মায়ের শেষ বিদায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দীর্ঘ ক্লান্তির পথ পাড়ি দিয়ে আমি যখন মায়ের কাছে ফিরে আসি, মা তখন নিশ্চিন্ত ঘুমে। আমি ধীরপায়ে এসে মায়ের শিয়রে দাঁড়ালাম। কী শান্ত ঘুমে আছেন উনি!
এই ঘুমের মধ্যে হাসিমুখে আছেন। মায়ের এক হাত চেপে ধরে বললাম, ‘আম্মা, তুমি শুনছ! আমি এসেছি। শেষবার আমাকে দেখার জন্য তোমার অস্থিরতা শুনে আমি এত এত দূর থেকে ছুটে এসেছি। একবার চোখ খুলে তাকাও আম্মা।’

আম্মা নিরুত্তর।
আম্মার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কত জনমভর এ না দেখার আফসোস নিয়ে থাকতে হবে। কেউ একজন আমার পাশে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ধৈর্য ধরো। কারও মা–বাবা চিরদিন থাকে না।’

আমার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ল। এ জল আমি মুছে দিলাম না। পড়ুক জল। আম্মার জন্য এটুকু জল ঝরে পড়ুক।

হাসপাতালে বিল মিটিয়ে আম্মাকে নিয়ে ছুটে চললাম, যেখানে ৩০টা বছর সংসার করে গেছেন। যেখানে আমাদের লালন–পালনে নিজের আরাম–আয়েশ ভুলে ছিলেন। দূরের পথ পাড়ি দিয়ে আম্মাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

গোসল করিয়ে শুভ্র কাপড় পরিয়ে আম্মাকে শেষবার ওনার রুমে রাখা হলো কিছুক্ষণের জন্য। ঘরের ভেতর নীরবতা। যেন আম্মার মৃত্যুতে সবকিছু নীরব–নিথর হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে হু হু বাতাস এসে জানান দিচ্ছে, আজ সবাই শোকে পাথর। এ ঘরে গোটা জীবন আম্মা কাটিয়ে দিয়েছেন। আব্বার সঙ্গে বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত উনি এই ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও থাকেননি। আজ আম্মাকে তাঁর প্রিয় ঘর থেকেই বিদায় নিয়ে যেতে হচ্ছে।

আমি মনে মনে বলি..
‘আম্মা, এ ঘর, এ বাড়ি, এই আমাদের ছেড়ে যেতে কি খুব কষ্ট হচ্ছে? এ–ও সুখ যে তুমি আব্বার সঙ্গী হয়ে যাবে এখন। নিশ্চয় আমাদের দূর থেকে দেখে সব সময় দোয়া করবে।’

আমি আস্তে আস্তে আম্মার খাটিয়ার পাশে দাঁড়ালাম। শুভ্র কাপড়ের অগ্রভাগে আম্মার মুখখানা শেষবার দেখলাম। আস্তে করে কপালে চুমু খেয়ে আম্মার খাটিয়ার এক প্রান্ত কাঁধে তুলে নিলাম।

আম্মাকে নিয়ে ছুটে চলছি আসল চিরসত্যের ঘরে, যেখানে আলো–বাতাস নেই। অন্ধকার একটা ঘরে আম্মাকে নিয়ে রাখার আয়োজন প্রায় শেষের পথে।
জানি ছোটবেলার মতো আম্মার হাত ধরে আবার ফিরে আসব না। এ যাওয়া শেষ যাওয়া। আমাকে একা ফিরে আসতে হবে আম্মা–ছাড়া শূন্য ঘরে।

আমার কাঁধে কত শান্তির ঘুমে আম্মা। হিমশীতল অনেকটা জড় পদার্থের মতো শুয়ে আছেন। এত অল্প বয়সে যেতে চাননি, তবু কষ্টকর এ যাত্রায় যেতে হচ্ছে। কত কষ্টমাখা জীবনকে থেমে যেতে হয়েছে নিয়ম মেনে। বড্ড তাড়াতাড়ি হয়ে গেল এই নিয়ম মানা।
সব ছেড়ে আম্মাকে চলে যেতে হচ্ছে। এ যাওয়াই সত্য।

