মায়ের মন

৩ মাস ১৫ দিন বয়সের তাহিমকে নিয়ে যেদিন ওমানের মাটিতে পা দিলাম, মাসকাট শহরে তখন কনকনে শীত। পুরো শহরটাই পাহাড়ে ঘেরা। আমাদের থাকার জন্য অফিস থেকে বরাদ্দ বাড়িটিও একদম পাহাড়ের গা ঘেঁষে। পুরো বাড়িটিতে অনেকগুলো পরিবারের বাস, তাদের প্রায় সবাই ভারতীয়। প্রতিদিন বিকেলে তাহিমকে নিয়ে হাঁটতে বের হই, ওমানি বাচ্চাগুলো হইহই করে ছুটে আসে তাহিমের কাছে। তাহিম ওদের দেখে হাসে, তাতেই ওরা ভীষণ খুশি।

এমন করেই বেশ কয়েক দিন কেটে গেল কিন্তু ‘ওয়াদি আল কাবির’ এলাকায় কোনো বাংলাদেশি পরিবার চোখে পড়ল না। একাকিত্ব চেপে ধরল ভীষণভাবে। পাকিস্তানি ও ভারতীয় মায়েরা মাঝেমধ্যেই বাচ্চাদের নিয়ে বিকেলে বাইরে আসেন। তাঁদের সঙ্গে টুকটাক কথা হয়, তাঁদের মুখে শুনতে শুনতে ভারত ও পাকিস্তানের সমসাময়িক প্রায় সব খবর আমার জানা, শুধু মনের মধ্যে হাহাকার বাংলাদেশি কারও সঙ্গেই দেখা হয় না, কী আশ্চর্য! প্রায় মাসখানেক পার হয়ে গেছে, একদিন তাহিমের কান্নায় অস্থির হয়ে ওকে নিয়ে বাইরে বের হলাম, ওকে নিয়ে হাঁটছি আর ওমানি বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখছি। হঠাৎ দেখলাম দূর থেকে ২৫–২৬ বছরের বাংলাদেশি একটি মেয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে, আনন্দে তার চোখের তারা ঝিলমিল করছে। তার প্রথম কথা, ‘যাক আপা, এত দিনে একজন বাংলাদেশি মানুষ পাওয়া গেল!’ কথায় কথায় জানতে পারলাম, সে ওখানে একটি ওমানি পরিবারে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এক বৃদ্ধর দেখাশোনার চাকরি করে। ওমানি পরিবারটি ভালো, মেয়েটির সঙ্গে তারা ভালো ব্যবহার করে বলেই জানাল। সেই সঙ্গে মন খারাপ করে জানাল, ‘আপা আপনিও আসলেন, আর আমিও দুই বছর পর সামনের মাসে ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি’, তার আনন্দিত মুখ দেখে নিজের মনটাও ভালো হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, বাড়িতে কে কে আছেন? সে জানাল বাবা, মা আর তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে, যাকে তিন বছর বয়সে মার কাছে রেখে কাজে এসেছে, দুই বছর হলো ছেলেকে সে দেখে না, বলেই ডুকরে কেঁদে উঠল।

মাঝে বেশ কয়েক দিন দেখা নেই ইয়াসমিনের। হঠাৎ একদিন বেশ কিছু প্যাকেট হাতে আমার বারান্দার দরজায় টোকা দিল, বলল আপা আমার ছেলের জন্য কিছু জিনিস আছে এতে; মনিবের বাসায় রাখা নিষেধ, তাই আপনার কাছে রেখে গেলাম। পরে এসে নিয়ে যাব। এভাবে ইয়াসমিনের দেশে যাওয়ার দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, অসংখ্য জিনিস জমতে থাকল আমার বাসায়, যার বেশির ভাগই খাদ্যদ্রব্য। কী নেই তার ভেতর—বিস্কুট, চকলেট, পাউরুটি সব আছে। শত বলেও বোঝানো গেল না, সামনের মাস আসতে আসতে পাউরুটি, জুস এসব নষ্ট হয়ে যাবে। মায়ের মন বলে কথা—যা দেখে তাই ছেলের জন্য নিতে ইচ্ছা হয়। একদিন বলে, ‘আপা এ দেশ থেকে বিরিয়ানি কীভাবে নিব? ছেলে খেতে চায়, বিদেশের বিরিয়ানির গল্প শুনেছে অনেক, তাই মার কাছে বিরিয়ানি খাওয়ার বায়না।’

দেখতে দেখতেই ইয়াসমিনের দেশে যাওয়ার দিন এসে গেল। সকাল সকাল আমার বাসায় এসে তার সব জিনিস সে নিয়ে গেল। এসব বিশাল লাগেজেও আটবে কি না, আমি চিন্তিত হলাম। হাতে ছেলের জন্য দোকান থেকে কেনা অ্যারাবিক বিরিয়ানির প্যাকেট। অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলাম, সুস্থভাবে সে যেন শিশুটির কাছে পৌঁছাতে পারে। দুই বছর পর মা, ছেলের দেখা হবে, কী অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য! আমি দূর থেকে কল্পনায় মা, ছেলের সেই মধুর মিলন দেখতে পেলাম।