যোগ্য তরুণসমাজ পেতে করণীয়-বর্জনীয়

প্রতীকী ছবি

বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। এখন সেই ফল খেতে কেমন বা তার গুণাগুণ কেমন, তা নির্ভর করছে যে বা যারা এই ফল খাবে, তাদের ওপর। গাছের কৃতিত্ব খুব কমই শুনেছি জীবনে। তবে ফলের প্রশংসা শুনেছি অনেক। এটা প্রকৃতির একটি বিশেষ নিয়ম।

শিক্ষা ঠিক তেমনই একটি বিষয়, যার মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ—এমনকি মহাদেশের গুণাগুণ ফুটে ওঠে। মনে পড়ে গেল ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। তিনি ছিলেন বাঙালি এবং অবিভক্ত ভারতবাসী। বাংলা ভাষায় তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে এবং নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে। শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয়েছিলেন একজন ব্যক্তি, একটি ভাষা, একটি জাতি, একটি দেশ এবং একটি উপমহাদেশ।

মানবজাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো, প্রত্যেকেই তাঁর নিজ ব্যক্তিত্বে অসাধারণ। একটু সাহায্য ও সহানুভূতি পেলে তাঁরা তাঁদের মেধার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম। তবে তার জন্য দরকার ব্যক্তির আগ্রহ এবং চেষ্টা। এখন যদি সেই চেষ্টাই না থাকে, তাহলে হবে না কিছু করা। এখন প্রশ্ন, কীভাবে নিজেকে বিক্রি করা সম্ভব? আমার ভাবনা থেকে কিছু তথ্য এখানে শেয়ার করছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু লেখালেখি করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর লেখাকে ইংরেজদের সাহায্যে অনুবাদ করেন। পরবর্তী সময়ে ‘গীতাঞ্জলি’র ওপর নোবেল পুরস্কার এবং বিশ্বদরবারে তাঁকে বিশ্বকবি হিসেবে বিক্রি করেন। আমরা নিজেরাও কিন্তু প্রতিদিন আমাদের বিক্রি করতে চেষ্টা করছি জানা বা অজানা অবস্থায়। এখন বিক্রি করতে গিয়ে যেন ভারসাম্য হারিয়ে না ফেলি, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

যেমন বাংলাদেশে ৩০ বছর বয়সসীমা পার হলে সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা যাবে না, এটা একটি ভুল সিদ্ধান্ত। ইট ডাজেন্ট মেক অ্যানি সেন্স। গোটা বিশ্বের মূল্যবান সম্পদ মানবজাতি দুই বছর ধরে করোনা প্যান্ডামিকের কারণে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে। দরিদ্র দেশের তরুণসমাজ সঠিক দিকনির্দেশনা ও কর্মসূচির অভাবে আত্মবিশ্বাস হারাতে বসেছে। অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, যদি তারা সরকারি কাজে অংশগ্রহণ করতে না পারে তাহলে তাদের বিশ্বাস, কর্মযজ্ঞ অম্লান হয়ে থাকবে। একটি বেকারত্বকে কেন্দ্র করে কিন্তু অনেক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। যেমন একটি বেকার ছেলে দীর্ঘদিন বেকার থাকতে থাকতে তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা চলে আসে।

পরিবার থেকে তার ওপর এক প্রকার মৌন নির্যাতন চলে। ফলে দিশেহারা হয়ে আসক্ত হয় মাদকে, জড়িত হয় রাজনীতি ও দুর্নীতিতে। ফলে একটি পরিবার হারায় একটি সন্তানকে, একটি দেশ হারায় একজন যুবককে। একটি যুবকের বিকৃত মানসিকতা কলুষিত করবে সমাজকে। এর প্রতিকার যে শুধু চাকরির বয়স বৃদ্ধি করলেই হবে তা নয়, দেশের জন্যও ভালো হবে না যদি কাজের ব্যবস্থা না করা হয়। শুধু চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে বরং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ওপর নজর দেওয়া হোক।

চাকরিতে মেয়াদ নির্ধারিত শুধু সেখানেই প্রয়োজন, যেখানে শারীরিক দক্ষতা দরকার একটি সুনির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে। বাকি সব ক্ষেত্রে বয়সের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে বরং দক্ষতার দিকে নজর দিতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেমন সুইডেনে ৬৫ বছর পর্যন্ত যে কেউ যেকোনো কাজে যোগ দিতে পারেন যোগ্যতা অনুসারে। সেটা সরকারি বা বেসরকারি বলে কথা নেই।

