয়ে যাবে।
সকালে নাশতা খাওয়ার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসতেই নিতু সামনে একটি ডায়েরি দিয়ে বলল,

ফাইল ছবি

-শোনো, যেহেতু তোমার মনে থাকে না, তাই এখন থেকে এই ডায়েরিতে সবকিছু লিখে রাখবে। যেমন: এখন লিখবে সকাল আটটায় পরোটা, ডিম আর ভাজি দিয়ে নাশতা করলাম। তারপর যখন দুপুরে ভাত খাবে, তখন সেটা লিখে রাখবে। ঠিক এভাবে যখন যা খাবে, তা লিখে রাখবে। এরপর মাঝরাতে খিদে লাগলে আগে ডায়েরি খুলে দেখবে, ভাত খেয়েছ কি না। শোনো, আজ মাঝরাতে আবার যদি আমারে ঘুম থেকে উঠায়ে ভাত চাও, তাহলে বুঝবা।
-আচ্ছা আর উঠাব না। আর শোনো, আমার ডায়েরি লিখতে হবে না। আমার সবকিছুই মনে থাকে। আসলে তোমাকে রাগাতে ভালো লাগে। তাই মাঝেমধ্যে তোমার সঙ্গে একটু মজা করি। শোনো, আমি কোনো কিছুই ভুলি না। চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারো।
-তাই! তুমি কোনো কিছু ভোলো না? আচ্ছা, আগামীকাল একটা বিশেষ দিন, সেটা কি তুমি বলতে পারবে?
দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম। দেখলাম আগামীকাল ৯ অক্টোবর। কিন্তু ৯ অক্টোবর কী কারণে বিশেষ, তা মনে করতে পারলাম না।
-চুপ করে আছ কেন? আমি জানি তোমার মনে নেই। শোনো, গত বছরও তুমি এ দিনটি ভুলে গিয়েছিলে, আমি কিছু বলিনি। তবে এ বছর যদি সত্যি ভুলে যাও, তাহলে তোমার খবর আছে।
-ভাই রে, এভাবে হুমকি দেওয়ার তো কোনো মানে নাই। এ দুনিয়ায় প্রতিদিন কত কিছুই তো ঘটে, সবই কি আমার মনে রাখতে হবে?
-আমি তো তোমাকে সবকিছু মনে রাখতে বলিনি। তোমার মতো মানুষের কাছে সেটা আমি আশাও করি না। কিন্তু তাই বলে তুমি আগামীকালের এই বিশেষ দিন ভুলে যাবে, সেটা তো আমি মানব না।
নিতু চিৎকার করে কথাগুলো বলে হনহন করে রুম থেকে চলে গেল।
পরদিন সকালে অফিসে কাজ করছিলাম। সে সময় নিতু সেলফোনে ফোন দিল। ফোন রিসিভ করতেই বলল,