আম্মাকে কবরে শুইয়ে দিলাম। শেষবার পাশে দাঁড়িয়ে কবর ঢেকে দিলাম লাল মাটিতে। হাত তুলে মোনাজাত করলাম, যেন নতুন জীবনে আর কষ্ট পেতে না হয়।
ফিরে এলাম আম্মার ঘরে। আত্মীয়স্বজনের তাড়াহুড়া, ফিরে যাবেন যে যাঁর জায়গায়।

কত দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা সবার। অথচ আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, আম্মা নেই। নেই মানে নেই। কোথাও নেই। এ বাড়ি, এ ঘর, এ ধরাতলে কোথাও নেই।
কত সহজে একটা ৫০ বছরের অধ্যায় শেষ হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, আমরা কেউ ভাবিনি। গত পরশু পর্যন্ত দিব্যি সুস্থ ছিলেন। মৃত্যুর তিন দিন আগেও গাছ লাগিয়েছেন নিজের আবাসস্থলে। অথচ আজ তিনি শান্তিতে শুয়ে আছেন গাছের শীতল ছায়ায়।

চলেই গেলেন সব মায়া–মমতা ছেড়ে। এ যাওয়া স্বাভাবিক। স্বজনেরা চলে যাওয়ার আগে তাড়া দিলেন। কী কী মেনু হবে আম্মার চলে যাওয়ার চার দিনে। কতশত হিসাব–নিকাশ হয়ে গেল। আমি কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে গেলাম।

কেউ বুঝতে চাইলেন না, আম্মা একেবারে যাননি। এ ঘরের, এ বাড়ির প্রতিটি জায়গায় আম্মার স্পর্শ লেগে আছে। কেউ বুঝতে চাইলেন না, আম্মা তাঁর নিজ হাতে গড়া রান্নাঘরে বসে আমার ফিরে আসার আনন্দে নানা রকমের পিঠা আর রান্না করবেন না।
কেউ বুঝতে চাইলেন না, আমার পছন্দ করা খাবার, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মানুষটি আর থাকলেন না।

সবাই সবকিছু স্বাভাবিক মেনে নিচ্ছেন। আমি তো তা–ও পারছি না।
কেউ বুঝতে চাইলেন না, গোটা একটা একান্নবর্তী পরিবার, শ্বশুরকুল—সব সামলাতে সামলাতে জীবনটা নিমেষেই চলে গেল। চার–চারটা ভাইবোন মানুষ করতে করতে একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল।

কেউ কেন ভাবছেন না, একজন মা সারা জীবন দিতে দিতে একেবারে শূন্য হাতে চলে গেলেন।
এই ছোট্ট জীবনে আম্মার কী পাওনা ছিল।

ছোট্ট একটা ছাদ, একটা শূন্য আকাশ, মা ডাক, একটা বিছানা আর সংসার নামক কিছু একটা।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অশ্রুসজল বড় আপার দিকে তাকালাম। আমার দিকে তাঁর কী অসহায় চাহনি। যেন বুকের ভেতরটা ছিঁড়েফুঁড়ে কান্না আসছে।
দুই দিন পর আপাও হয়তো চলে যাবেন মায়ের মতো শূন্য হাতে।

আচ্ছা, প্রত্যেক মেয়েই তো সংসারধর্ম পালন করতে গিয়ে নিজেদের আরাম–আয়েশ ভুলে যান।
কজন আর তা বুঝতে পারি।

কারও ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলাম। মাগরিবের আজান হচ্ছে। নামাজ পড়ে আম্মার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ।

আম্মা নিশ্চয় আমাকে দেখে খুব খুশি হচ্ছেন। বাবার সঙ্গে নিশ্চয় অনেক গল্প করছেন। আমাকে দেখিয়ে হয়তো বলছেন, দেখো, ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে, দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে।

তা–ই তো, আমি কবেই দায়িত্ব নিতে শিখে গেছি।

আম্মাকে দেখে আমি বাড়ি ফিরছি মেঠো পথ ধরে বিষণ্ন মনে। পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে জেমসের করুণ সুর...
‘ওরে তারা রাতের তারা মাকে জানিয়ে দিস,
অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারি না।’