মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি যাওয়ার স্মৃতি

ছোটবেলা মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি যাওয়ার শখ কার না হয়। মামার বাড়ি যাওয়ার আনন্দই থাকে ভিন্ন। তবে যতটা মনে পড়ে আমাদের বাড়ির কিছু নিয়ম কানুনের কারণে বা ঘনঘন বাড়িতে দেশি-বিদেশি অতিথিদের আগমনের কারণে বাড়ির মধ্যে সব সময় ব্যস্ততা লেগেই থাকত। তা ছাড়া জমিদারি প্রথার সঙ্গে আমাদের বাড়ির কিছু সংশ্লিষ্টতার কারণে তালুকের জমি প্রাপ্তি ঘটেছিল অনেক। এ জমির পরিমাণ একেবারেই কম ছিল না। এস ব দেখভাল করার জন্য বাড়িতে কাজের লোক সব সময় দু-চারজন থাকতই। পাশাপাশি বাড়িতে গরু পোষার কারণে আলাদা লোক রাখা হতো বাড়িতে। যতটা মনে পড়ে এসব কারণে চাইলেই মা তার নিজের বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি খুব একটা যাওয়ার সুযোগ পেত না। তবে একবারেই যে যেত না তা নয়। কালে ভদ্রে মা তার বাপের বাড়ি যেত হয়তো। আর যখনই যেতো তখন মায়ের সঙ্গে আমার ইমিডিয়েট বড় এবং ছোট বোন থাকত। আমি তো থাকতামই।

আমাদের বাড়ি থেকে মামার বাড়ির দূরত্ব পায়ে হেঁটে প্রায় এক ঘণ্টার পথ। মনে পড়ে একবার, মা আমাদের বেশ কিছুদিন আগে থেকে মামার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রেখেছিলেন। মায়ের সেই ঘোষণা শুনে আমরা তো কত আনন্দে সেই দিনের অপেক্ষা করছিলাম। বাবার স্বভাব ছিল এক মনে মাকে যাওয়ার অনুমোদন দিয়ে আরেক মনে বাধা দিতেন। এসব মেনটেইন করে যাওয়াটা মায়ের জন্য বেশ কষ্টেরই ছিল।

নির্ধারিত দিনে মাসহ আমরা রওনা দিলাম মামার বাড়ির উদ্দেশে। যতটা মনে পড়ে, বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কিছু সময় পর থেকে মর্জি করতে শুরু করি আমাকে কোলে নেওয়ার জন্য। ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাওয়ার রেললাইন। সেই রেললাইন অতিক্রম করতেই মনে হতো, এই বুঝি মামার বাড়ি চলে এসেছি। মর্জি করলে মা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, আরেকটু সামনে গেলেই মামার বাড়ির তাল গাছ দেখা যাবে। সেই তালগাছ দেখার আশায় আবার শক্তি যুগিয়ে হাঁটতে শুরু করতাম। কিন্তু তাল গাছ যেন আর আসে না।

রেললাইন পেরোনোর সময় পূর্ব-পশ্চিম দুপাশ ভালো করে দেখে নিতাম ট্রেন আসছে কি না। যখন দেখতাম কোনো ট্রেন দেখা যাচ্ছে না তখন রেললাইনের ওপর বসে পড়তাম বা লাইনের ওপর ছড়িয়ে রাখা পাথর থেকে খুঁজে ছোট আকৃতির পাথর নিয়ে নিতাম মামার বাড়িতে গিয়ে মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে পাঁচ গুটি খেলার জন্য।

মামার বাড়ির খুব কাছাকাছি গিয়ে যখন বাড়ির সেই অতি চেনা রাস্তা দেখে বাড়ির নিশানা ধরতে পারতাম তখন মাকে ফেলে রেখেই দৌড়ে যেতাম মামার বাড়ির দিকে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন গ্রীষ্মকাল। আমগাছে আম ধরেছে। নিজেদের বাড়ির গাছের আম যেখানে মানুষে খেত সেখানে মামার বাড়ির আম গাছের আমের প্রতি লোভ ততটা ছিলই না বলা যায়। তারপরেও মামাতো ভাইবোনরা গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে ভর্তা বানিয়ে খাইয়েছিল। এই আম পাড়ার কারণে মামি আমাদের সবাইকে বেশ বকাঝকা করেছিল।

সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে আসার সময় মামা বাড়ি থেকে আমার ছোট বোন শেলি আর আমি বিদেশি পুতুল নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। (মামা তখন ঢাকা বিদেশিদের বাসায় কাজ করতেন তাই তিনি বিদেশিদের বাসা থেকে সেই পুতুল নিয়েছিলেন মামাতো ভাই-বোনদের খেলার জন্য)। মামার বাড়িতে যতবার বেড়াতে গিয়েছি তার মধ্যে মামার বাড়ি থেকে আমার সেই পুতুল আনার আনন্দর কথাটাই মনে রয়েছে বেশি। সেদিন মনে হয় পুতুল বহন করে নিয়ে আসার আনন্দে রেললাইন পর্যন্ত কোলে ওঠার আর কোনো মর্জি করিনি।

সেদিন ফিরে আসার সময় রেললাইনে এসে আবার অনেকগুলো পাথর নিয়ে বাড়ি এসেছিলাম সেই পাথর দিয়ে পাচগুটি খেলার জন্য। এ ছাড়া মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি যাওয়ার তেমন আর কোনো স্মৃতি মনে পড়ে না। মা মারা যাওয়ার আগে (ফেব্রুয়ারি ২০২০) কয়েক মাস আগে মাকে রিকশায় নিয়ে গিয়েছিলাম সেই মামার বাড়ি ঘুরতে। এ ছাড়া মামার বাড়ি যাওয়ার খুব বেশি কোনো স্মৃতি আমার মনে পড়ে না।

(মাকে নিয়ে শেষবার মামার বাড়ি যাওয়ার স্মৃতি মাকে নিয়ে আমার স্মৃতিচারণার শেষ দিকটাতে উল্লেখ করব আশা করছি।) চলবে...