ফাইল ছবি

-ল্যান্ডফোনে ফোন দিলে তো চিনতে পারবে না। ভাববে তোমার পাগলি খালা পাবনা থেকে আবার তোমাকে ফোন করেছে। তাই সেলফোনে ফোন দিলাম। নিশ্চয় এখন চিনতে পারছ?
-অবশ্যই পারছি। আরে তোমার ফোন নম্বর তো স্ত্রী লিখে সেভ করে রেখেছি। চাইলেও ভুলতে পারব না। হা হা হা…।
-শোনো, তোমার সঙ্গে ফান করার মতো সময় আমার নেই। আমি জরুরি একটা কথা বলতে ফোন করেছি। বাবা আজ আমার জন্য বাসায় পার্টি ডেকেছেন। আমি এখন বাবার বাসায় যাচ্ছি। তুমি অফিস থেকে সোজা ওখানে চলে এসো।
-তা না হয় গেলাম, কিন্তু উনি পার্টি ডেকেছেন কেন?
-কেন মানে! তোমাকে না গতকাল বললাম, আজ একটা বিশেষ দিন। তার মানে তুমি এখনো মনে করতে পারোনি আজ কী?
-না, সেটা পেরেছি। একটু আগে গুগলে সার্চ করে বের করে ফেলেছি।
-কী বললা! তুমি গুগলে সার্চ করে ৯ অক্টোবর দিনটি আমার জীবনে কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা বের করে ফেলেছ! তুমি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ?
-ফাজলামি করব কেন? আমি সিরিয়াস।
-তুমি সিরিয়াস? ঠিক আছে বলো শুনি আজকে কী?
নিতু টিটকারির সুরে বললেও আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলাম।
-আজ উগান্ডার স্বাধীনতা দিবস।
-আজ কী!
-আজ ৯ অক্টোবর, উগান্ডার স্বাধীনতা দিবস। দাঁড়াও তোমাকে উইশ করি। হ্যাপি উগান্ডার স্বাধীনতা দিবস টু ইউ।
-মাই গড, এ ব্যাটা বলে কী! এই ব্যাটার মাথা তো পুরাই গেছে! ওই বদমাশ, তোর ধারণা উগান্ডার স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের জন্য আমার বাবা বাসায় পার্টি ডেকেছেন? আমরা কি উগান্ডার নাগরিক?
-এটা অবশ্য আমিও একবার চিন্তা করেছিলাম। ওকে, নো প্রবলেম, উগান্ডার স্বাধীনতা দিবস বাদ। গুগলে অবশ্য আমি আরেকটি কারণও পেয়েছি। আমি শিওর, তাহলে ওটাই হবে।

ফাইল ছবি

-তুমি শিওর! কী সেটা?
-আজ হচ্ছে বিশ্ব পোস্টাল দিবস। কী, হয়েছে না? আমি জানতাম এটাই হবে। এনিওয়ে তোমাকে হ্যাপি পোস্টাল দিবস।
নিতু এ কথার কোনো উত্তর দিল না। চুপ করে রইল। আমি নিতুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললাম,
-আচ্ছা নিতু, একটা জিনিস কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না, তোমার পরিবারের কেউ তো পোস্ট অফিসে চাকরি করে না। তাহলে তোমরা বাবা, বিশ্ব পোস্টাল দিবসে বাসায় পার্টি ডেকেছে কেন?
-কারণ আমার পরিবারের সবার মাথায় সমস্যা আছে। তাই তারা পোস্টাল দিবসেও পার্টি করে?
-ও মাই গড, আসলেই তোমার পরিবারের সবার মাথায় সমস্যা আছে?
-তুই শুধু আজ বাসায় আয়। তোরে মুখে আজ আমি সত্যি সত্যি থুতু দেব।
বলেই নিতু ফোন রেখে দিল। আমি ভয়ে ভয়ে একটু পরে নিতুকে কল করলাম, কিন্তু সে আর ফোন ধরল না। তবে প্রায় ৩০ মিনিট পর একটা টেক্সট মেসেজ পাঠাল।
‘বদমাশ ব্যাটা, আজ শুধু উগান্ডার স্বাধীনতা দিবস আর বিশ্ব পোস্টাল দিবসই না; সেই সঙ্গে আজ আমার জন্মদিন। বাসায় আসার সময় বড় একটা কেক নিয়ে আসবে।’
শ্বশুরের বাসায় ঢুকেই বুঝলাম সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। জন্মদিনের এ অনুষ্ঠানে বেশ কিছু আত্মীয়স্বজনও উপস্থিত হয়েছেন। অনেকের চেহারাই চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু কে যে সম্পর্কে কী হবে, সেটা মনে করতে পারছি না।
আমি ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই একটি ছেলে সামনে এসে কেকের প্যাকেটটি নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। আমি অবাক হয়ে তাকে বললাম,
-আচ্ছা, আপনি কে? আপনাকে কেমন জানি চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
-দুলাভাই, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাকে যে আপনার চেনা চেনা মনে হচ্ছে, আমি তাতেই খুশি। শোনেন, আমি আপনার স্ত্রীর ছোট ভাই, মানে আপনার শ্যালক। আর ওই যে ওই কোনায় তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তারা আমার তিনটি বোন। বাঁয়ের জন আপনার স্ত্রী, মাঝের জন আপনার স্ত্রীর বড় বোন, আর ডানের জন আপনার শ্যালিকা। চিনতে পারছেন? আপনি চাইলে এই রুমে উপস্থিত বাকি সবার সঙ্গেও আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। দেব?