এখন যদি শিক্ষার আলো বিবেককে সঠিক পথে পরিচালিত করতে না পারে, তখন বিবেক ভালো-মন্দের পার্থক্য হারিয়ে ফেলবে। হারিয়ে ফেলবে তার ভারসাম্য। তখন মানবজাতি দানবে পরিণত হবে। কারণ, শিক্ষা যখন আলোময় না হয়ে অন্ধকারের রূপ ধারণ করে, তখন তা আর সুশিক্ষা দিতে পারে না, দেয় কুশিক্ষা। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আজ তুলে ধরব বেচাকেনার ওপর জীবনের অভিজ্ঞতা। তার আগে জেনে নিই একজন গুণী লোকের কিছু মূল্যবান তথ্য। ওয়ারেন অ্যাডওয়ার্ড বাফেট একজন মার্কিন ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী এবং জনহিতৈষী ব্যক্তি। জীবনে সফলতা পেতে ওয়ারেন বাফেটের অসাধারণ কিছু পরামর্শ রয়েছে। যেমন ‘সততা খুবই দামি একটি উপহার, তা কখনোই সস্তা লোকের নিকট থেকে আশা করা ঠিক হবে না। কখনোই সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা উচিত নয়। পা পানিতে ডুবিয়ে কখনোই নদীর গভীরতা মাপা ঠিক নয়। যা প্রয়োজন নেই, তা ক্রয় করলে শিগগির যা প্রয়োজন, তা বিক্রি করতে হবে। কখনোই আয়ের একমাত্র উৎসের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। বিনিয়োগের মাধ্যমে আরেকটি উৎস তৈরি করা ভালো এবং খরচের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা সঞ্চয় না করে বরং সঞ্চয়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা খরচ করা শিখো।’

শেয়ারবাজার এমন একটি ব্যবসা, যেখানে নানা মত রয়েছে। ধর্মীয় দিক দিয়ে অনেকে অনেক রকম ধারণা দিয়ে থাকেন। আমার মত বা দ্বিমত নিয়ে আলোচনা করতে এ লেখা নয়। মূলত বর্তমান বিশ্বের সবকিছুই শেয়ারবাজারে বেচাকেনা হচ্ছে। যা ভালো, তার চাহিদা যেমন বেশি, বেচাকেনাও হচ্ছে ভালো। যার কারণে কোটি কোটি লোক বিনিয়োগ করছে প্রতিদিন তাদের পুঁজি।

আজ লাঞ্চ মিটিংয়ে অধ্যাপক ড. মান্নান মৃধার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেহেতু আমি বাংলাদেশের শিক্ষার ওপর লিখি। তাই কথা হতেই তিনি বললেন, দেশে ভূরি ভূরি বেকার ছেলেমেয়ে রয়েছে, যাদের কর্মের কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ বিশ্বে অনেক দেশ কর্মীর অভাবে শিল্প, কলকারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে।

টিভিতে খবর দেখার সময় শেয়ারবাজারের কিছু খবর নজরে পড়ে গেল। তখন মনে পড়ে গেল ড. মান্নান মৃধার কথা। মনে পড়ে গেল বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার কথা, বেকারত্বের কথা। একই সঙ্গে ভাবনাতে এল বাংলাদেশ কী করতে পারে এমন একটি সময়ে, যখন পৃথিবীর কিছু দেশ খুঁজছে দক্ষ কর্মী। অথচ রয়েছে আমাদের দেশে লাখ লাখ বেকার যুবক। তাদের হয়তো নেই সেই যোগ্যতা, যা খুঁজছে পৃথিবী! তাই বলে কী সম্ভব নয় প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়িত করা? অবশ্যই তা সম্ভব।

বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশ তাদের ইন্ডাস্ট্রিতে লোক নিয়োগের জন্য ওঠে-পড়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, কর্মীর অভাবে তারা ইন্ডাস্ট্রি চালাতে পারছে না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকেরা বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী কর্মীর অভাব দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত, চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এ ধরনের সুযোগ নেওয়া। বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি এবং বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা বের করে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে পারে।

দেশের বেকার শিক্ষার্থীদের চাহিদাভিত্তিক এবং অন দ্য জব ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা করে বহু দেশের সঙ্গে ব্যবসায়ের সমন্বয় ঘটানো মিরাকেল কিছু নয়। যাঁরা দেশের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরা যদি সত্যিকারে চেষ্টা করেন, তবে তাঁরা পারবেন পরিবর্তন আনতে। একই সঙ্গে নিজেদের বিক্রি করা শিখতে হবে সুশিক্ষা এবং চাহিদাভিত্তিক প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে।
বেকার সমস্যা নিয়ে ভাবনাটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এর জন্য সরাসরি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ আশু প্রয়োজন। দেশকে সোনার বাংলা করতে হলে জনগণের বয়স নয়, বরং নজর দিতে হবে তাদের দক্ষতা এবং তারা যে কাজের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে, সেটা আছে কি না।

আমি আমাকে বিক্রি করেছিলাম আমার মতো করে ১৯৮৫ সালে। যেদিন বিদেশে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম সুইডেনে, সেদিন। তখন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, পৃথিবীটা একটা বেচাকেনার জায়গা। দরকারে ‘কেনা’ প্রয়োজনে ‘বেচা’। সেই থেকে লেগে আছি বেচাকেনার ওপর। দরকারে কেনা আর প্রয়োজনে বেচার সঙ্গে সুশিক্ষার সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেকে বিক্রি করতে শেখা হোক আগামী প্রজন্মের প্রশিক্ষণ। ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’।