ফাইল ছবি

শ্যালকের টিটকারি গায়ে মাখলাম না। কারণ, শালারা তো দুলাভাইয়ের সঙ্গে একটু মজা করবেই। তবে আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে কেন আমি আমার শ্যালককে চিনতে পারলাম না। না, আর দেরি করা ঠিক হবে না। এবার ডাক্তার দেখাতেই হবে।
আমি স্ত্রীর সামনে গিয়ে তার জন্য কিনে আনা ফুলের তোড়াটা তার হাতে দিয়ে বললাম,
-শুভ জন্মদিন।
নিতু মিষ্টি করে হেসে ফুলগুলো হাতে নিল। নিতুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার শ্যালিকা আমাকে বলল,
-দুলাভাই, আপার কাছে শুনলাম, আপনি নাকি আপার জন্মদিন ভুলে গিয়েছিলেন?
আমি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে একটু হাসলাম। কারণ, এ মেয়ের সঙ্গে আমি পারতপক্ষে কথা বলি না। সে কিছুটা ক্রিমিনাল টাইপের মেয়ে। মানুষের মধ্যে ঝগড়া লাগানোয় সে খুবই দক্ষ। আমি চুপ করে আছি দেখে সে আবার বলল,
-দুলাভাই, এটা কিন্তু দুঃখজনক। আমি বুঝি না, আপনি কীভাবে স্ত্রীর জন্মদিন ভুলে গেলেন! স্ত্রীর জন্মদিন আর বিবাহবার্ষিকী পৃথিবীর কোনো স্বামীই কখনো ভোলে না। আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম। একজন বিখ্যাত মনোবিদ বলেছেন, যেসব স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত, তারা তাদের বিবাহবার্ষিকী, স্ত্রীর জন্মদিন—এসব ভুলে যায়। দুলাভাই, আমি শতভাগ শিওর, আপনি কারও সঙ্গে পরকীয়া করছেন। কী, ঠিক বলেছি না?
আমি অবাক হয়ে শ্যালিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর মনে মনে বললাম, চুপ থাক কুটনি। দুনিয়ার কোনো মনোবিদ এমন ফালতু কথা বলেনি। এটা তোর বানানো কথা। তুই আমারে বিপদে ফেলার জন্য এইমাত্র এইটা আবিষ্কার করলি।
-কী দুলাভাই, চুপ করে আছেন কেন?
-বোনরে, তোর আল্লাহর দোহাই লাগে, আমার চরিত্রে এভাবে দাগ ফেলিছ না। এমনিতেই স্মরণশক্তি নিয়ে আমি ভেজালের মধ্যে আছি। তার ওপর আবার পরকীয়ার ভেজাল মাথায় চাপায়ে দিস না। আমি মাথায় এত লোড নিতে পারব না।
এরপর নিতুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

-নিতু, তুমি এই শয়তানটার কথায় কান দিয়ো না। ও হচ্ছে বাংলা সিনেমার নারী ভিলেন। ওর সুযোগ থাকলে বাংলার প্রতিটা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ও ভেজাল লাগায়ে দিত।
আমার কথা শুনে নিতু কিছুই বলল না। তবে নিতুর চেহারা দেখে মনে হলো, আমার শ্যালিকার পরকীয়া তত্ত্ব তার মনে ধরেছে। আমি শিওর, বাসায় গিয়ে সে এটি নিয়ে একটা বড় যুদ্ধ বাধাবে।
শ্যালক আমার আনা কেকটি ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে কাটার জন্য রেডি করল। কেক কাটার সময় আমি নিতুর পাশে দাঁড়ালাম। বাকি সবাই আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। নিতু ছুরি দিয়ে কেক কাটতে যাবে, ঠিক তখনই আমার শ্যালিকা চিৎকার করে উঠল,
-মাই গড, আপা দেখ, দুলাভাই কেকের ওপর কী লিখে আনছে!
শ্যালিকার কথা শুনে উপস্থিত সবাই কেকের লেখার দিকে তাকাল। কেকের ওপর লেখা,
‘শুভ জন্মদিন তমা।’
এবার কেকের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে উপস্থিত সবাই আমার দিকে তাকাল। রুমের সবাই চুপ। কারও মুখে কোনো কথা নেই। রুমের সবাই চুপ থাকলেও শ্যালিকা আমাকে প্রশ্ন করল,
-দুলাভাই, এই তমাটা কে?
বুঝলাম আগুন ভালোভাবেই লাগছে। এ মেয়ে আজ আমারে ডিভোর্স করায়ে ছাড়বে। নিজের মাথার চুল নিজেরই এখন ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। না হলে কেউ বউয়ের নাম ভুল করে? আমি স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে আমতা–আমতা করে বললাম,
-নিতু শোনো, তমা নামের কাউকে আমি চিনি না। এটা ভুলে করে লেখা হয়েছে।
নিতু ভুরু কুঁচকে আমাকে বলল,
-তুমি তমা নামের কাউকে চেনো না!
-না চিনি না। কেন তুমি চেনো?
-বদমাশ বেটা, তমা তোমার খালাতো বোনের নাম।
-তাই নাকি! তুমি শিওর?

ফাইল ছবি

-খবরদার নাটক করবে না। তমা শুধু তোমার খালাতো বোনই না, তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়ারও কথা ছিল। তুমি আমার জন্মদিন ভুলে যাও, আমার নাম ভুলে যাও। অথচ তমার নাম তোমার ঠিকই মনে থাকে। পুরোনো প্রেম ভুলতে পারো না, তাই না? শোনো, তোমার মতো চরিত্রহীনের সঙ্গে আমি আর নাই। এনাফ ইজ এনাফ।
-বিশ্বাস করো, তমা নামের একটি খালাতো বোন যে আমার আছে, সেটাই তো আমার মনে নেই। দোকানদার যখন জিজ্ঞেস করল কী নাম লিখবে, তখন কিছুতেই তোমার নাম মনে করতে পারছিলাম না। কেন জানি তখন হঠাৎ করে মনে হলো তোমার নাম তমা। তুমি তো জানো, ইদানীং আমি অনেক কিছুই মনে করতে পারি না।
-দুলাভাই, এসব ফালতু এক্সকিউজ দেবেন না। আজ আপনি স্ত্রীর নাম ভুলে প্রেমিকার নাম লিখেছেন। কে জানে কাল হয়তো আপনি অন্য কোনো মেয়েকে নিজের বউ মনে করে ঘরে নিয়ে আসবেন।
ইচ্ছা হচ্ছে শ্যালিকার মাথায় বাঁশ দিয়ে একটা বাড়ি দিই। কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু করা যায় না। তাই মাথা ঠান্ডা রেখে নরম করে বললাম,
-আরে না, এতটা ভুলো মন আমার না। নাম ভুলে গেছি তাই বলে কি চেহারা ভুলে যাব?
আমার কথা শেষ হওয়ামাত্র নিতু সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-শোনো, এসব কথা বলে কোনো লাভ নাই। আমি তোমার সঙ্গে আর নাই। তোমার মতো অসুস্থ মানুষের সঙ্গে আমি আর সংসার করব না।
রুমে উপস্থিত সবাই আমাদের ঝগড়া দেখছে। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। আসলে তারা কেউ আমাদের সমস্যায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছে না। আমি বুঝলাম নিতুকে আজ বোঝানো যাবে না। আসলে ওর রাগ করাটাই তো স্বাভাবিক। স্ত্রীর জন্মদিন ভুলে যাওয়া, স্ত্রীর নামের জায়গায় খালাতো বোনের নাম লিখে আনা, এসব তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। সিদ্ধান্ত নিলাম শ্বশুরকে ধরব। কারণ, নিতু তার বাবার কথা কখনো অমান্য করে না। আমি আমার শ্বশুরের সামনে গিয়ে ওনার হাত ধরে বললাম,
-আব্বা, আপনি নিতুকে একটু বোঝান। বিশ্বাস করেন, বেশ কিছুদিন ধরে অফিসে কাজের খুবই প্রেশার। যার কারণে মাথাটা উল্টো-পাল্টা হয়ে আছে। তার ওপর আজ অফিস শেষে তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে ভুলে কেকের ওপর নিতুর জায়গায় তমার নাম লিখে এনেছি। আব্বা বিশ্বাস করেন, আমার মাথায় কোনো সমস্যা নাই। আমি পুরোপুরি সুস্থ।

হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, রুমের সবাই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এমনকি আমার শ্বশুরও ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। নিতু হঠাৎ করেই কান্না শুরু করল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-এই ব্যাটা পুরা পাগল হয়ে গেছে।
-নিতু, তুমি কান্না করছ কেন? বললাম তো এমন ভুল আর হবে না। আমার ব্রেন এখন একদম ঠান্ডা। আমি এখন সবাইকে চিনতে পারছি।
নিতু কান্না করতে করতে বলল,
-তোর ব্রেনের গুষ্টি কিলাই। বদমাশ ব্যাটা, তুই বাইর হ বাসা থেকে।
আমি আবার আমার শ্বশুরকে বললাম,
-আব্বা আপনি কিছু বলেন। দেখেন, ও রেগে গিয়ে কীভাবে সবার সামনে আমাকে তুই–তুকারি করছে।
এবার আমার শ্বশুর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
-তুমি আমার হাত ছাড়ো। আর খবরদার, আমাকে আব্বা ডাকবে না।
-আব্বা, আপনিও রাগ করলেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার সমস্যাটা বুঝবেন।
-শোনো, তোমাকে আমি একবার বলেছি, আমাকে আব্বা ডাকবে না।
-কেন ডাকব না?
-কারণ, আমি তোমার শ্বশুর না।
-আব্বা, কেন আমার সঙ্গে মজা করছেন? আমি শিওর, আপনিই আমার শ্বশুর। এই যে আপনার মুখে দাড়ি।
-এই গাধার গাধা, কারও মুখে দাড়ি থাকার মানে এই নয় যে সে তোমার শ্বশুর।
-তাহলে আপনি কে?
-আমি নিতুর দুলাভাই। ভাই শোনো, তোমার আল্লাহর দোহাই লাগে, তুমি দ্রুত একজন ডাক্তার দেখাও। না হলে তুমি এই পরিবারের সবার মধ্যে সম্পর্কের প্যাঁচ লাগায়ে দেবে। কারে যে কখন তুমি কী বানাবে, আল্লাহ মালুম।

ফাইল ছবি

আমি ওনার কথা শুনে হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়লাম। তাকিয়ে দেখলাম, রুমের সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আর নিতুর চোখ থেকে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে। নিতুর কান্না দেখে খুব কষ্ট লাগল। মনে মনে বললাম, নিতু, তুমি কাঁদছ কেন? তোমার এই কান্না কি কষ্টের, নাকি রাগের? নাকি লজ্জার? যে লজ্জা এই মাত্র আমি সবার সামনে তোমাকে দিলাম। বিশ্বাস করো, আমি কিন্তু এগুলো ইচ্ছা করে করি না।
নিতুকে আর অনুরোধ করার সাহস হলো না। কেন জানি হঠাৎ করেই নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। নিতুর মুখের দিকে আর একবার তাকিয়ে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে বের হয়েই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটি মুছলাম। কেন জানি এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে না। চোখ দুটোকে বললাম, একটু চেপে রাখ। আগে বাসায় চল, তারপর প্রাণভরে কাঁদিস।
বি. দ্র.:
আলঝেইমার রোগ হলো ডিমেনশিয়ার একটি সাধারণ রূপ। এই রোগ হলে মানুষ অনেক সময় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকেও চিনতে পারে না। এ রোগে ওষুধের পাশাপাশি রোগীর প্রয়োজন সেবা, পরিচর্যা আর ভালোবাসা।

*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
[email protected]